গল্পতে সুনির্মল বসু

বিজনের সুখ দুঃখ
সে কখনো বাবার মুখ দেখেনি। কেননা, তাঁর বাবার মৃত্যুর তিন মাস বাদে তাঁর জন্ম হয়। মা মারা যান যখন, তখন তাঁর আড়াই বছর বয়স। বিজনের জীবনের শুরুর পর্বটা এমনই বেদনায় ভরা।
তখন সদ্য দেশভাগ হয়েছে।
বড় ভাই সুজন সবে কলকাতায় এসে চাকরি পেয়েছে। তাই কাকাদের সংসারে ছোট ভাইটিকে ফেলে না রেখে এখানে সংসার পাতবার কথা ভাবল।
বিয়ের রাতে নতুন বউকে বলল, আমাকে ভালবাসতে চাইলে, আমার সংসারটাকে ভালবাসতে হবে। আমার ভাইটাকে মানুষ করতে হবে।
নতুন বউ নিভা মনে মনে সেদিন হেসেছিলেন। ওকে দেওর ভাবার চেয়ে, ছেলে ভাবতেই ওর ভালো লাগছিল।
ছোটবেলায় মাকে হারাবার পর বিজন বৌদিকে বলতো, খাটের তলায় কলসির পাশে কে যেন আমায় ডাকছে।
নিভা বুঝতেন, ওর মা মায়া কাটাতে পারেন নি বলে বারবার ছেলের কাছে ফিরে আসতে চাইছেন।
সুজন এরপর ভাইকে স্কুলে ভর্তি করে দেন। বিজনের পড়াশোনায় তত মন ছিল না। পাখি ধরায় সে ভারী আনন্দ খুঁজে পেত। গ্রামের মধ্যে জামরুল, পেয়ারা পেড়ে আনায় তাঁর আনন্দ ছিল।
বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে মাছ ধরে তাঁর দিন কাটছিল। মাঝে মাঝে গাব গাছ থেকে পাকা গাব পেড়ে এনে, সে ভাইপোদের দিত। বাবার মত বড় দাদাকে সে মনে মনে ভারী সম্মান ও সমীহ করত।
উঁচু ক্লাসে পড়বার সময় সে দীপালি বলে একটি মেয়েকে ভালোবেসে ফেলে। দীপালি তাঁকে ভালবাসে কিনা, বিজন কোনদিন সে কথা জানতে পারেনি।
বড় হয়ে বিজন জানতে পেরেছিল, তাঁর বাবা ওপার বাংলায় শিক্ষকতা করতেন।
বাইরে থেকে বিজনকে উদ্ধত মনে হলেও, ভেতরে ভেতরে সে ছিল ভালবাসার কাঙাল।
দীপালির জন্য সে কতদিন ওদের বাড়ির পথে হেঁটে গেছে। দীপালি কখনো বিজনকে তাঁর প্রেমিক ভাবেনি। বিজন মনে মনে দীপালীকে বলেছে, যখন তোমার বিয়ে হয়ে যাবে, তখন আর আমি তোমাকে জ্বালাবো না। আমি যখন দূর দেশের যাত্রী হয়ে যাবো। তুমি যখন তোমাদের কবুতর ওড়া প্রাসাদে দাঁড়িয়ে পথ চলতি আমাকে দেখে বলবে, অবিকল তোমার ভালোবাসার মানুষটা চলে যাচ্ছে যেন।
বিজনের ভালোবাসাও অন্যরকম।
ও বাবা-মায়ের ভালোবাসা পায়নি। দীপালি বিয়ের পর ওর জীবন থেকে হারিয়ে গেল। এই বেদনা বুকে নিয়ে এসে বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে অন্যভাবে দুঃখ কষ্ট ভুলে যেতে চাইলো।
ওর বন্ধু ভাগ্য ভাল ছিল না।
বন্ধুরা বিজনের কাছ থেকে নিতে তৎপর ছিল, দিতে নয়।
বিজন ফাঁকা ধূ ধূ মাঠে গাছের সঙ্গে কথা বলতো। তখন পৃথিবীতে বড় একা ও। এই মাঠ এই গাছ এই পাখি বিশ্ব চরাচর ছিল তাঁর একান্ত আপনজন।
সংসারে হেরে যেতে যেতে সবার উপর রাগ দিয়ে পড়তে তাঁর। মনে মনে বলতো, এমন মরুভূমির মতো জীবন একা একা কাটানো যায় নাকি।
তবে বাড়ির মধ্যে তাঁর এই ভেঙে পড়া মনের ছবি ধরা পড়তো না। বাড়ির মধ্যে সে এক আশ্চর্য মায়াময় কিশোর। ভাইপো ভাইজিরা তার প্রাণ, তাঁর বুকের পাঁজর যেন।
ছোটবেলায় বিজন বৃষ্টির দিনে মাঠ থেকে ভিজে শালিক ধরে এনে বলতো, একে বাঁচাতে হবে।
ওদের ওখানে বিরাট করে দুর্গাপুজো হতো। যাত্রা,
সার্কাস, পুতুল নাচ, ম্যাজিক শো, আরো কত কি।
প্যান্ডেলে ঠাকুর এলে, অসমতল পথে ও ভাইপোদের নিয়ে ছুটতো, ওদের ঠাকুর দেখাতে।
