সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী (পর্ব – ৮)

ক্ষণিক বসন্ত

বিভাস

পাব থেকে বের হতে হতে রাত হয়ে গেল। অবশ্য একটা আশ্চর্যজনক বিষয় রয়েছে ঘোলা থানার ওসি বিভাস রাউতের জীবনে। যতো মদ্যপানই না করুক সে, গাড়ির স্টিয়ারিং এর সামনে বসলে মন একদম স্থির। কোনও এদিক ওদিক নেই। জড়তা নেই। আবেগ নেই। ডিপার্টমেন্টের অনেকে অবশ্য এটা জানে। জেনেও চেপে যায় সামনে থেকে। রাজ্যজুড়ে কড়াকড়ি মদ্যপান আর গাড়ি চালানো নিয়ে। রাতবিরেতে হুটহাট গাড়ি থামিয়ে মুখে যন্ত্র তাক করে মেপে নেওয়া হচ্ছে চালক মদ খেয়েছে কিনা। যদিও পাবলিক ভাবছে এসব মাল কামানোর ধান্দা, কিন্তু পরিসংখ্যান তা বলছে না। সেখানে বরং স্পষ্ট ইঙ্গিত গেল এক দেড় মাসে এই মধ্যমগ্রাম পানিহাটি চত্বরে মদ খেয়ে গাড়ি দুর্ঘটনার ঘটনা অর্ধেক হয়ে গেছে। এহেন অবস্থায় যদি জানা যায় খোদ ঘোলা থানার বড়বাবু কারনসুধায় গাড়ি চালান, তাহলে ডিপার্টমেন্টের যে বর্ণাঢ্য শ্রীবৃদ্ধি হবে না, একথা বলাই বাহুল্য। তবু এতো কিছু জানার পরও বিভাসের সহকর্মীরা তাকে ক্ষমা করে দেয়। এই ডিপার্টমেন্টের প্রত্যেকের কথা বিভাস স্যার প্রাণ দিয়ে ভাবেন। ঠিক যেন এক পরিবারের মতো। এই তো সেদিন। জুনিয়র কনস্টবল বৃন্দাবন নস্করের মায়ের স্ট্রোক হয়ে গেল। ঠিক সময়ে হাসপাতালে না নিয়ে গেলে হয়তো বাঁচানো যেত না। এদিকে হসপিটাল বেসরকারি। সেখানে পাইপয়সা হিসেব না চুকিয়ে একটা ইঁদুর বের করাও কঠিন। বিভাস সেইসময় নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলে বৃন্দাবনকে বাঁচিয়ে দিল। বিভাসকে আরেকটা কারণে ছাড় দেয় তার ডিপার্টমেন্টের লোকজন। আর সে কারণ বিভাস রাউতের গানের গলা। কখনও শেখেনি কোথাও। তবু কী অসাধারণ সেসব মূর্ছনা। ছুটি পেলেই বিভাসের বাড়িতে আসর বসে। কখনও যোগিয়া বিভাস মোহন বাঁশি, কখনও আবার কিশোরকুমারের ‘চিঙ্গারি কোই ভড়কে’। মাঝেমাঝে সেই আসরের সুরগুলো পুলিশ কোয়ার্টার ছাড়িয়ে আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় মানুষ বিভাস রাউতের গান শুনতে শুনতে ভুলে যান এই মানুষটা ঘোলা থানার ওসি। ক্রিমিনাল প্যাঁদান। গুলি চালান। বিভাস গেয়ে চলেন ,”আধোরাতে যদি ঘুম ভেঙে যায়”, মানুষ ঘুমভাঙানিয়া চোখে জেগে শুনতে থাকে সেই গান। “তোমায় গান শোনাব”। পাড়ার পাঁচুখুড়ো কিছু হালবয়সের ছেলে ছোকড়া হাতের কাছে পেয়ে বলেন, “হবে না। এ হল পানিহাটি এলাকার জল-হাওয়া-বাতাসের গুণ। রাজ্যেশ্বর মিত্রর নাম শুনেছিস তোরা। তার গান একবার শুনলে বুঝতিস। শুধু কি গান?কী অপরূপ তার এসরাজের ছড়ের টান…” ভাবতে ভাবে খুড়ো নস্টালজিক বিভোর হয়ে ওঠেন। সুযোগ বুঝে ছেলেছোকরারা জয়েন্টে সুখটান দেয়। মঞ্চ থেকে ভেসে আসে বিভাসের গলা। “রাত নির্জন, পথে কতো ভয়, তবুও রানার ছোটে।”এমন একজন মানুষের জীবনে একটুআধটু ত্রুটি বিচ্যূতি ঘটতেই পারে। বৃন্দাবন মনে মনে বলে,”ওসব দেখতে নেই। স্যার আমার ভগবান।”
ত্রটি বিচ্যূতি বিভাস রাউতের জীবনে আছে অনেক। গানের সুরের মতো তার যাপনের ‘পিচ’ কিন্তু নিখুঁত নয়। বিয়ে ভেঙে গেছে অনেকদিন। ইমনের সঙ্গে সম্পর্কটা এই মদের নেশার জন্যই টিকলো না মাস ছয়েকের বেশি। এখন কাজের ফাঁকে বিভাস রাউত লাগামছাড়া। সেই লাগামহীন সুরমণ্ডলীকে বাঁধন দিতে কখন যে তার জীবনে পূরবী প্রবেশ করে গেল, বিভাস নিজেও বুঝতে পারেনি। মেয়েটা এসেছিল মাদকের ‘এনডিপিএ’ কেস নিয়ে। কী ছিল পূরবীর চোখে কে জানে। একবার শুধু বিভাসের চোখে চোখ রেখে বলেছিল, “কথা দিচ্ছি স্যার। ভুল হয়ে গেছে। আর করব না।” বিভাস লক আপ থেকে ছেড়ে দিয়েছিল। মনকে বুঝিয়েছিল। সে নিজে ইমনের কাছে দ্বিতীয় সুযোগ পায়নি। কিন্তু তা বলে অন্য কেউই তা পাবে না, এটা হতে পারে না। প্রতিটি মানুষের জীবনে তেহাই থাকা উচিত। তেহাই মানুষকে সুর ধরে রেখেও শোধরানোর সুযোগ দেবে। পূরবী অবশ্য কথা রাখেনি। বিভাস খবর পেয়েছে নানা সূত্রে। নানা ভাবে। তবু তার চোখের দিকে তাকিয়ে বিভাস কেমন অসহায় বনে গেছে।
গাড়ি স্টার্ট দিয়ে অ্যাক্সিলারেটরে পা রাখতে গিয়ে বিভাস বুঝল তার চড়ে গেছে। আর এই চড়ে যাবার কারণ শুধুই মাদক নয়। তার মন। মন ভালো নেই তার। আজ পাবে পূরবী এসেছিল কথামতোই। তড়িঘড়ি ঘনিষ্ট হয়েছে দুজন। পাবে আলাদা নিজস্ব ঘর আছে বিভাসের। সেখানেই উল্টেপাল্টে পূরবী সেধেছে বিভাস। তারই মধ্যে এক সময় বিভাস পূরবীকে বলেছে।
-ওই চারুকেশী মেয়েটাকে তোমরা ফাঁদে নিও না। ও মনোহরদার মেয়ে। আমি তাকে কথা দিয়েছি।
ব্রা প্যান্টি পরতে পরতে ঠোঁটে সিগারেট রেখে চাপা স্বরে পূরবী বলল, “কেন বিভাস? তুমি ওকেও নিয়েছ বুঝি? কেমন মেয়েটা? হট।”
-না। ভুল বুঝছ পূরবী। মনোহরদাকে ছোট থেকে চিনি। আমার বাবার ছাত্র।
-তো? বাবার ছাত্র বলে কি তার মেয়েকে লাগানো বারণ?
মাথায় খুন চেপে গেল বিভাসের। কী ভেবেছে মেয়েটা? খাটের কোণায় লেপ্টে থাকা ইউনিফর্ম প্যান্টের চামড়াখোপ থেকে সার্ভিস পিস্তলটা বের করে পূরবীর মুখের ভিতর নল পুড়ে দিয়েছিল বিভাস।হিসহিস করে বলেছিল।
-শোন। তোদের সব খবর আমার কাছে আছে। ব্যারাকপুরে মাগী এনে যে গানের বার খুলেছিস তোরা, তার ভিতরে কী চলে সব জানি। তুই ঠিকঠাক মেয়ে হলে আর আমার বিয়েটা টিকে থাকলে তুই আমার মেয়ের বয়সী হতিস। বেশি পিঁয়াজি করলে লাশ ফেলে দেব খানকি মাগী।

