সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী (পর্ব – ৫)

কেদার

“তং দৃষ্ট্বা ব্রীড়িতা দেব্যো বিবস্ত্রাঃ শাপশঙ্কিতাঃ।
বাসাংসি পর্যধুঃ শীঘ্রং বিবস্ত্রৌ নৈব গুহ্যকৌ ।।” (শ্রীমদ্ভাগতবত, স্কন্ধ ১০,অধ্যায় ১০, শ্লোক ৬)
(নারদমুনিকে হঠাৎ দেখতে পেয়ে নগ্ন দেবকন্যারা লজ্জিত হলেন। অভিশাপের ভয়ে তড়িঘড়ি পরিধান পরে নিলেন। কিন্তু কুবেরের দুই পুত্র অবিচল থাকলেন। তারা বস্ত্রও পড়লেন না। বিচলিতও হলেন না। তাই তাদের ভাগ্যে জুটল অভিশাপ। সেই অভিশাপ বালক কৃষ্ণর এক অবিস্মরণীয় লীলার ভীত স্থাপন করল।)

কৃষ্ণেন্দু ঘুমিয়ে পড়েছিল। প্রথমে ভেবেছিল জেগে থাকবে। মা এতো রাতে কোথায় গেছে কে জানে! ওই আমবাগানের দিকটা কেমন যেন গা ছমছম করা। ভয় করে। ভাবতে ভাবতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমের ভিতর সে দেখতে পেল ঘাসজমি। মাইলের পর মাইল। অমন ঘাসের মাঠ কোনও একসময় দাদু বলত, ওপার বাংলায় ছিল। এই ঘাসজমি সে দেখেছে কলেজে আধুনিক ইয়োরোপীয় তৈলচিত্রে। সেই ঘাস জমি বেয়ে দৌড়ে আসছে একদল সাদা ঘোড়া। তাদের উন্মুক্ত পেশীবহুল পা। দৃপ্ত চলন। তুষার ধবল সেই ঘোড়ার দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছে যে ঘোড়াটি, তার মুখাবয়ব কৃষ্ণেন্দু স্পষ্ট দেখতে পেল না কিছুতেই। ঘোড়াগুলি গ্রামের পথ বেয়ে শহরে ঢুকে আসছে। রেড রোড, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, মেয়ো রোড, এলগিন, কলেজস্ট্রিট রাস্তাঘাট শুনশান। কেউ নেই। শুধু একদল সাদা ঘোড়া। ধেয়ে চলেছে কোথাও। কোথায় কে জানে! ভাবতে ভাবতেই ঘুম ভেঙে গেল তার। জানলায় ভোরের আলো। সকাল হতে বেশি বাকি নেই। তড়িঘড়ি বিছানা থেকে নেবে হ্যাণ্ডমেড কাগজের একটা শিট বোর্ডে লাগালো কৃষ্ণেন্দু। তারপর চারকোল বের করে আঁকতে লাগল। ঠিক যেমনটি দেখেছে। ময়দান, শহীদ মিনার আর চওড়া রাস্তা। শুনশান। সেখানে দৌড়ে চলেছে একদল সাদা ঘোড়া। প্রথম ঘোড়ার ঘোড়সওয়ার আঁকতে গিয়ে থেমে গেল কৃষ্ণেন্দু। ঠিক এতোটুকুই তো সে স্বপ্নে দেখেছিল। কাগজে আঁকার সময় চারকোল হাতে নিলে তার আর আশপাশের দিকে কোনও হুঁশ থাকে না। আঁকা শেষ হতে সে দেখল নিঃশব্দে কখন যেন তার মা তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
-কী আঁকছিস এটা?
-জানি না। হঠাৎ ইচ্ছে হলো।
-ওহ। ভারি সুন্দর হয়েছে।
-ধুর। এটা তো একটা হিজিবিজি।
অলোকানন্দা চুপ করে যায়। সে জানে চিত্রকরকে ‘কেন আঁকছেন?’ বা ‘কী আঁকছেন?’ জিজ্ঞেস করা একধরনের বাতুলতা। তবু যেন কোনও অমোঘ প্রতিক্রিয়ার মোহে সে জিজ্ঞানা করে ফেলেছিল ।গতকালের দূরত্ব যেন আর নেই।
-কলেজ যাবিনে?
