সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে সীমন্তি চ্যাটার্জি (পর্ব – ১৭)

স্রোতের কথা

পর্ব – ১৭

[ নতুন বন্ধুরা ] 
” নতুন ফ্লেজলিং তো??… এই যে….এই দিকে…”
আমি বিশাল হলের সুন্দর করে সাজানো বড়ো গেটের কাছে আসতে না আসতেই একজন সুন্দরী মহিলা। গ্রে রঙের ব্লেজার আর স্কার্ট পরা। সঙ্গে একজন হিউম্যানয়েড মেল রোবট… আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। মহিলার হাতে একটা পামটপ্ কম্পিউটার। কম্পিউটারে কি যেন চেক্ করে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “স্রোতস্বিনী বসুমল্লিক….তাই তো??..
তোমার গিফ্ট ব্যাগ টা কোথায়?” আমি বুঝতে পারলাম সেই সোনালী ব্যাগ টা…যেটা আমাকে সিলভিয়া দিয়েছিল… সেটার কথা হচ্ছে.।
আমি ব্যাগ টা তাড়াতাড়ি তুলে দেখালাম।
“ওক্কে!!! তুমি ঐ স্টেজের পাশে ফ্লেজলিং কর্নারে, বাকি ফ্লেজলিংদের পাশে গিয়ে বোসো…”বলে মেয়েটি হিউম্যানয়েড রোবটটির দিকে তাকিয়ে বললো, “অজিত… তুমি স্রোতস্বিনী কে একটু এসকর্ট করে নিয়ে যাও।”
আমি বিগ হলটা ভালো করে দেখতে দেখতে অজিত নামক রোবটের পিছু পিছু চললাম!
পুরোনো দিনের রূপকথার কাসলের বিশাল বড়ো ড্রয়িংহল যেরকম হয়, ছবিতে যেমনটা দেখা…এই হল্ টাও ঠিক সেরকমই। আজ বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্যই হয়তো এত সুন্দর ফুল আর আলো দিয়ে সাজানো হয়েছে…নাকি এরকমই থাকে! তা বুঝলাম না। গোটা হলটাই… সাধারণত যে কোনো অডিটোরিয়ামে যেরকম চেয়ার দিয়ে সাজানো থাকে সেইভাবে চেয়ার দিয়ে সাজানো। শুধু চেয়ার গুলো অনেক বেশী বড় ও আরামদায়ক। এক কথায় রাজকীয়। সেখানে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু ছেলেমেয়ে বসে আছে বা কেউ কেউ, চেয়ারের ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে হাসি ঠাট্টা বা কথাবার্তা বলছে। যেতে যেতে এই হলের পাশেই আর একটা বড় হলের এক অংশ চোখে পড়লো। যেটা মনে হলো ডাইনিং হল…কারণ সেখানে প্রচুর সুখাদ্যের গন্ধ ও অসংখ্য ঝকঝকে শেফিং ডিস ও কাটলারি চোখে পড়লো।
বিগ অডিটোরিয়ামের ঠিক মাঝখানে এক বিশাল রেইজড্ প্ল্যাটফর্ম স্টেজ এবং ফুল দিয়ে সাজানো পোডিয়াম আর বসার জন্য রাজকীয় কিছু চেয়ার ও লম্বা টানা টেবল্ সাজিয়ে রাখা।আর বিগ স্টেজের ঠিক ডান পাশেই একটু ছোট আর একটা প্ল্যাটফর্ম। কিছুটা একই রকম কিন্তু একটু কম জাঁকজমকপূর্ণ চেয়ার ও সোফায় সাজানো। সেখানে কয়েকজন আমারই বয়েসের ছেলে এবং মেয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। আর এই অংশটার উপরে অদ্ভুত কিছু আলো বেরোনো ফুল দিয়ে সাজিয়ে লেখা আছে ‘ফ্লেজলিংস’…
আমি রোবট অজিতের পিছন পিছন যেতে যেতেই বুঝলাম আমাকে ঐখানেই যেতে হবে। আর যারা সর্বহারা ছাগলছানার মতো মুখ করে আগে থেকেই ওখানে বসে আছে। তারা আমারই মতো ফ্লেজলিং বা ‘ছানা অদ্ভুত’। পুরো অদ্ভুত হওয়ার ট্রেনিং নিতে এসেছে। ভাবতেই আমার এই সিচুয়েশনেও হাসি পেয়ে গেল। পায়ের নীচের নরম কার্পেট মাড়িয়ে একে ওকে পাশ কাটিয়ে আমিও পৌঁছে গেলাম ওদের কাছে। তারপর ঐ সামান্য উঁচু প্ল্যাটফর্মে উঠে সেখানে রাখা একটা চেয়ারে বসে পড়লাম।