একবার এক ডাক্তার ওর ভাইজিকে তিন মাসেও ভালো করতে না পারায়, বিজন ডাক্তারকে মারতে উঠেছিল।
ভাইপোকে পরীক্ষার সময় বিজন বলতো, তোর কোন কিছু অসুবিধা হচ্ছে না তো।
পড়াশুনো ভালো লাগেনি বিজনের কোনদিন। যদিও সে ভালোভাবেই মেট্রিক পরীক্ষা পাশ করে। চাকরি করতে করতে প্রি ইউনিভার্সিটি পরীক্ষা দেয়। বড় ভাই সুজন অফিসের বড় সাহেবদের বলে ওর জন্য একটা চাকরির ব্যবস্থা করে।
ক বছর বাদে বিয়েও দেয় ঈশিতা নামে একটি চাকরিরতা মহিলার সঙ্গে। অভাবী সংসারে সুজনের মনে হয়েছিল, দুজনে চাকরি করলে ওদের সংসার টা ভালো চলবে।
ঈশিতা সব বুঝে নিতে চাওয়া একালের মেয়ে।
সে বিজনকে বলে, তোমার এতদিনের চাকরির টাকা কোথায়, দাদার সংসারে আর থাকা চলবে না।
বিজন আলাদা সংসার পাতে।
ধার দেনা করে বাড়ি করে। ইশিতাদের বাড়ির লোকজন বলে, এ বাড়ি ইশিতার করা।
বিজনের ভালবাসার পৃথিবীটা এবার কোথায় যেন হারিয়ে যায়। মধ্যরাতে একাকীত্ব ওকে চেপে ধরে।
সারারাত ঘুম আসে না ওর। মাঝরাতে বিছানায় বসে কাঁদে ও।
আমার কেউ নেই। আমি বড় একা।
গাছের শিকল উপড়ে নিলে, গাছ বাঁচে নাকি।
মনে মনে বিজন বলে, আমাকে কেউ কখনো ভালোবাসে নি, আমার কোনো সত্যিকার বন্ধু কখনো ছিল না।
বিজন ভাবে এমন জীবন কাটানো বড় শক্ত। সে কখনো তারই ব্যথার কথা কাউকে বলতে পারেনি।
যদি বলতে পারত, তবে হয়তো ও বেঁচে যেত।
গতরাতে ওর মেয়ের ফোন আসে, আধঘন্টা আগে হাসপাতালে বাবা মারা গেল।
বিজন পাখি ভালবাসতো, গাছপালা ভালবাসতো।
অনেক অনেক জীবনী শক্তি ছিল তাঁর।
অথচ এত ভালোবাসা নিয়ে সে এখন বাতাস হয়ে দেশে দেশে ভেসে বেড়াচ্ছে।
ওর শব দেহের পাশে ওর বউ ঈশিতা বলছিল,
বর্ধমানের এক চাল ওয়ালা প্রতি সপ্তাহে বাড়িতে চাল দিয়ে যেত। গতকাল সেই চাল শেষ হয়েছে। গতরাতে ও চলে গেল।
ওর মেয়ে বলছিল, বাবার মুখের পাশ থেকে ফুলগুলো সরিয়ে দাও, বাবাকে আমি শেষবারের মতো একবার দেখি। ওই মুখটাকে সারা জীবন মনে রাখতে পারবো তো।
বিজনের আত্ম এখন কোথায়, জানিনা।
সে যেখানেই থাকুক, হয়তো মনে মনে বলছে, একটু ভালোবাসা পেলে, এই পৃথিবীটা আমার কাছে অনেক সুন্দর হয়ে উঠতে পারতো। এমন প্রেমহীন পৃথিবীতে একা একা কি করে থাকবো।
বিজন চলে গেছে কতদিন।
সংসারে কারো জন্য কিছু আটকায় না।
সব সময় মুখে হাসি, নায়কোচিত চেহারা ছিল তাঁর।
এত অল্প বয়সে তাঁর চলে যাবার কথাও নয়। জীবনের শুরুতে সেই সব প্রাণবন্ত দিনের কথা ভাবলে, বড় আশ্চর্য লাগে।
অনেক ভালোবাসা দিতে, অনেক অনেক ভালোবাসা পেতে বিজন এই পৃথিবীতে এসেছিল।
ভালোবাসার না পেয়ে, এক বুক বেদনা নিয়ে সে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছে।
সে এখন কোথায়।
নদীর পাড়ে, পাহাড়ের পায়ের কাছে, কোনো ঝর্ণা তলায়, নাকি কোনো সমুদ্র বন্দরে,
সে যেখানেই থাকুক, মানুষকে ভালোবাসা দিয়ে সে চলে গেছে, আলোকবর্ষের ওপারে হয়তো এখন আকাশের মেঘশিল্প দেখে, পাহাড় পেরিয়ে সে হয়তো মানুষের জন্য বৃষ্টি আনতে গেছে।
কেউ কেউ তাকে মনে রেখেছে। অনেকে হয়তো একদিন তাঁকে ভুলে যাবে।
সেই যে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন,
এই পৃথিবীতে সুখের পরমায়ু মাত্র এক বছর।