পরক্ষণেই আবার হঠাৎ নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে এসেছিল যদিও। কোনও অসুর ভর করেছিল যেন এই কয়েক মুহূর্ত তার ভিতর। ‘সরি’ বলে বিভাস খাটে বসে সামলে নিচ্ছিল নিজেকে। পূরবী চোখ মুছে নিল। সামান্য চোয়াল শক্ত হল তার। তার পরমুহূর্তেই আবার সে নরম হয়ে বলল,”আমি বুঝতে পারছি বিভাস। জাস্ট জোক করছিলাম। মেয়েটাকে একবার দুবার কলেজে দেখেছি। তুমি বলছ যগন, আমি ওদের বলে দেব। তবে ব্যারাকপুরের ব্যাপারটা আর কারোকে বলো না। ভাই রেগে যাবে।”
-ভয় দেখাচ্ছ আমাকে?
-না। ঘোলার থানার ওসি বিভাস রাউত। তার কতো পাওয়ার। তাকে আমি নষ্ট মেয়েছেলে। ভয় দেখাব?
পূরবী বেরিয়ে গেলে বিভাসও বেরিয়ে এসেছিল। এখন গাড়িতে বসে ভাবছিল। এর কী দরকার ছিল? ভালো করে বললেই তো হত। নয় কি? ভাবতে ভাবতে গাড়ি হাইওয়ের দিকে ঘোরাতেই ওয়াকিটকিটা বেজে উঠল হঠাৎ। বৃন্দাবন রয়েছে ওপাশে।
-একটা ঝামেলা হয়ে গেছে স্যার।
-কী ঝামেলা?
-পানিহাটি মোড়ে অষ্টপ্রহর সংকীর্তনে একটা ছেলে মারা গেছে।
-তো?
-আই মিন। মেরে দিয়েছে।
-মার্ডার?
-ঠিক তা নয়। মাস লিঞ্চিং এর মতো। একবার আসুন স্যার। ধর্মীয় ব্যাপার। সেনসিটিভ।

