সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সোনালি (পর্ব – ৭০)

পুপুর ডায়েরি

যারা আমার পুরোনো ফেবু ফ্রেন্ড, তারা জানে, আমি এইখানে এসেছিলাম, যখন ডাক নাম ধরে ডাকার মানুষরা চলে গেলেন, সেই তখন।
সেই থেকে এই শব্দের উঠোনই আমার বাপের বাড়ী ।
এইখানেই সবাই : পুপু, পুপুদিদি, ওরে পুপু , বলে ডাক দেয় আর আমি আল্লাদে নিশ্চিন্ত হয়ে থাকি, আমার নিজের লোকেরা আছে জেনে।

এটা দুই হাজার উনিশ সালের গল্পেরা।
২০১৯ সালে ঢাকা শহরের অমর একুশের উদযাপনের আনন্দ ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনে, বইয়ের দোকানে আমার লেখা বইয়ের ছবি, আর সেখানকার পাঠকের হাতে আমার বই, এতে কী যে ভালো লেগেছে , বা ঢাকা বোর্ডের গর্বিত স্কলারশিপ পাওয়া ছাত্রী মা জননী, দীপালি মুখোপাধ্যায় দেব্যাকে কী ভাবে ছুঁতে পেরেছি, সে বলে বোঝাতে পারব না।

সে বছর কারাকোরামের অসাধারন নিঃশব্দ সৌন্দর্য থেকে বেরিয়ে ফিরে, শব্দের উঠোনে, বিজয়া দীপাবলির আদরে ফিরে এসে , তাই যুগসাগ্নিকের শারদ আনন্দে সব্বার সাথে গলাগলি। যুগসাগ্নিক পত্রিকায় প্রকাশিত হতে শুরু করেই ত গল্পেরা জমা হতে থাকলো।
সে যে কি আনন্দ!

ওদিকে, সেই রায়গঞ্জ থেকে জনপ্রিয় কবি, প্রিয় সখী, শর্মিষ্ঠা ঘোষ বই নিয়ে এসেছিল।
ভাবো!
শর্মিষ্ঠা আমার প্রথম ফেবু ফ্রেন্ড। তার সাথে, আলাদা গাঢ়তার বন্ধুত্ব।
সে বছর, চৈতন্য পত্রিকার শারদ গল্প সংখ্যায়, রইল আমার গল্প।

গল্পের গল্প নামে বই প্রকাশিত হল ঢাকায়।

ছোট্ট বেলা থেকে গল্পের নেশা। কেবলই মায়ের আঁচল ধরে ঘুরি, গল্প বলো, বলো না। বা’ মশাই লিখতে বসলে পিঠে উপুড় হয়ে থাকি, কি লিখছ, বল না গল্পটা। যত গল্পের শুরু সেই খানে।
সেই যে, একটা .. গল্প.. ছিল…..
ধ্রবপদ প্রকাশন বাংলাদেশ, প্রকাশ করেছেন এ গল্পদের। আমি আপ্লুত ।
এ সবের একেবারে শুরু, সাহিত্যের আংগিনায় আমার অন্যতম গুরুজন, কবি মৃণাল বসু চৌধুরীর হাত ধরে।
তিনিই আমার চেম্বারে নিয়ে এসেছিলেন সাংবাদিক সাহিত্যিক রীতা ভৌমিককে। আমার অক্ষরেরা বরাবরই মৃণালদার আদরের প্রশ্রয়ে বড় হয়ে উঠেছে। তাঁকে আমার প্রণাম।
রীতা এবাংলা আর ও বাংলার মাটিতে পাশে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে কেজো সম্পর্ক ছাড়িয়ে আত্মীয় হয়ে গেছে, কলকাতা আর ঢাকার বাড়ির লোকেরাও টের পায়নি। দুবাড়িতেই আমরা পারিবারিক।
সেই ভাবেই কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন ফিরোজ ভাই। কে বলবে, আমায় হোটেলে পৌঁছে দেবার মানুষটি এক জন গম্ভীর প্রকাশক?
এই এঁদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর যত্নেই তৈরী হচ্ছে গল্পের বই, ঢাকার পাঠকদের জন্য। তাঁদের ভাল লাগলে সবার এত কান্ড করা সার্থক হবে।