এই এরিয়াটাতে আমাকে নিয়ে মোট সাতজন বসে আছে। চারজন মেয়ে ও তিনজন ছেলে।
সবারই বয়স আমার বয়সের আশেপাশে, দু/এক বছর এদিক ওদিক হবে হয়তো।
আমার ঠিক পাশেই যে মেয়েটি বসে আছে, তার গায়ের রঙ পাকা জলপাইয়ের মতো…হালকা লালচে চুল চুড়ো করে বাঁধা…লেব্রেট পিয়ার্স (ঠোঁটের নীচটা বেঁধানো) করা, সেখানে একটা রূপালী ধাতুর পিন চমকাচ্ছে…পুরু ও সামান্য ভোঁতা নাকেও একটা নোজ রিং। একটা নীল সবুজ স্কার্ট আর বাদামী টপে সাজা বড়ো বড়ো চোখওয়ালা মেয়েটা কে ওয়াইল্ডলি সুন্দর লাগছে।
তার থেকে একটু দূরেই আরো দুটি মেয়ে প্রায় জড়াজড়ি করে বসে আছে।একজনের ছোট্ট খাট্টো ছিপছিপে মিষ্টি চেহারা।ভয় পাওয়া পুতুলের মতো মুখ। ধবধবে ফর্সা গায়ের রঙ…. কপালের উপর ফ্রিন্জকাট সোনালী কালার করা চুল…আর অপর জনের বেশ ডার্ক কমপ্লেকশন্। অজস্র কোঁকড়ানো কুচকুচে কালো চুল একটা ক্লিপ দিয়ে আটকানো। ফিগার এতটাই কার্ভি যে আর একটু ভারী হলেই , মোটা বলতে হবে। কিন্তু অদ্ভুত সুন্দর সারল্য মাখা চোখ আর ছটফটে হাসিখুশি মুখ। এরা দুজনেই জাম্পস্যুট পরে আছে শুধু রং টা আলাদা। আমি এদের দুজনের বন্ডিং দেখে ভাবলাম এরা কি দুই বোন হয়!!! কিন্তু পরক্ষণেই বুঝলাম, এত আলাদা চেহারায় বায়োলজিক্যাল সিস্টার হওয়া সম্ভব নয়।
এই মেয়ে দুটির থেকে একটু দূরেই তিনজন ছেলে একই সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে।
‌‌প্রথমজন অসম্ভব হ্যান্ডসাম… মুখের মঙ্গোলয়েড ধাঁচ দেখেই বোঝা যাচ্ছে ছেলেটি নির্ঘাত কোনো পার্বত্য এলাকার বাসিন্দা…দ্বিতীয় জন, সরল ,শান্ত ভালোমানুষ মুখের , লম্বা একটি ছেলে আর তৃতীয় জন বেশ পেশীবহুল চেহারার খুব কাটা কাটা চোখ নাক মুখের একজন ছেলে। যার মুখে এই মুহূর্তে একইসঙ্গে ভয়, আশঙ্কা ও অস্থিরতা খেলা করে বেড়াচ্ছে।
এখন কিছুদিনের জন্য ( কতদিনের জন্য তা আমি জানিনা ) এরাই আমার সঙ্গী, বন্ধু হতে চলেছে। ভাবতে ভাবতেই আমি দেখলাম। আমি যেমন ওদের দিকে তাকিয়ে আছি। ওরাও সেই একই রকম কৌতুহল আর মুগ্ধতা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে…
আমি সবার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে হাত নাড়লাম! “হাই অল্… আমার নাম স্রোতস্বিনী বসুমল্লিক। এত দিন লন্ডনে থাকতাম। এখন থেকে তোমাদেরই সঙ্গী। তোমরা আমাকে স্রোত বলে ডাকতে পারো।”
ওরা সবাই আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো। তার মধ্যে আমার পাশের মেয়েটি ও পাহাড়ি লুকের ছেলেটির হাসি খুবই আন্তরিক ও মন ছুঁয়ে যাওয়া।
বাকি রা একটু ঘেঁটে আছে…আর ওদের হাসির এক্সপ্রেশনেও তার ছাপ পড়েছে।
আমার ঠিক পাশে বসে থাকা নীল সবুজ স্কার্ট পরা মেয়েটি হেসে বললো, “যাক্, এতক্ষণে কেউ কথা বললো, আমি মৃত্তিকা….’মৃত্তিকা মাহাতো’ ফ্রম পুরুলিয়া। তবে আমাকে অনেকে মিট্টি বলেও ডাকে।ইচ্ছে করলে তোমরাও পারো। আমি তোমাকে ‘তুই’ বলতে পারি স্রোত?”
