সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী (পর্ব – ১৮)

জন্ম কলকাতায়(২৭ নভেম্বর ১৯৮০)।কিন্তু তার কলকাতায় বসবাস প্রায় নেই।কর্মসূত্রে ঘুরে বেড়ান গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে।সেখান থেকেই হয়তো ইন্ধন পেয়ে বেড়ে ওঠে তার লেখালিখির জগত।প্রথম কাব্যগ্রন্থ "আকাশপালক "(পাঠক)।এর পর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলি হলো শিকারতত্ত্ব(আদম), আড়বাঁশির ডাক(দাঁড়াবার জায়গা), জনিসোকোর ব্রহ্মবিহার(পাঠক), কানাই নাটশালা(পাঠক),বহিরাগত(আকাশ) ।কবিতাথেরাপি নিয়ে কাজ করে চলেছেন।এই বিষয়ে তার নিজস্ব প্রবন্ধসংকলন "ষষ্ঠাংশবৃত্তি"(আদম)।কবিতা লেখার পাশাপাশি গদ্য ও গল্প লিখতে ভালোবাসেন।প্রথম উপন্যাস "কাকতাড়ুয়া"।আশুদা সিরিজের প্রথম বই প্রকাশিত "নৈর্ব্যক্তিক"(অভিযান)।'মরণকূপ' গোয়েন্দা আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় অভিযান,যদিও তার বিন্যাস ও বিষয়বস্তুতে সে একেবারেই স্বতন্ত্র।এই সিরিজের তৃতীয় উপন্যাস 'সাহেববাঁধ রহস্য '(চিন্তা)।সম্পাদিত পত্রিকা "শামিয়ানা "। নেশা মনোরোগ গবেষণা,সঙ্গীত,অঙ্কন ও ভ্রমণ ।

বিন্দু ডট কম

ঘরে ঢুকে পোষাক বদলে মুখে চোখে জল দিয়ে খানিকটা সোফায় বসে রইল তরুলতা।সে কি তবে ভুল করে ফেলল?হঠকারিতা হয়ে গেল?নাকি তার মতোই অখিলেশও সমান বিস্মিত!হয়তো সেই কারণেই সে অতো রাতে ছুটে গেছে ব্রাঞ্চে।বেশিক্ষণ হাতে সময় নেই।আবার ফিরে যেতে হবে অফিসে।এবার লোকচক্ষুর সামনাসামনি।ব্রাঞ্চে ঢুকতে ঢুকতে দশটা বেজে গেল।আড়চোখে তরুলতা দেখলো ঋতবান আজ আসেনি।তার চেয়ারটা ফাঁকা।অখিলেশ তার ঘরেই ছিল।তরুলতা খানিক সেদিকে তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিল।তার বুকের ভিতরটা ঢিবঢিব করছে।দারোয়ান করম সিং অখিলেশকে কিছু বলে দেয়নি তো!না।মনে মনে বোঝায় তরুলতা।সে বলবে না।তরু জানে।
আজ ব্রাঞ্চে বয়স্ক বয়স্কাদের ভীড় বেশি।পেনসন তোলার দিন।তার মধ্যে মুখোশ দস্তানা আর পায়ের মোজা তাদের জীবন আরও কঠিন করে তুলেছে।মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে নোট গুণতে গুণতে হঠাৎ তরুলতার বাবামায়ের কথা মনে পড়ে গেল।কী করছে তাঁরা এখন?কতোদিন খবর নেওয়া হয়নি।তরুলতারা এক বোন এক ভাই। ছোটভাই ব্যাঙ্গালোরে আইটি ফার্মের ইঞ্জিনিয়র।বাবা আবগারি অফিসের চাকরির জিপিএফ জমিয়ে জমিয়ে তাকে একদিন মণিপালে পড়তে পাঠায়।অথচ তরুলতা কখনও বাবা মায়ের পুঁজি ভাঙতে দেয়নি।কমার্সে স্নাতকতার পর মাস্টার্স সিএ সব নিজের কৃতিত্বে কোচিং ছাড়াই উৎরেছে।তবু তার বাবামার মন জয় করতে পারেনি সে।শুভব্রতর সঙ্গে বিয়েটাও যতো না তাদের মতের পক্ষে,তার চেয়ে বেশি তাদের দায় রক্ষায়।সেটাই কি তবে তার বাবা মাকে এতোদিন যোগাযোগ না করবার কারণ!তারা তো ভাইয়ের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট।ভাইয়ের পড়াশুনো,ভাইৎের চাকরি,ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড,ভাইয়ের লিভইন।সেখানে তরুলতা কোথায়?রাণাঘাট শুভব্রতর মতোই যেন ফিকে হয়ে গেছিল তার জীবন থেকে।তবু তার আজ খুব মনে হলো একবার অন্তত যদি ফোন করা যায়।ঘরে ফিরে করবে সে।