সেই দুহাজার চার থেকে তর্পণ করতে শেখা। আজ বসে ভাবছি।কি দিয়ে করে চলেছি তর্পণ।
সতিল গংগোদকং, তার সংগে বাবা মায়ের শেখানো এত অক্ষর আর এত প্রেম, সেও দিই তোমাদেরি।
অঞ্জলিতে পুপুসোনালির, “তস্মৈ স্বদা”।
২০১৯শে কিনা, সপ্তর্ষি প্রকাশন অফিসিয়ালি ফোন করে জানালেন, তাঁদের প্রকাশনায় আমার তিন নং বই, “৫০ শে প্রেম”, বিক্রি হয়েছে। বেশ কিছু পয়সা পাব,নিয়ে আসি যেন আপিসে গিয়ে।
আর “স্টেথোস্কোপের পান্ডুলিপি “,প্রথম সংস্করণ শেষ। দ্বিতীয় মুদ্রণ নিয়ে ভাবনা চিন্তা সুরু হয়েছে।
তা সে ত,ভাষানগর- এর সাহিত্য মন্ডলীর সম্মান ও পেয়েছে।
শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক অগ্রজ শ্রী সুবোধ সরকার এবং উজ্জ্বল কলমচি, সকলের প্রিয় সাহিত্যিক, বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় সেই আশ্চর্য দিনের কাণ্ডারি।

ভারি আল্লাদ হল প্রকাশকের ফোন পেয়ে । আর অবাক ও হলাম খুব।
আমার অক্ষরদের যে মানুষ এত আদর করবেন, এ কখনো ভাবিনি।

…..গেয়েছি গান যখন যত আপন মনে খ্যাপার মত…..
তাতে যে ওই মাত্রাহীনকে পুরিয়ে দেবার লোক বসে বসে মধু ভরে দ্যান,তাই টের পেলাম।
ভালবাসাই ত শিখেছি খালি।

মায়ের শুদ্ধ ভাষার বকুনি খাই উঠতে বসতে।
কান্ডজ্ঞানহীন।
পল্লবগ্রাহী।
এই শব্দগুলিই কপালে জোটে বেশির ভাগ সময়।
বিয়ের পর, আমার নতুন বর গম্ভীর হয়ে দরজা বন্ধ করে এভিয়েশানের ওপর পড়াশুনো করে। মা কি খুশীই না হন। বলেন, দেখছো। পড়ালেখা একে বলে।
তোমার মত ফাঁকিবাজ?
তারপরেই সেই শব্দটি এসে যায়। পল্লবগ্রাহী।
আমি বাবার বারান্দার নিরাপদ আশ্রয়ে পালাই।
মুখে কিছু বলার সাহস নেই।
সামনে ঝুলে মনে মনে বিড়বিড় করি।
কি খারাপ হয় পল্লবেই থাকলে? সবাই জিওট্রপিক হয়ে শিকড় গেড়ে মাটির তলায় চলে যাবে বুঝি? এই যে সামনেই শিউলি গাছের পাতার ডগায় প্রজাপতিটা ফুরফুর করে উড়ছে, পল্লবগ্রাহী তো। কোন দাম নেই ওর?

তাই আমি খালি ভালবাসতে শিখলাম।
এইটা সোজা। অনেক কোশ্চেন, শর্টনোট,সাজেশন লাগেনি।
বাবা একটাও চ্যাপটার শেখানো, কখনো মুখে বলে তো শেখাতেন না।
সবই গান হয়ে কান থেকে প্রানে চলে আসতো।
প্রেমে যে জল হয়ে গলে যেতে হবে,আর প্রেমধন মায়ের মতন, দুঃখী সুতেই অধিক যতন, সেও শুনি।
আবার এইযে পাতায় আলো নাচে,তাকেই বলে প্রেম, সেও শুনি।