ভ্রু কুঁচকে গাড়ি ঘুরিয়ে মুখে চিকলেট পুরে নিল বিভাস। এইসব পাবলিক খুব ত্যাঁদোর হয়। মদের গন্ধ পেলেই বলবে পুলিশ ফুর্তি করতে এসেছে। পানিহাটি মোড় পেরিয়েই গাড়ির ছাদের হুটারটা অন করে দিল সে। সামনে প্রচুর লোকজন। পুলিশের গাড়ি আসতে দেখে তারা তড়িঘড়ি সরে দাঁড়াতেই হরিমণ্ডপের ঠিক পাশে কম্বলের উপর তালগোল পাকানো একটা দেহ দেখা গেল। দেহটা একটা অল্পবয়সী ছেলের। তার উপর আঘাতের চিহ্ন দেখলে বোঝা যায় কী নির্মমভাবে তাকে হত্যা করা হয়েছে। চোয়াল শক্ত হয়ে গেল বিভাসের। লাশের অনতিদূরে বৃন্দাবন দাঁড়িয়ে ছিল। বিভাসকে আসতে দেখে সে স্যালুট করে বলল।
-কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আলাদা করে রেখেছি স্যার।
-আর ফরেন্সিক টিম?
-আসছে। বডি নিয়ে যাবে ওরা।
লাশের কাছে গিয়ে হাঁটু মুড়ে দেখছিল বিভাস। হাত দিয়ে মুখ ঢাকা থাকলেও রাইগর আসেনি তখনও। দস্তানা পরে হাতটা সরিয়ে দিয়েই চমকে উঠল সে। এই ছেলেটাকেই তো মনোহরদা আর তার মেয়ে খুঁজতে এসেছিল সেদিন! কী যেন নাম! ঠিক ঠিক। মনে পড়ে গেল বিভাসের। এই ছেলেটার নাম কেদার। নাম মুখ থেঁতলে গেলেও বিভাসের শকুনের চোখ। সে মানুষ চিনতে ভুল করে না।
জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আলাদা করে রাখা লোকগুলির কেউ কেউ পালাকার, দু একজন গোঁসাই, আর বাকি সব স্থানীয়। এর মধ্যে সকলের বয়ানই মোটামুটি এক। সংকীর্তনের নিয়ম অনুযায়ী অষ্টপ্রহর শেষ না হওয়া অবধি কেন্দ্রের হরিমণ্ডপে রাখা পরমান্ন স্পর্শ করার অধিকার কারো থাকে না। এই ছেলেটি সেই নিয়ম লঙ্ঘন করে হরিমণ্ডপে ঢুকে পরমান্নে থুতু দিয়ে সংকীর্তন অপবিত্র করে দিয়েছে। এটাই তাদের সমবেত বয়ানের সারমর্ম। সেইমতো বয়ানখাতায় লিখে নেবার পর ইতিমধ্যেই চলে আসা পুলিশ ভ্যানে হ্যাণ্ডকাফ পরিয়ে তোলা হল অভিযুক্তদের। বডি নিয়ে যাচ্ছে ফরেন্সিক টিম। ঘটনার জায়গাটা সিল করে গাড়িতে ফিরে এসে বিভাস ভাবছিল। সত্যিই কি কেদার জেনে বুঝে এতো সব করেছে? মনোহরদা আর তার মেয়ের কাছে এই ছেলেটার ব্যাপারে শুনে তার ধারণা হয়েছিল এই কেদার ছেলেটা খানিকটা মানসিক ভারসাম্যহীন অপ্রকৃতিস্থ। হয়তো এতোদিন অভুক্ত থাকার ফলে ভিতরভিতর কেদার অশান্ত হয়ে উঠেছিল। ক্ষুধা মানুষকে বিষম করে তোলে। প্রকৃতিস্থ মানুষ তার মাথা ঠিক রাখতে পারে না। আর এই ছেলেটি তো অসুস্থ। এই হরিভক্তিপরায়ন মানুষগুলো কী একবারও ভেবে দেখল না ছেলেটা ইচ্ছে করে নয় ক্ষিধের জ্বালায় পরমান্নঘরে ঢুকে পড়েছিল। তার থুতু দেওয়াটা হয়তো থুতু নয়, অজান্তে রোগ আর ফিটের প্রকোপে ঝরে পড়া লালা। কেদার নয়, বিভাসের মনে হল, এই হরিসভার সব কটি ধর্মান্ধ মানুষই আসলে অপ্রকৃতিস্থ। ওদের সবার চিকিৎসার দরকার। ততোক্ষণে কেদারের বডিটা কালো পলিথিনে মুড়ে ফেলা হয়েছে। এবার মর্গে চালান করা হবে।