ঘন্টা বাজিয়ে অখিলেশবাবুর ঘরে তলব হলো বৈশাখীর।বৈশাখী কার লোন ডিপার্টমেন্টের অস্থায়ী কর্মী।তবে তার পারফরম্যান্স খুব ভালো নয়।বেলদা গ্রামে গাড়ি কেনবার মতো লোক তেমন নেই।ব্যাঙ্ক সেই সমস্যার কথা আঁচ পেয়েই লোনের পরিধি বাড়িয়ে ট্র্যাকটর আর কৃষির লোনের সঙ্গে সেই স্কিম যুক্ত করে দিয়েছে।কাচুমাচু মুখ করে খানিক পর সে বেরিয়ে এল ঘর থেকে।বোধহয় বকুনি খেয়েছে।তবে কি অখিলেশ কিছু আঁচ করতে পারলো।চায়ের সময় তরুলতা খুব বেশি কারো সঙ্গে কথা বলে না।কিন্তু বৈশাখিদের একটা কমবয়সী মেয়েদের গ্রুপ আছে।বৈশাখী ছাড়াও সেখানে আছে জোছনা আর মালতী।সকলেই অস্থায়ী।কনট্র্যাকচুয়াল।একদিন তাদের আলোচনা ভাঙাভাঙা শুনেছে তরুলতা।বৈশাখীর বয়ফ্রেন্ড বম্বের একজন নামকরা সেলেব্রিটি।মেদিনীপুর শহরে এলে বৈশাখীর তলব হয়।কিন্তু তাতেই সে খুশী।এভাবেই চলছিল বছর দশেক।শেষমেশ নাকি সেই লোকটি বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হয়েছে।বৈশাখীর বাড়ি নারায়ণগড়।সে ছুটি নেবে ভাবছিল।অখিলেশ কি তার সেই ছুটির প্রস্তাব নাকচ করে দিল?মনে মনে তেতে উঠছিল সে।
বৌভাতের রাতে ‘দোয়াব’ পত্রিকার একটা সংখ্যা বের করেছিল শুভব্রত।এইসব সাহিত্যচর্চা পত্রপত্রিকায় তরুলতার কোনওদিনই তেমন আগ্রহ ছিল না।পাত্র হিসেবে শুভব্রতর সিভিতে সে সরকারি স্কুলের চাকরিটাই দেখেছিল।তবু তার মনে আছে,ওই পত্রিকাকে ঘিরে সেদিন একদল কবিসাহিত্যিক এসেছিল তাদের সামাজিক অনুষ্ঠানে। এই সাহিত্যিক গোছের মানুষগুলোকে তেমন বিশ্বাস হয় না তরুলতার।কেন হয় না তার প্রকৃত কারণ সে সেইদিনই জানতে পেরেছিল।শোভন অধিকারী।বিখ্যাত ঔপন্যাসিক। শহরের নামজাদা সাংবাদিক।সেলেব্রিটিই বটে।তাকে ঘিরে কতো ভক্তমন্ডলি।বয়স ষাট ছুঁই ছুঁই। তরুলতা অনুষ্ঠানের ফাঁকে সামান্য সাজঘরে এসেছিল।সেই অনুষ্ঠানবাড়ির চারতলায় সেই সাজঘর।গরমে মেক আপ টা গলে যাচ্ছিল।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মেক আপটা ঠিক করতে গিয়েই সেইদিন কুড়ি হাজার ভোল্ট কারেন্ট খাবার মতো ছিটকে গিয়েছিল সে।হঠাৎ একটা ময়াল সাপ যেন তার পিছন থেকে তাকে দমবন্ধ করে দিচ্ছে।চুমু খেতে চাইছে।সে চিৎকার করতে গেলে বলিষ্ঠ হাত চেপে ধরেছিল তার মুখ।শোভন অধিকারী সেদিন হিসহিস করে বলেছিল,’আজ স্টারটারটা চেখে গেলাম।পরে একদিন মেইনকোর্সটা খেয়ে যাবো।’লোকটা এই কথা বলে চলে যাবার অনেকক্ষণ পরেও তার কানের মধ্যে ওই শব্দগুলো বেজে চলেছিল।কিন্তু সে সেকথা শুভব্রতকে বলেনি।সে দুতিনদিনে বুঝেছিল শুভব্রতর ‘দোয়াব’ তার সতীন।আর সেই সতীনের ঘরে শোভন অধিকারীর অনেক প্রভাব।শুভব্রতকে না বললেও সেই কথা সে মেসেজ করে রাতে জানিয়েছিল সঙ্গীতাকে।সঙ্গীতা তার স্কুলের বন্ধু।পরে সে ল পড়েছে।তার বাবা কৃষ্ণনগরের জাঁদরেল উকিল।তাকে সারারাত এসএমএস করতে করতে সেরাতে আড়চোখে তরুলতা দেখেছিল শুভব্রতর চোখে কোথাও সে নেই।আছে শুধু দোয়াব আর দোয়াব।