আমি উত্তরে আন্তরিক হেসে হাত বাড়িয়ে ওর হাত টা একটু চেপে ধরলাম। আর ওর করতলের উষ্ণ স্পর্শ আমায় বলে দিল,এই অদ্ভুত জায়গায় আমি হয়তো একজন বন্ধু পেতে চলেছি। সত্যিকারের ভালো বন্ধু বা হয়তো একজনের সাথে আরো অনেকজনই।
“আমরা সবাই সবাই কে ‘তুই’ ই তো বলতে পারি! আমরা তো মোটামুটি একই বয়সী…”ফর্সা মেয়েটি বলে উঠলো…”আমার নাম পামেলা রেডবার্ড… আমি ফ্লোরিডায় থাকি… মানে থাকতাম…আর ও…”
এবার পামেলার পাশের মেয়েটি কথা বলে উঠলো, আমি সুজান মেটা। আমি আর প্যাম্ মানে পামেলা আমরা দুজন ই ফ্লোরিডায় একই জায়গায় একই পাড়ায় থাকতাম…একই স্কুলে পড়তাম….আমরা দুজন বি এফ এফ্!!!কি অদ্ভুত না?? বল্ প্যাম?? ইসপ্যামার ট্র্যাকার আমাদের দুজনকে ই একসাথে চুজ্ করলো…”
সুজানের মিষ্টি কথা বলার ধরণে আমরা সবাই হেসে উঠলাম।
আমি টের পাচ্ছিলাম, আমার মনে জমে ওঠা মেঘটা একটু হলেও যেন হাল্কা হচ্ছে…এই প্রথম ইসপ্যামাকে এতটা খারাপ লাগছে না।
“তাহলে আমরাও আমাদের পরিচয় গুলো দিয়ে দিই।
“পাহাড়ি লুকের ছেলেটি বলে উঠলো, “আমি ডাইকো…’ডাইকো টেনজিন’ ফ্রম টিবেট।আমার বয়স এইট্টিন ইয়ার্স…”
“ব্যস ব্যস” মৃত্তিকা, মিট্টি বলে উঠলো….”এই বায়োডেটা তুই তোর গার্লফ্রেন্ডের জন্য তুলে রাখ। আমাদের নামেই কাজ চলে যাবে…”
আমরা সবাই হেসে উঠলাম।
” আমার নাম সমীর সেনগুপ্ত, আমি দিল্লির ছেলে।”
সরল মুখের লম্বা ছেলেটা বলে উঠলো,”তোমাদের সাথে আলাপ হয়ে খুব ভালো লাগছে…শালা্ এতক্ষণ যেন মাথায় একটা পাথর চাপানো ছিল! ভাবছিলাম কোথায় এলাম…কি হবে!”
” ঠিক বলেছিস।”
প্যাম্ বলে উঠলো…”এখন মনে হচ্ছে কোনো নতুন কলেজে পড়তে এসেছি… এই… তুই… তোর নাম টা বললি না…???”
কাটা কাটা চোখ মুখের ছেলেটির দিকে প্যাম প্রশ্ন টা ছুঁড়ে দিল… ছেলেটা যেন চমকে উঠলো…”আমি??” “ওহ্ হ্যাঁ….আমি সো স্যরি…”
“আমি রিজ্….রিজ্ মালিক।আমি দুবাইয়ের….”
“তোমার কি শরীর খারাপ?? বা অন্য কোন সমস্যা??তোমাকে একটু স্ট্রেসড্ লাগছে?”
আমি জিজ্ঞাসা করলাম। ছেলেটা চমকে আমার দিকে তাকালো, “না তো…কিছু না তো! আচ্ছা এখানে কতক্ষন লাগবে কিছু জানো কেউ??”
“আমরা কী করে জানবো….কী হবে সেটাই তো জানি না….তারপর ডিনারও আছে….যা গন্ধ বেরিয়েছে… আমি বাবা একটু ভালোমন্দ খেতে ভালোবাসি…” ডাইকো বললো….