কোয়ার্টারের সামনে গাড়ি পার্ক করতে করতে আবার ভারাক্রান্ত লাগছিল পা দুটো। মনোহরদাকে এতো রাতে খবরটা জানিয়ে লাভ নেই। যা হবার তো হয়ে গেছে। কাল সকালে জানানো যাবে। ভাবতে ভাবতেই ইমনের কথা মনে হল একবার বিভাসের। কেমন আছে কে জানে? বিয়ে হয়েছে শুনেছিল যেন। ভালোই থাকবে নিশ্চয়ই। তারপর একঝলক ভেসে এল পূরবীর মুখটা। আহা। বড় কঠোর হয়েছে সে আজ। এতটা বাঞ্ছনীয় ছিল না। পরের দিন ক্ষমা চেয়ে নেবে সে। গুনগুন করে উঠল ভিতরভিতর ‘অমর প্রেম’। ‘কুছ তো লোগ কহেঙ্গে। লোগোকা কাম হ্যায় কেহনা।” গাড়ি দরজা বন্ধ করে সদর দরজার তালায় চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে বিভাস হঠাৎ অনুভব করল তার বুকের বাঁদিকে তীব্র ব্যথা। সেই ব্যাথার উৎস খুঁজে বের করতে না করতেই আরও দুটো তীব্র বেদনাঘন অনুভূতি ঘিরে ধরল তার আঘাতের জায়গাটিকে। চকিতে হাত রেখে বিভাস বুঝতে পারল তার ইউনিফর্ম রক্তে ভিজে যাচ্ছে। ডান হাত রিফ্লেক্সে চলে গেল বাম দিকের প্যান্টের পকেটে। সার্ভিস রিভলভারটা খুঁজতে গিয়ে পেল না বিভাস। বোধহয় গাড়িতে ফেলে এসেছে। ঘুরে আততায়ীকে মুখোমুখি একবার দেখতে চেষ্টা করল সে। কিন্তু পারল না। এক ঘন অন্ধকার গ্রাস করে নিল তাকে। ধপ করে সিঁড়ির ওপর পড়ে গেল ঘোলা থানার ওসি বিভাস রাউতের বডিটা।

শেষ গুলিটা টার্গেটের খুলি ভেদ করেছে শিওর হয়ে ছায়ামূর্তিটি এইবার তার চাদরের ভিতর সাইলেন্সর লাগানো রাইফেলটা ঢুকিয়ে নিল। তারপর এপাশ ওপাশ দেখে আশপাশের ঘন অন্ধকারে পুরনো গালার সাড়ে তেত্রিশ আরপিএম এর রেকর্ডের মতোই মিশে গেল।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।