আবোলতাবোল চিন্তায় কেটে গেল সারাটা দিন।দিন গড়িয়ে বিকেল হলো।আজ একবারও অখিলেশের ঘরে তলব হলো না তরুলতার।কেমন যেন ঠান্ডা পরিবেশ।তা হোক।সে তো কিছু ভুল করেনি।ছুটির পর টোটো করে ঘরে ফিরতে ফিরতে মনেমনে হাসছিল সে।সঙ্গীতার বাবার জন্যই হয়তো শোভন অধিকারীর এযাত্রা ‘মেইন কোর্স’টা খাওয়া হয়নি।আকাশে আজ স্তব্ধ হয়ে যাওয়া সিনিয়র সিটিজেনের মতো কয়েকটা মেঘ স্থির হয়ে আছে।তাদের চোখে মুখে সংক্রমণের আতঙ্ক।ঘরে ঢুকে চা বসিয়ে দিল তরুলতা।মাথায় সব জট পাকিয়ে যাচ্ছে।সঙ্গীতা আজ কোথায় আছে কে জানে?শুনেছিল রাজস্থানে তার শশুরবাড়ি।একটা ফুটফুটে মেয়ে আছে।ফেসবুকে নেই ফোন নম্বর নেই।কী করে দেখা হবে!ভাবতে ভাবতেই সদরে খুট করে আওয়াজ।অখিলেশ!এখন কী করবে সে?অখিলেশ কি তবে সবকিছু জেনে গেছে?
অখিলেশ অবশ্য তেমন কিছু ব্যস্ততা না দেখিয়েই সোফার ওপর বসে পড়ল।তরুলতার গতরাতের অভিমান চাপা দেওয়া ভাপের মতোই বাইরে আসতে দিল না।
-চা খাবে?
-হোক।একটা কথা…
-কী?
-সকালে আমাকে না বলে আমার ঘরে ফাইলটা খুঁজতে গেলে কেন?
সরাসরি চোখে চোখ রেখে কথা বলছে অখিলেশ।সেখানে চিলকিগড়ের প্রেমিক,গ্রামীন ব্যাঙ্কের লেপিডপটেরিস্ট নেই।সেখানে একবুক শীতলতা।যেন রক্ত চাইছে।
-তুমি জানো?কে বলল…
-আমার ঘরে আমি ছাড়া কেউ ঢোকে না।করম সিংও না।রাতে আমি আলোটা জ্বালিয়ে বেরিয়েছিলাম।তুমি সকালে সেটা নিভিয়ে এসেছো।
তরুলতা শব্দ খোঁজে ইতিউতি।কথা জরিয়ে আসছে তার।
-কী দরকার এসবে এতো তরুলতা?তোমাকে তো বলেইছি।ঋতবান ছেলেটা ভালো।ওর কোনও ক্ষতি হোক তুমি কি চাও?
তরুলতা ঘাড় নাড়ে। সে কারো ক্ষতি চাইবে কেন।
-সমরজিত লোকটা ভালো নয়।
-তুমিও কি এসবে জড়িত অখিলেশ?
অখিলেশ এবার কৌতূক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার দিকে।
-এ প্রশ্নের উত্তর আমি তোমাকে কেন দেব তরু?ভালোবাসো আমায়?বিশ্বাস করো না?
-করি তো।
-তীর্থর জন্য এটুকু করলে লোকে আমাকে যা বলে বলুক।
-কোনটুকু…
-কিছু না।চলো।
-আজ ইচ্ছে করছে না।
-আমার করছে।খোলো।
যন্ত্রের মতো তরুলতা শাড়ি খুলতে থাকে।সেই ময়াল সাপটা ফিরে এসেছে।সঙ্গীতা কোথায়?কোথায় তুই।তরুলতাকে নিজের উরুসন্ধিতে জোর করে বসিয়ে দেয় অখিলেশ।তরুলতার মনে হয় সে যেন রোদে পুড়তে থাকা একটি জোহুর প্রজাপতি।তরল ছাড়া তার কিছু খাবার নেই।তার মুখের নলে পাখির বিষ্ঠা প্রবেশ করছে।শ্বাসরোধ হয়ে আসছে তার।একবিন্দু জলপ্রয়োগ ।আবার বিষ্ঠাপান।সেখানে বিশ্বাস নেই,বৈকুন্ঠ নেই।বিষ্ঠা আর বিষ্ঠা।বিষ্ঠায় পরিপূর্ণ সেই রাজপথে তরুলতা একা।সেবিকা দাসীর মতো। অখিলেশ এবার যেন তার অবষণ্ণ সেই দেহটা তুলে মেলে দিচ্ছে প্রজাপতির খাতায়।নতুন সংযোজন।আজকের তারিখের!
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।