-যাবো তো।
কৃষ্ণেন্দু ধড়মড় করে উঠে পড়ে। আজ কলেজে যাওয়াটা খুব জরুরি। ফাইন আর্টসের ডিপার্টমেন্টাল হেড বসন্ত সমাদ্দার আজ ক্লাস নেবেন।এই সেমিস্টারের শেষে প্রোজেক্টের বিষয় বলবেন। গেল বছরগুলোয় এই বিষয়গুলি অদলবদল হয়েছে নানাভাবে। সিনিয়রদের মুখে শুনেছে কৃষ্ণেন্দু। এই প্রোজেক্টের নম্বর ফাইনালে যোগ হয়।
সকালে মাকে দেখে মন ভালো হয়ে গেল তার। মা ডাল ভাত মাছের ঝোল হাতে করে খাইয়ে দিয়েছে। কতো বছর বাদে। কলেজে যাবার পথে সাধারণত চতুর্থ কামরায় সহেলী ওঠে। কিন্তু আজ দেখা হলো না। সহেলী খি তবে আজ কলেজ যাবে না। ফোনে তেমন কিছু জানালো না তো! কলেজের গেটে পৌছে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল কৃষ্ণেন্দু। গেটের সামনে জটলা। ক্যামেরা, মোবাইল ফোন, সেলফিস্টিক নিয়ে পুলিশ, মিডিয়া আর মানুষের জটলা। বুকের ভিতর ছ্যাঁত করে উঠল তার। দুর্ঘটনা ঘটল কোনও? জটলার ভিতরেই উদ্বিগ্ন সহেলীকে আবিষ্কার করল সে। সঙ্গে তার ক্লাসের অন্যান্য ছাত্রছাত্রীরাও।
-কী হয়েছে রে?
-দেখ।
জটলা সরিয়ে সামনের দিকে এসে থমকে গেল কৃষ্ণেন্দু। জটলার ঠিক মধ্যিখানে অতসীদি ও আরও দুইজন সমবয়স্ক নারী ব্যানার হাতে গেট আটকে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁরা তিনজনেই নগ্ন। ব্যানারে লেখা, “আমাদের নগ্ন প্রতিবাদ”। এমন ঘটনা এর আগে কখনও প্রত্যক্ষ করেনি কৃষ্ণেন্দু। তিনজন নারীর চুল খোলা। সেই খোলা চুলে উন্মুক্ত স্তন খানিকটা ঢেকে আছে। প্রতিবাদ জানানো ভিনাইল ব্যানার কটিদেশ ঢেকে রেখেছে। উৎসুক জনতা উঁকি মারছে। কয়েকটা খয়েরি চুলের ফচকে ছেলে পাশ থেকে ফিকফিক করে টিটকিরি মারছে। কৃষ্ণেন্দু চোখ কটমট করে বিরক্তি আর রাগ প্রকাশ করতেই তারা সবে গেল। কিন্তু ব্যাপারটা কী? সহেলীকে জিজ্ঞেস করতে সে গম্ভীর হয়ে বলল, “ভিতরে চল। বলছি।”
অতসীদির সঙ্গের দুইজনের নাম শিখা নস্কর ও নমিতা সামন্ত। অতসী রায়ের মতোই তারা এই কলেজের ন্যুড মডেল।যদিও বাকি দুজনকে আঁকবার জন্য কৃষ্ণেন্দুরা পায়নি। দীর্ঘ কিছু বছর কাজ করবার পরেও তাদের মজুরি ঠিক মতো দিচ্ছিল না কর্তৃপক্ষ। টালবাহানা চলতেই থাকছিল। কিন্তু তাদের সেই সহ্যর সীমা অতিক্রান্ত হলো যখন কলেজের সিনিয়র অধ্যাপক সন্দীপন মণ্ডল দিনের পর দিন তাদের যৌন হেনস্থা করতে শুরু করলেন। এই সন্দীপন মণ্ডলকে কৃষ্ণিন্দু এর আগে দেখেছে। কষ্টিপাথরের মতো গায়ের রঙ। কপালে লম্বি চন্দনের তিলক পরে আসেন রোজ। গলায় কণ্ঠি। সুভাষগ্রাম থেকে আসেন। তার কাজ মূলত গ্রামীন বৈষ্ণবদের নিয়ে। মূলত পেন অ্যাণ্ড ইঙ্কে কাজ করেন। কৃষ্ণেন্দুর ওঁর কাজ ভালোই লাগত। কলেজের ঢোকার শুরুর দিকে একটা প্রদর্শনী চলাকালীন কথা বলেছিল যেচে গিয়ে। কথা বলে ভালোই লেগেছিল তার। ঠিক যেন মাটির মানুষ। এই মানুষ এমন কাজ করবেন ভাবা যায় না। অথচ অতসীদি মিথ্যে বলেন না। ওঁদের ওই প্রতিবাদ নির্ঘাত আগামীকাল সারা শহরজুড়ে খবরের প্রথম পাতায় উঠে আসবে। মণিপুরের ইম্ফলে যেমন হয়েছিল। সেদিন মণিপুরের বত্রিশজন মা নগ্ন হয়ে পথে নৈমেছিল আসাম রাইফেলসের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে। প্রতিবাদের ব্যানারে লেখা ছিল ‘ইণ্ডিয়ান আর্মি রেপ আস।’
সহেলীকে সন্দীপন মণ্ডল সম্পর্কে তার ধারণা বলতেই সহেলী গুম হয়ে বলল,”সব পুরুষমানুষই আসলে একরকম, জানিস কৃষ্ণেন্দু। ওরা শুধু শরীর বোঝে।”
-সবাইকে দায়ী করছিস কেন? তাছাড়া সিস্টেমও তো দায়ী। দিনের পর দিন মাইনে আটকে রাখা।
-ওই সিস্টেমটাও তো পুরুষতান্ত্রিক। মেয়েদের শরীরের দাম সেখানে কোথায়!