“আমিও”…. মিট্টি বলে উঠলো…..
“তোদের দলে তাহলে আমাকেও রাখ ” আমি বললাম….
“ওরে আমিও আছি…” সুজানের খুশিয়াল ঘোষণা
আমরা সবাই হেসে উঠলাম… হাসির মতো ছোঁয়াচে রোগ আর কিইই বা আছে… কিন্তু আমি এটাও লক্ষ্য করলাম…. রিজ্ হাসার চেষ্টা করেও , কি এক অস্বস্তি তে কি জানি….ঠিক করে হাসতে পারলো না….প্রথম আলাপে বেশি জোর তো করতে পারি না…. কিন্তু ওর ঠিক কি হয়েছে…কি জানি….এটা ভাবতে ভাবতেই দেখলাম জোরালো আলো গুলো নিভে যাচ্ছে….আর একটা অদ্ভুত স্নিগ্ধ সুস্পষ্ট আলো’তে গোটা অডিটোরিয়াম ভরে উঠেছে…
আমি অবাক হয়ে দেখলাম…..বড় স্টেজের চেয়ার গুলো কখন যেন রোব পরা পুরুষ ও মহিলা তে ভরে উঠেছে…..আমরা বুঝতেই পারিনি…. তাঁদের মধ্যে আমি শুধু প্রফেসর আদিল হাসান কেই চিনতে পারলাম….আর আন্দাজ করলাম স্টেজে যারা আছেন….তার মানে এঁরাই সবাই আমাদের প্রফেসর প্রিস্ট/প্রিস্টেস…
একজন চোখ জুড়িয়ে দেওয়া সৌন্দর্য ও ব্যক্তিত্বের অধিকারিনী মহিলা মেন স্টেজের সামনে এসে সবাইকে শান্ত হয়ে নিজের নিজের জায়গায় বসতে বললেন….
আমার পাশে বসা মিট্টি ফিসফিস করে বললো….”প্রিস্টেস আলিশা…ইনিই আমার স্কুলে গিয়েছিলেন…”
আমরা সবাই চুপ করে বসে স্টেজের দিকে তাকিয়ে রইলাম…. আমি সবার মধ্যে মিরান্ডা ম্যাম কেও খোঁজার চেষ্টা করলাম… কিন্তু উনি আপাতত কোথাও নেই….
উনি গেট দিয়ে ঢুকছেন কিনা দেখার জন্য আমি বিগ হলের এন্ট্রি গেটের দিকে তাকালাম….আর তখনই দেখতে পেলাম… আলোহা মুখার্জি আর ওর সাথে ওরই মতো পোষাক আশাক পরা আরো দুজন মেয়ে আর তিনটে ছেলে… (ওদের মধ্যে এরিক একজন )…. বিগ্ হলে ঢুকে এসেই স্টেজের কাছে সবথেকে প্রথম রো’তে এসে…. যারা বসেছিল…তাদের সবাই কে হাতের ইশারায় উঠিয়ে দিয়ে….সবচেয়ে ভালো চেয়ার গুলো দখল করে বসে পড়লো…
আমি অবাক হয়ে দেখলাম…. ছেলেমেয়ে গুলো বিনা প্রতিবাদে উঠেও গেল…. আশ্চর্য…. আলোহা দের কি সবাই-ই ভয় পায়??? কিন্তু কেন?? ও… বা ওরা অবলীলায় অসভ্যতা করতে পারে বলে???

আমি আলোহাদের দিকেই তাকিয়ে ছিলাম…. হঠাৎ হাতে খোঁচা খেয়ে চমকে ফিরে তাকালাম…
মিট্টি…আমাকে ঈশারা করে স্টেজের দিকে দেখতে বলছে… আমি বিগ্ স্টেজের দিকে তাকালাম…

উপরের কোনো এক অজানা উৎস থেকে এক নরম নীলচে আলোর রেখা সরাসরি তেরছা ভাবে স্টেজ ফ্লোরে এসে পড়েছে….আর সেই আলোর রেখা বেয়ে বিনা সিঁড়িতেই……রোব লুটিয়ে…নিজেই যেন এক আলোর রেখা হয়ে…উপর থেকে নেমে আসছেন রূপের আলোয় আলোময়… আমাদের হাই প্রিস্টেস
“ম্যাডাম মিরান্ডা প্রিস্টলি”

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।