মার্গে অনন্য সম্মান সুতপা ব‍্যানার্জী(রায়) (সেরা)

অনন্য সৃষ্টি সাহিত্য পরিবার

সাপ্তাহিক প্রতিযোগিতা পর্ব – ৯০
বিষয় – পরম্পরা

রাধা

তিন দিদির পর যখন ছোট্ট অরণ‍্য জন্মাল তখন ওদের সংসারে আনন্দের হাট বসল। নিরূপার কোল আলো করে আসা নবজাতককে দেখে কৃষি বিভাগে কর্মরত অরণ‍্যপ্রেমী বাবা নাম রাখলেন অরণ‍্য। সংসারের নিয়মে সব মনোযোগ, আদর-ভালোবাসা পেতে শুরু করল সবার ছোট অরণ‍্য। দিদিরাও খুব খুশী ওদের ভাই ফোঁটা,রাখী উৎসব অরণ‍্যের জন্য পূর্ণতা পেল বলে।আগে ঐসব দিনে ওরা মুখ চূণ করে থাকত।অন‍্য বাড়ির থেকে আসা শাঁখের আওয়াজ শুনত। এবারে সেসব আনন্দ-উৎসব ওদের বাড়িতেও হবে। অরণ‍্যও তিনদিদি ও বাবা’মায়ের আনন্দ,প্রশ্রয়ে বড় হতে থাকল। অরণ‍্যর শৈশব সরলরেখায় বিচরণ করলেও কৈশোর এক সঙ্কটের সম্মুখীন হল। বাবা’মায়ের অদম‍্য চেষ্টাতেও অরণ‍্যের সাধারণ লেখাপড়ায় মন বসল না। আউল,বাউলদের আখড়ায় ঘুরে বেড়ানো শুরু করল। নৃত‍্য,গীত,বাদ‍্যে অমোঘ আকর্ষণ বোধ করত অরণ‍্য।নিজেকে সবসময় শ্রীরাধারূপে কল্পনা করত। এ জাতীয় ভিন্নধর্মী আচার আচরণে বিরক্ত অরণ‍্যের বাবা ওকে মানসিক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া শুরু করলেন। ডাক্তারাও অরণ‍্যের এই নিষ্পাপ ভক্তির মধ্যে কোন অসঙ্গতি দেখতে পেল না। অরণ‍্যের মধ্যে রাধাভাব এতোই জাগ্রত হল যে বাড়ির আর পাঁচজনের সঙ্গে মিলিয়ে থাকা ওর পক্ষে আর সম্ভব হল না।তাই নিজের বাড়ি ছেড়ে আখড়ায় থাকা শুরু করল ও।
বাবা সব দেখেশুনে ওর সঙ্গে যোগাযোগ রাখা বন্ধ করে দিলেন। দিদিরাও বাধ্য হয়ে সবকিছু মেনে নিল।
ঐ আখড়া ছেড়ে এরপর অরণ‍্যের বাউন্ডুলে জীবন শুরু হল।ধীরে ধীরে বাড়িতে ওর খবর আসাও বন্ধ হয়ে গেল। ওর দিদিদের লেখাপড়া, বিয়ে থা সব ওকে ছাড়াই সময়ের নিয়মে ঘটে চলল। ছেলের কোনরকম
খবর না পেয়ে মা আড়ালে চোখের জল ফেলে আর ছেলের মঙ্গল কামনায় বিভিন্নরকম ব্রত পালন করতে থাকে। কদিন হল ওদের অঞ্চলে একটা যাত্রার দল এসেছে। সবার মুখে মুখে ফিরছে যাত্রায় সীতা
যে সেজেছে তার নাম। নিরূপা কোথার থেকে শুনে যাত্রার সীতাকে দেখতে গেল। বড্ড চেনা লাগছে মায়ের। মুখের গড়ন পুরো অরণ‍্যর মতো।কিন্তু এই নারী শরীরের মধ্যে কি করে অরণ‍্যের বাস হবে। সীতার অভিনয় যে করছে তার নাম তো ওরা বলল রাধা। যাত্রা শেষে নিরূপা উইংসয়ের পেছনে যেতে চাইলে ভলান্টিয়াররা বাধা দিল। বড় মেয়ে রীতা মায়ের সঙ্গে ছিল,ও বোঝাল-“মা,এখন কয়েকদিন তো যাত্রা চলবে,চল না আবার কাল দেখা করতে আসবে।” মেয়ের হাত ধরে সেদিনের মতো নিরূপা বাড়ি ফিরে গেল। এরপর থেকে নিরূপা রোজ আসত আর স্টেজের সীতার মধ্যে অরণ‍্যকে আবিষ্কার করার চেষ্টা চালাতো। এভাবে একদিন সীতার মধ্যে নিজের হারানো ছেলে অরণ‍্যকে উদ্ধারও করে ফেলল নিরূপা। কিন্তু মায়ের বিপত্তি এল অন‍্য দিক দিয়ে।অরণ‍্য কিছুতেই ওর সেই পুরোনো সত্তায় ফিরতে চায় না,ও বারংবার ওর মাকে বলতে থাকে-“মা আমি প্রকৃতই শ্রীরাধিকা হয়েছি,আমার এ রূপ তোমার সমাজ মেনে নেবে না।তাই আমাকে ঘরে রাখতে চেও না,এই যাত্রার দলই আমার জীবিকা নির্বাহের পথ,আমার বাসস্থান।তুমি আর তোমার অরণ‍্যকে পাবে না,এখন আমার নাম রাধা।” নিরূপাও চোখের জলে ভাসতে ভাসতে ঘরে ফিরে গেল। সবাইকে চমকে দিয়ে অরণ‍্যের বাবা এবার সটান উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নিল। নিরূপার সঙ্গে অরণ‍্যের কাছে এসে বলল-“তুই ঘরে ফিরে চল,আমি না হয় মনে করব আমার তিনমেয়ে।আর হ‍্যাঁ, তোকে রাধা নামেই ডাকব। এবার খুশী তো?চল মা বাড়ি চল।”
অরণ‍্য অবাক হলেও বাবার পাশে পাশে হেঁটে বাড়ি ফিরে চলল।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।