নারী পুরুষের এই সংঘাত কৃষ্ণেন্দু মন থেকে মানে না। কিন্তু সে বুঝতে পারছিল ভিতরভিতর সহেলী খুব বিচলিত রয়েছে। ক্লাসও তেমন হলো না আজ। শুধু বসন্ত স্যার তড়িঘড়ি এসে বলে গেলেন,”তোমরা প্রজেক্ট তৈরি করো। তোমাদের বিষয় হবে ‘প্রতিবাদ’।কাল পড়শু কলেজ হবে না। তোমরার সামনের সপ্তাহে এসে খসড়া দেখাবে।”
কলেজ ছুটি হতে গেটের বাইরে এসে কৃষ্ণেন্দু দেখল ভীড় সরে গেছে। অতসীদিরাও আর নেই। কীই হলো কে জানে! সারাটা রাস্তা সহেলী কোনও কথা বলল না তার সঙ্গে। ভাবখানা এমন যেন সব দোষ তারই। এই নিশ্চুপ থাকাই সহেলীর প্রতিবাদের ভাষা। কৃষ্ণেন্দু রেগে গেল না। বরং হঠাৎ সে আবিষ্কার করল রেগে গেলে সহেলীর চোখগুলো আরও বড় বড় দেখায়। সরোবরের মতো গভীর। সেখানে জল জমলে চাঁদের জোছনার মতো সেই জলকণা চিকচিক করে। ডুব দিতে ইচ্ছে হয়।নতুনগ্রাম স্টেশনে নেমে যাবার সময় সহেলী শুধু বলল,”বাই।” ট্রেন ছেড়ে দিল। কৃষ্ণেন্দু ভাবছিল অতসীদির কথা। তার ওই নগ্নতা তার দুর্বলতা নয়। শক্তি। নারীর নগ্নতা নারী নিজেই যখন স্বেচ্ছায় পণ্যবস্তু হিসেবে ব্যবহার করে, তখন সভ্যতা বড় অসহায় হয়ে পড়ে তার সামনে। এক্ষেত্রে কিন্তু অতসীদি তার নিজস্ব নগ্নতাকে আগুনের মতো তুলে ধরেছে আজ।সে নগ্নতায় স্পর্ধা আছে, পবিত্রতা আছে। আর আছে দহন। মনে মনে প্রজেক্টের ছবির বিষয় তৈরি করে ফেলল কৃষ্ণেন্দু।উন্মুক্ত ধানক্ষেত। ফসল কাটা হয়ে গেছে। ফসলের জায়গায় জায়গায় ফোসকা পড়ে যাবার মতোই নাড়া জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেন সভ্যতার পোড়া ক্ষত। আকাশে কৃষ্ণাভ মেঘ। দূরে একদল হাঁস উড়ে যাচ্ছে। ক্ষেতের বুকে একটি বাদামি ঘোড়া। তার চোখেমুখে আদিম গতি। তার উপরে সওয়ার হয়ে আছে এক নারীমূর্তি। সে সম্পূর্ণ নগ্ন। ঘোড়ার দৌড়ের গতির সঙ্গে তার নগ্ন উরুর পেশি, হাতের মুঠি নড়ে উঠছে। তার আলুলায়িত কেশ তাকে আবৃত করে রাখতে পারছে না। তার দুই স্তন উন্মুক্ত। তার চোয়াল শক্ত, মুখের ভঙ্গিতে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা। তার দুই চোখে অসীম সাহসিনী।কৃষ্ণেন্দুর ক্যানভাসে এই সাহসিনী হলেন অতসী রায়। গোকুলঘরিয়ার ঘরে ফিরতে ফিরতে কৃষ্ণেন্দু বুঝতে পারে। স্বপ্নে দেখা সেই সাদা ঘোড়ার সওয়ারীও অতসীই ছিলেন। তার সাহস প্রতিবাদের সাহস। তার নগ্নতা প্রতিবাদের নগ্নতা।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।