তো সে বছর, সেই যে প্রেমের পাগলপনা,বতারি কিছু টুকরো, অবাক হয়ে দেখলাম, “আড্ডা এবং” এর আড্ডায় আমার প্রিয় তরুণ শিল্পী ভাস্কর পাল আর “আড্ডা এবং “ এর কর্ণধার, বিখ্যাত বাচিক শিল্পী, বান্ধবী, শর্মিষ্ঠা পালের মুখে কি মিষ্টি হয়ে বাজছে।
ভাস্কর ত শুরুই করেছিল অনুষ্ঠান আমার লেখা শব্দদের দিয়ে।
বুঝেছিলাম, প্রেম : তরুণ তুর্কীদের পছন্দ হয়েছে।
পরে বড়দের যারা সে অনুষ্ঠানে ছিলেন, মানে প্রিয় সাহিত্যিক যশোধরা রায়চৌধুরী,চৈতালি চট্টোপাধ্যায়, মৃনাল বসুচৌধুরী,সত্যপ্রিয় মুখোপাধ্যায়, এঁরা ও যখন খুশী হলেন এই “৫০শে প্রেম” বইয়ের প্রেমের শব্দে,খুব আনন্দ হল।

যুগসাগ্নিক-এর সম্পাদক প্রদীপ গুপ্তদার কাছে অবশ্য এ বই পৌঁছেছে, কারন তিনি কবি ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত, এবং যুগসাগ্নিক পরিবারের সবাই, লেখিকা নন্দিতা ভট্টাচার্যদির বাড়িতেই প্রকাশ করেছিলেন এ বইকে।
সেদিন বন্ধু, প্রিয় কবি,জয়া চৌধুরী, শর্মিষ্ঠা ঘোষ ও ছিল প্রেমের হাত ধরে।

তাই সপ্তর্ষি প্রকাশন বইয়ের জনপ্রিয়তা বলতেই মনে হল,তবে প্রেমই জিন্দাবাদ।

আমার অগ্রজ দুই সাহিত্যিক বিদিশা সরকার আর ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় এ বইকে আগেই সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন। সব মিলিয়ে প্রেমে থই থই চারদিক।
২৬ মে দুইহাজার চার সালের সন্ধ্যেয় বাবা মশাই, হাসি মুখে একটা লম্বা শ্বাস ফেলে নি:শব্দ হয়েছিলেন।
তাই তর্পণ করতে আঁজলা ভরা অক্ষর আর প্রেম নিয়ে বসলাম।
সেই শিল্পী মানুষটিকে বললাম, এইই দিলাম। আর ত কিছু পকেটে নাই।
তুমি যে আমার মহা-গুরু। তোমার কাছ থেকেই, খুদিগর্জি থেকে বে-খুদি তে পৌঁছে দেয় যে ভালবাসা,তাকেই বুঝি খুদা নামে ডাকে, এই বোধটুকু খালি কুড়িয়ে পেয়েছি। খুদ মানেই সেই তো? আমার প্রানের গভীর গোপন মহা আপন……
তাই সব সময় ঘুরে আসে সুর, তুঝ মে রব দিখতা হ্য,ইয়ারা ম্য ক্যা করুঁ?

সেই যে ছোট্ট বেলায় হো হো করে গান গাইতে শিখেছি,
“আকাশে দুই হাতে প্রেম বিলায়
বিলায় ও কে?
সে সুধা ছড়িয়ে গেলো লোকে লোকে…..”
এইসব লেখালিখির রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলার গল্প।

তার ফাঁকে, কর্তার সাথে চলে গেছিলাম অযোধ্যা পাহাড়ের গায়ে রিসোর্টে।
বাচ্চারা দু জনেই দূরে। পড়ায় ব্যস্ত। কলকাতায় মন টেকে না।
বসে বসে ডায়েরি লিখি।
……সন্ধ্যে নেমেছে এখন।
দুটো পাহাড়ের মাঝে বসে। চারদিকে জংগল। সামনে নদী।
বাঁশির আকুতি নেমে আসা অন্ধকারকে বলে যেও না, যেও না শপথ লাগে—
পুরুলিয়ার লাল মাটির গন্ধ, জংগলের নিজস্ব আওয়াজ আর নৈঃশব্দ, আরাম আনল শহরের চাপে ক্লান্ত ইন্দ্রিয়দের।
খড়িবেড়িয়া ইকো রিসর্ট।
অন্ধকারে এক কোনায় এক সাওঁতাল তরুণ আকুল করে দিচ্ছিল রাতের আকাশ বাঁশির মূর্চ্ছনায়।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *