T3 শারদ সংখ্যা ২০২২ || তব অচিন্ত্য রূপ || বিশেষ সংখ্যায় সুপর্ণা বোস

চিনি গো চিনি

 

দিদার হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে ঝিল্লি বলল,

_ও দিদুন, চলো না গো আমাদের সংগে।এতো করে বলছি!

সরমা ঝিল্লির হাতখানা নিজের মুঠোর মধ‍্যে ধরে বললেন,

_তোর দাদুনকে ফেলে কিকরে যাই বল দেখি?সবই তো সে ভুলে যায়।কিচ্ছুটি মনে রাখতে পারে না তো।

ঝিল্লি দেখল, কথা বলতে বলতেই দিদার হাসি মুখের ওপর হাল্কা বিষন্নতার মেঘ উড়ে এসে বসল।ঝিল্লি চট করে বললো

_তাহলে দাদুকেও নিয়ে চলো না সংগে করে?

সরমা ঝিল্লিকে আরেকটু কাছে টেনে তার থুতনি ছুঁয়ে আদর করলেন।

_তোর দাদু যে অসুস্থ।অসুস্থ মানুষকে নিয়ে কি আর কোথাও যাওয়া চলে রে দিদিভাই?

_দাদুন তো ঠিকই আছে।জ্বর কাশি কিচ্ছু নেই।তুমি দাদুকে অসুস্থ ভেবোনা দিদুন।দাদুন আর তুমি দুজনেই আমাদের সংগে চলো।

_তোদের বাড়িতেও তো তোর ঠাম্মা দাদুর বয়েস হয়েচে।তোর মা কি আর এতোগুলো বুড়োমানুষের দেখাশোনা করে পারে বল?

_আমি তো আছি আমি করে দেবো?ও দিদুন চল না দিদুন।

ঝিল্লি দিদার গলা জড়িয়ে ঝুলে পড়ে।

_তাহলে তুমি একাই চলো।বড়মামি ছোটমামা আর মিমিরা সকলে মিলে দাদুর দেখাশোনা করবে।

_তা তো করবে বুঝলুম।কিন্তু তোর দাদু কখন যে দরজা খুলে বেরিয়ে গিয়ে আর বাড়ি খুঁজে পাবে না তখন কি হবে বল দিকিনি? ওদের সকলেরই তো নিজের নিজের কাজ আছে ওরা কি আর তোর দাদুকে সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখতে পারে?

ঝিল্লির বড়মামার ছেলে বীনুও ক্লাস সিক্সেই পড়ে।দুটিতে যেমন ভাব তেমনি ঝগড়া।তো সেই বীনু হঠাৎ মুখ ভেটকে বলে ওঠে,

_এই খিল্লি, তুই আমার ঠামুকে নিয়ে চলে যেতে চাইছিস কেন রে?

ঝিল্লি চোখ পাকিয়ে বলল

_এই বীণকর না টিনকর।তুই চুপ করবি?

ওমনি বীণকর ডাঁয়ে বাঁয়ে মাথা দুলিয়ে আনুনাসিক সুরে টেনে টেনে বলল,

_ডাকিছে ঝিল্লি ঘ‍্যাংর ঘ‍্যাং…

ঝিল্লি ভয়ানক খেপে ওঠে।

_আমার নাম মোটেও ঝিল্লি নয়।আমাকে কেউ ওই নামে ডাকবে না বলে দিলাম। সকলেই আমাকে ঝিলিমিলি দাসগুপ্ত বলে ডাকবে।

তার কথার ভঙ্গিমায় সকলেই হেসে উঠল।

তাতে ঝিল্লি আরো বিরক্ত হল।ঝিল্লিকে রেগে যেতে দেখে সরমা বললেন

_ঠিকই তো, নামের বিকৃতি মোটেও ভাল কথা নয়। স্বয়ং রবিঠাকুর বলেছেন, মানুষ নিজের থেকেও নিজের নামটিকে বেশি ভালবাসে।

ঝিল্লি খুশি হয়ে বলল,

_ঠিক বলেছ দিদুন আমি ‘গিন্নি’ গল্পটা জানি।মা আমাকে পড়ে শুনিয়েচে।

সরমার উল্টোদিকের সোফার এককোণে বসেছিলেন তুষারকান্তি ।এতোক্ষণ একটাও কথা বলেননি।কেবল মিটিমিটি হাসছিলেন।দেখে মনে হচ্ছিল আড্ডাটা তিনি বেশ উপভোগ করছেন।তাঁর পরণে ধোপদুরস্ত পাজামা আর ফতুয়া।চুলগুলি পরিপাটি করে আঁচড়ানো।সবটাই সরমা করিয়ে দিয়েছেন।কারন তুষারকান্তি আজকাল আর কোনোকিছুই তেমন নিজে নিজে করতে পারেন না।এমন নয় যে তাঁর শরীর খুব খারাপ অথবা হাত পা নড়ে না।আসলে তিনি ইদানিং সব ভুলে যান।পরিচিত মানুষের নাম থেকে আত্মীয় স্বজনের মুখ।চেনা রাস্তা অথবা চেনা জিনিসপত্রও।কোন জিনিসটা কিভাবে ব‍্যবহার করতে হবে সবই তিনি বেমালুম ভুলে গেছেন।বাথরুমে গিয়ে ফ‍্যালফ‍্যাল করে চেয়ে থাকেন।বুঝতেই পারেন না যে বালতি থেকে মগে করে জল নিয়ে মাথায় ঢালতে হবে।অথবা চিরুনিটা হাতে ধরিয়ে দিলেও মনে পড়ে না যে সেটা দিয়ে আসলে কি করতে হবে।তাই তাঁর সব কাজ সরমাই মনে করিয়ে দেন।কখনো আবার নিজে হাতে কযিয়েও দেন।।ঠিক যেভাবে ছোট বাচ্চাকে সবটুকু করিয়ে দিতে হয়।তুষারকান্তিও তাই সরমাকে ছাড়া কেন জানি অসহায় বোধ করেন।তবু সরমাও তো মানুষ।তারও তো অসুখ বিসুখ আছে।মনমেজাজের মন্দভালো আছে! তাই বাড়ির সকলেই চায় তিনি বরং দিন কতক ঘুরে আসুন মেয়ের বাড়ি।মনটাও একটু ভাল হবে আর কটা দিন বিশ্রামও হবে।স্বামীকে ছেড়ে কোথাও যেতে মোটেও রাজি নন সরমা। মাস ছয়েক আগে তুষারকান্তি একবার তাঁর ছেলেবেলার ফরিদপুরের বাড়ি খুঁজতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন।বহু কষ্টে তাঁকে খুঁজে আনা হয়েছিল।সেই থেকে সরমা তাঁর গলায় কালো কারের মধ‍্যে একটি স্টিলের লকেট পরিয়ে দিয়েছেন।যার ওপর খোদাই করা আছে সরমার দশ ডিজিটের মোবাইল নাম্বার।যাতে তুষারকান্তি ঘরের বার হয়ে হারিয়ে গেলে কোনো সহৃদয় ব‍্যাক্তি সরমাকে ফোন করে জানাতে পারেন।এতে করে চমৎকার কাজও হয়েছে।পরপর দুবার এভাবেই তুষারকান্তিকে বাড়ি ফিরিয়ে আনা গেলেও সরমার নজরদারি আরো নিশ্ছিদ্র হয়েছে বৈ নয়।তা এ হেন মানুষকে ছেড়ে তিনি কোথাও গিয়ে শান্তি পাবেন না জানা কথা।

বেশ কয়েকবছর ধরে তুষারকান্তির ভুলে যাওয়ার বহর বাড়ছিল।কোনো নিকট আত্মীয়ের বিয়েতে গিয়েছেন, হঠাৎ একজন ভদ্রলোক এসে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলল,

_কিগো মেজমামা কেমন আছ? গতবছর অমুর বিয়েতে তোমার সাথে লাস্ট দেখা

তুষারকান্তি তার মুখের দিকে চেয়ে সাত পাঁচ কিছুই মনে করতে পারলেন না।সরমা তাড়াতাড়ি বললেন,

_ওমা কমল যে! তোমার বাবা মা মানে আমাদের কুমুদ জামাইবাবু আর মল্লিকা কেমন আচেন বল দেখি? কই তাদের তো দেকচিনে?

ব‍্যাস! কমল তুষারকান্তিকে ছেড়ে সরমার সাথে গল্প করতে লাগল। তুষারকান্তিও হাঁফছেড়ে বাঁচলেন।কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও মনে করতে পারলেন না কেই বা কুমুদ আর কে তার মল্লিকা।অথচ এভাবে তো আর দিনের পর দিন চলে না। বোঝা যাচ্ছে বিষয়টা আর পাঁচটা সাধারণ ভুলেটুলে যাওয়ার পর্যায়ে থাকছে না। এমন করে আবার মানুষ সব ভোলে নাকি? শেষে শহরের একজন নামীদামি সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো হল। তিনি বেশ কিছু পরীক্ষার পর সিটি স্ক‍্যান করাতে বললেন।জানা গেল তুষারকান্তির মস্তিষ্কের কোষগুলি ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাচ্ছে।অর্থাৎ সেল ডিজেনারেশন ঘটছে।তাই তিনি সব ভুলে যাচ্ছেন এবং এর নিরাময়ের কোনো নিদান না থাকলেও সঠিক সময় চিকিৎসা করলে অনেকদিন পর্যন্ত জীবনযাত্রার মান উন্নত রাখা সম্ভব।কারণ এই রোগী শেষ পর্যন্ত নিজেই নিজেকে চিনতে পারেন না।কাজেই এসব ক্রমশ বাড়তেই থাকবে।

ভুলে যাচ্ছেন বলেই তো আর একজন মানুষকে ঘরে বন্ধ করে রাখা যায় না।তাহলে তাঁর ভিতরে উদ্বেগ ও ক্রোধ বাড়বে বৈ কমবে না। অতএব তাঁকে যতদূর সম্ভব স্বাভাবিক জীবনে রাখতে হবে। ঝিল্লির দিদা এবং মামা মামি সকলের চেষ্টা করতে থাকলেন, দাদুর অসুস্থতাকে মাথায় রেখেও কিভাবে স্বাভাবিক জীবন দেওয়া যায়।নানা ধরনের কৌশল বার করতে চেষ্টা করলেন তাঁরা।তার একটা হল গলায় ফোননম্বর বা বাড়ির ঠিকানা লেখা লকেট পরিয়ে দেওয়া।

এদিকে দাদু নিয়ম করে খবরের কাগজ পড়েন।মাঝেমাঝে দিব‍্যি ছেলেবেলার গল্প করেন।বকফুলভাজা অথবা মানবাটা খাবেন বলে নিজেই বাজারের থলে হাতে বেরিয়ে পড়েন।ওমনি দিদা বাড়ির কারোকে পাঠান পিছুপিছু দাদুর অগোচরে।
_যদি নিজে পথ চিনে আসতে পারেন ভাল নচেৎ সংগে করে নিয়ে আসবে।শুধু দিদা কেন বাড়ির সকলেই দিদা লক্ষ‍্য করেছে, বাড়ির পরিবেশ আনন্দপূর্ণ স্বাভাবিক থাকলে দাদুও বেশ ভাল থাকেন।বাড়ির অনেকের খবর নেন,নাম ধরে ডাকেন এমনকি নিজে বাথরুম চিনে গিয়ে নিজে নিজে মগে করে জল নিয়ে স্নানও করতে পারেন।তাই বাড়ির সকলেই খেয়াল রাখে যাতে কোনোভাবেই দাদুর উদ্বেগ না বাড়ে। আপাতত বাড়িতে একমাত্র মেয়ে এবং নাতনি এসেছে।চিনতে পারুন চাই না পারুন দাদু কিন্তু মোটের ওপর প্রসন্ন আছেন।মেয়ে এবং নাতনিকে দিদা আগেই বারণ করে রেখেছেন
“বাবা আমাকে চিনতে পারছ?” জাতীয় কোনো কথা বলতে।

আজকের এই ঘরোয়া আড্ডার মধ‍্যে হঠাৎ দাদু বললেন,
_দিদিভাই আমাদের রাজকন‍্যা।
সকলেই একসংগে দাদুর দিকে ঘুরে তাকাল।দাদুর মুখে তখনো মৃদু হাসি।বীণকর তৎক্ষণাৎ বলে বসল
_হ‍্যাঁ ব‍্যাঙ রাজকন্যা।ঘ‍্যাংর ঘ‍্যাং…
ঝিল্লি মুখ হাত নেড়ে বলল
_বাই দি ওয়ে ঝিল্লি মানে ব‍্যাঙ নয়! ঝিঝিপোকো।নিজের বাংলাটা একটু ইম্প্রুভ কর রে টিনকর।
_ও তাহলে তো একদম বিইগব‍্যাং
নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে অস্থির হল বীণকর।
দাদু সব দেখেশুনে দিব‍্যি মিটিমিটি হাসছে দেখে বীণকর তার ঠাম্মার কানে কানে বলল
_দেখলে ঠাম্মু, দাদাই কেমন ঝিল্লিকে দিদিভাই বলে ডাকল আগের মত?
_তাইতো দেকলাম রে
_তাহলে দিদুন তুমি আমাদের সাথে শ্রীরামপুরে যাচ্ছ তো?
সকলেই সমস্বরে সায় দিল।ওনার একটু পরিবেশ বদল হওয়াও তো দরকার।টানা এতোগুলো বছর রোগীর সেবা করে চলেছেন তো। দিদার কিন্তু কড়া নিষেধ আছে, দাদুক রোগী বলা চলবে না। কারণ ডিমেনশিয়া কোনো শারীরিক বা মানসিক রোগ নয়।সময়ের সাথে মস্তিষ্কের কোষ ঝর যাওয়া। ডাক্তার বলেছেন, কখনো আবার মস্তিষ্কে একধরণের হলুদ থকথকে পদার্থ জমে যায়।যা আসলে একজাতীয় প্রোটিন।এই সমস‍্যা যেকোনো কারোরই বয়েসকালে হতে পারে।অতএব এটা একটা সমস‍্যা।সমস‍্যা যেমন আছে তেমন তার সমাধানও আছে। তো সেদিন কি হল, দুপুরবেলা খাওয়া দাওয়ার পর দাদু হঠাৎ বললেন
_ আমাকে এখুনি একবার ব‍্যাংকে যেতে হবে।একটা জরুরী সই বাকি থেকে গেছে।বুঝলে না
_কিই যে বলেন বাবা! আপনার কোথাও কোনো সই বাকি নেই
_তুমি কি আমার থেকে বেশি জানো?
ভীষণ রেগে গেলেন দাদু
_সেই তো।বড়বৌমা তুমি আর ওঁর কাজের গুরুত্ব বুঝবে?
দিদা চোখটিপে বড়মামিকে পাশেরঘরে নিয়ে গিয়ে বললেন,
_ওনার কথা কাটতে যেও না তাহলেই খেপে উঠবেন তারচে পাশের ফ্ল‍্যাটে রিমিকে গিয়ে বলো, একটা খাতা আর পেন রেখে দরজা খুলে রেখে দিতে।
তেমনই করা হল। দিদা দাদুকে রেডি করে নিয়ে গিয়ে রিমি আন্টির ঘরে গিয়ে সই করিয়ে আনলেন।দাদুও ব‍্যাঙ্কের জরুরী সইটা করে নিশ্চিন্ত হলেন।বাড়ি ফিরে শান্ত হয়ে বসলেন।

 

রাত্তিরের খাওয়া দাওয়ার পর সকলেই এসে ড্রইংরুমে বসেছে।দিদা দাদুর মশারি বাতিয়ে চারপাশে বালিশের পাহারা দিয়ে এসে সোফায় বসতেই ঝিল্লি আর বীণকর এসে গা ঘেঁষে বসল। দিদা তাদের মাথায় বিলি কাটতে কাটতে বললেন,
_তোমরা যে আমাকে রুমুর সাথে শ্রীরামপুরে যেতে বলছ?তা ওনার ওই এতো ঝক্কি তোমরা কি আর সামালতে পারবে? দ‍্যাখ না দ‍্যাখ ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে।খেয়ে বলেন খাইনি।স্নান করতে গিয়ে বাথরুম খুঁজে পান না।আলো পাখার সুইচ গুলিয়ে ফেলেন।এত শত ঝক্কি তোমরা সামলাতে পারবে তো?
দিদা সরাসরি তার বড়বৌমার মুখের দিকে তাকান কারণ দিদার পরে সেই ঘরের হাল ধরে থাকে।ছোটবৌমা কাজরী।তাকে এবাড়িতে সকলে কাজু বলে ডাকে। সে ইস্কুলে পড়ায়।সবে বিয়ে হয়ে এসেছে বছর খানেক।তার অভিজ্ঞতা কম তবু সে আগ বাড়িয়ে বললো
_মা, তুমি এতো চিন্তা করছ কেন বল তো?আমি তো এখন বাড়িতেই থাকব।ওয়ার্ক ফ্রম হোম করব।দিদিভাইয়ের সাথে আমিও বাবার দেখাশোনা করতে পারব
_এই তো! মা তোমার আর চিন্তা কি।কাজু আর বাদাম মিলে তোমার সব কাজ করে ফেলবে।তুমি কটাদিন আমার সংগে চলো দিকি ঘুরে আসবে।
_নিশ্চিন্তে ঘুরে আসুন মা।আপনার কাজুবাদামের পুষ্টিগুণ অনেক।
বড়বৌমার কথা শুনে আশ্বস্ত হলেন দিদা।ঠিক হল হপ্তা দুয়েকের জন‍্যে তিনি একমাত্র মেয়ে রুমুর বাড়ি শ্রীরামপুরে ঘুরে আসবেন।রাত বাড়লে সকলেই যে যার মত শুয়ে পড়ল।বিছানায় গিয়ে শুলেও দিদার কিন্তু মোটেও ঘুম এলো না।তিনি শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলেন কিভাবে বৌমাদের কাজ একটু সহজ করে দেওয়া যায়।

পরেরদিন সকালে দিদা ঝিল্লি আর বীনুকে দোকানে পাঠালেন।বললেন
_বইখাতার দোকান থেকে বেশ চওড়া দেখে একটা হলুদরঙের সেলোটেপের রিং নেবে আর দুটো বেশ বড় সাইজের লাল আর কালো রঙের টিপের পাতা।
সেলোটেপ আর টিপেরপাতা এসে পড়লে ঝিল্লি আর বীণুকে নিয়ে দিদা কাজে লেগে পড়লেন।প্রথমে কালোরঙের টিপগুলি এক এক করে ঘরে যত সিলিং ফ‍্যান আছে তার সুইচের ওপর সেঁটে দিলেন।আর লাল রঙের টিপগুলি সাঁটলেন বাড়ির সব আলোর সুইচের ওপর।আর দাদুর বেডসাইড টেবিলের কাচের নিচে একটা কাগজে একটা বাল্ব আর একটা পাখার ছবি এঁকে তাদের নিচে যথাক্রমে একটি লাল ও কালো টিপ আটকে দিলেন।তারপর বীনু আর ঝিল্লিকে বললেন হলুদ সেলোটেপটা দাদুর বিছানার নিচ থেকে সেলোটেপটা মেঝেতে আটকে দিতে হবে সোজা দাদুর ব‍্যবহৃত বাথরুম পর্যন্ত।যাতে কিচ্ছুটি মনে না রেখেও কেবল ওই হলুদ রেখা বরাবর এগিয়ে গেলেই দাদু প্রোয়োজনের সময় খুব সহজেই বাথরুমে গিয়ে পৌঁছতে পারেন।এমনকি বাথরুমে বালতির সাথে মগটিকে এমনভাবে বেঁধে দিলেন যে,মগে করে জল তুললেই তা সোজা গিয়ে পড়বে দাদুর মাথায়।এভাবে নিজেই স্নান সেরে নিতে পারবেন দাদু।যদিও যেসব কাজ উনি নিত‍্যদিন করেন সেসব কাজে ওঁর বড় একটা ভুল হয় না।আগামি দুদিন এইসব নতুন ব‍্যবস্থায় সড়গড় করানোর চেষ্টা চলল।

পরদিন সকাল সকাল উবর বুক করা হল।দিদা দাদুর কাছে বিদায় নিলেন।ঠাকুরঘরে প্রণাম করে বেরোনোর আগে বৌমাদের হাত ধরে বললেন
_তোমাদের বাবাকে দেখো।মানুষটাতো ইদান্তি একেবারে শিশুর মতই নির্ভরশীল হয়ে পড়েচেন…
বলতে বলতে দিদার গলা বুজে এলো।দিদা গিয়ে গাড়িতে বসলেন।দাদু বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেদিকে চেয়ে রইলেন।কিছু বললেন না।যদিও ইদানিং গিন্নিকে তিনি চোখে হারান।

বহুকাল বাদে মেয়ের বাড়ি এসে সমন্ধীদের সাথে দেখা হয়ে খুবই ভাল লাগল দিদার।মনটাও হাল্কা হল গল্প গুজব করে।আগে তুষারকান্তি যখন সুস্থ ছিলেন তখন উৎসবে পার্বণে বিবাহ ইত‍্যাদিতে বহুবার দুজনে এসেছেন এইবাড়িতে এবার প্রথম একা এলেন স্বভাবতই মনটা খারাপ হল একটু।বেয়াইমশায়ের স্বাস্থ্য ভেঙে গেলেও স্মৃতি অটুট আছে।অনেক পুরণো কথা বলতে লাগলেন তিনি।বেয়ানের অবিশ‍্যি বাতের ব‍্যাথার সাতকাহন চলতেই থাকে।দেখতে দেখতে কোথা দিয়ে একটা সপ্তাহ পেরিয়ে গেল।একদিন ছোটবৌমা কাজু কি কম্মে ক‍্যামনে রুমুর ফোনে ভিডিও কল করে তুষারকান্তির হাতে ফোন দিয়ে বলে
_বাবা, নিন মায়ের সাথে কথা বলুন।
রুমু ফোনটা মায়ের হাতে দিয়ে বলল
_নাও মা বাবার সাথে কথা বলো
সরমা দখলেন, মানুষটার যেন একটু চোখেরকোলে কালি, পরণের ফতুয়াখানাও তেমন ফর্সা নয়।তিনি নিজের মনেই ভাবলেন আহা বৌমারাইবা আর কত করবে।মানুষটাও তো কম বায়নাদেরে নন।তিনি স্বামীর মুখের দ্ধিকে তাকিয়ে বেশ জোরে বললেন
_ কেমন আছ?
তুষারকান্তি চুপ করে চেয়ে রইলেন।সরমা আবার বললেন
_বৌমাদের কথা শুনছ তো?সময়মত স্নান খাওয়া করছ ত?
তুষারকান্তি নির্বিকার।ছোটবৌমা কাজরী বলল
_ ও বাবা! বাবা। মাকে জিজ্ঞেস করো না, “তুমি কেমন আছ”?। ওও বাবা।
বারদুই বৌমার ধাক্কা খেয়ে তুষারকান্তি সরমার দিকে চেয়ে বললেন
_মাআআ তুমি কেমন আছোওও?
সরমা জিভ কেটে ফোনটা রুমুর হাতে ফেরৎ দিতে দিতে শুনলেন কাজু বলে উঠলো
_ এই রেএএ

সরমার মনটা কেমন করে উঠল, ভাবতে লাগলেন
কিজানি বাড়ি গিয়ে মানুষটা আমায় চিনতে পারবে তো?
ঝিল্লি এসে দিদাকে জড়িয়ে ধরলো
_ ও দিদুন, আমি জানি তুমি কি ভাবছ?
_কি ভাবছি দিদিভাই?
_তুমি ভাবছ তুমি যখন বাড়ি ফিরে যাবে তখন দাদু তোমায় চিনতে পারবে কিনা? রাইট?
_হ‍্যাঁ দিদিভাই।তুমি ঠিকই বলেছ
_তুমি একটুও চিন্তা কোরোনা দিদুন আমি সব ব‍্যাবস্থা করেই এসেছি
_কিরকম ব‍্যবস্থা করৃছ গো দিদিভাই?
সরমা নাতনির গলা জড়িয়ে কাছে টানেন।ঝিল্লি দিদার দুইগালে চুমু খেয়ে বলে
_আমি দাদুর বিছানার পাশে যে টেবিলটা আছে সেখানে আমি তোমার একটা বড় ফটো রেখে তাতে বড় বড় করে লিখে দিয়েছি ‘ দিদা’।দাদু রোজ দেখবে তাহলেই তোমাকে মনে রাখতে পারবে।
সরমা আঁতকে উঠে বললেন,
_ করেছ কি দিদিভাই? তুমি আমার ছবির নিচে দিদা বলে লিখে রেখে এসেছ?
এই বলে তিনি নাতনির গলা জড়িয়ে গলা ছেড়ে হেসে উঠলেন।।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।