আগুন খাবার দিনেও তোমার মধ্যে জন্মাচ্ছিলো দীর্ঘ ছায়া
তুমি না জানতেই আশ্রয় দিয়ে ফেলছিলে ক্লান্ত সাপকে, পতঙ্গ ও বিষাদকে
আমিও কিছু জানতে পারিনি
দিঘির জলে ঢিল ছুঁড়ে ফেললে দেখি এখনও তো সমূহ বেঁচে আছি
পুনশ্চ: প্রবল বর্ষায় সেদিন গৃহে আসিল মা-হারা এক হরিণ
আমি না’হয় বোকা মানুষ
তবু তুমি কী একবারও চোখের দিকে তাকাতে পারো না?
একবারের জন্যেও কি উল্কাখচিত চাদরটি
ফেলে রেখে যেতে পারো না বিছানাটির পাশে?
এত উদাসীন তুমি?
তোমার মন কোথায় পড়ে থাকে?
সোনার হরিণ পেয়েছিলে তুমি?
পুনশ্চ: আমার অন্তরাত্মায় শবর নাচিতেছে, আমার রন্ধনকার্যে বড় বিঘ্ন ঘটে আজকাল
মৃতসঞ্জীবনী নদীটির পাশে আমার কুটিরটি ছিল
আমার রান্নায়, স্নানে এমনকী মদের গেলাসেও
একসময় টলটল করত মৃতসঞ্জীবনী জল
বিপন্নতার পূর্বাভাস ছিল নদীটির পাশের কুটিরে আমার
আমি শুনিনি
আমি বাঁধ দিতেও আপত্তি করলাম মেঘ আঁচিয়ে উঠে
আমি ঘোষণা করলাম আমি সম্রাট
আমি গরিলার মতো বুক বাজালাম শত্রুমিত্রের সামনে
আমি তপ্ত অঙ্গার নিয়ে খেলা করছি তখন
অথচ নদীরে নদী তুই আমায় খেলি?
স্বপ্ন দেখিনা বহুদিন
সেদিন বেতার অনুষ্ঠানে বললো গভীর ঘুমের কুয়ো থেকে স্বপ্ন ওঠে না
বাহ! কপিকলটির গায়ে যথেষ্ট শক্ত দড়িটি লাগিয়েছি
যে বালতিতে তুমি আমার জিওল প্রাণটি জিইয়ে রাখতে
সেটি আমি গায়ের জোরে ছুঁড়ে ফেলি অন্ধকার ধরিত্রীগর্ভে
মৃতসঞ্জীবনী নয়, খালি একটু তৃষ্ণা নিবারণ
আহ, আমার বড় তেষ্টা পায়
এই বয়েসেও বড় তেষ্টা পায় আমার
গভীর ঘুমটি থেকে আমি কী স্বপ্ন তুলতে আসি?
ঘুম আসে, ঘুম আসে
আমার চক্ষু মুদে যায়
আমার চক্ষু, আমার স্বপ্ন, আমার গভীরতম কুয়োটি
তোমাদের আমি ভালোবাসতাম একদিন
এখন তোমার স্নেহের মহীরুহটির ছায়া অবলম্বনে তৈরি
দীর্ঘ বাতিল উপন্যাসটিকে পুড়িয়ে ফেলব
পুনশ্চ: আমার প্রিয় কলমটি বন্যায় কোথায় যেন ভাসিয়া গিয়াছে
এত এত আঁধার যে পথ
ঘর ঠাহর হয় না, এমনকী ঠিকানা লেখা চিঠিটা পর্যন্ত অস্পষ্ট
একদণ্ড বসেছিলুম তোমার বাড়ি যাবার পথে
সেইটেই কী কাল হল?
কাঁটাঝোপ থেকে সাপ ডাকে
ধুতরো ফুল ডাকে, অবিশ্বাস্য শান্তির মতো সাদা দেখায় ফুলগুলি মেঘের তলায়
শ্মশানবন্ধু বিড়ি চায়, বটগাছটির লকলকে ঝুড়ি ঝোলে মাথার কাছে
সময় ঠাহর হয় না, কবে বেরিয়েছিলুম মনে পড়ে না
মনে পড়ে না আসলে কী জিজ্ঞাসা করতে যাওয়া তোমার কাছে
আমি কলমটিও খুঁজে পাচ্ছিনা
যে ভ্রমণকাহিনিটুকু লিখে রেখে যাব দশটি খণ্ডে
এসব কী তবে ভ্রমণ?
পোষাপাখি কখনো পরিব্রাজক হয়?
পুনশ্চ: রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করিতেছি
আরশিতে যেন মনে হয় রাঙাশাড়িটি ঝোলে
পেছনে তাকাই, কিচ্ছুটি নেই
আমার কৌমার্য খাবার তালে ঘুরে চলেছে পৃথিবী
আমার শিকড়টি কুরে খেয়ে যায় তাবৎ উইপোকা
গায়ে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে ঘুর্ণিজল
আমার আঙিনাতে হরিরলুট হয় প্রতিদিন
আমি কী শান্তি পাবো না?
তুমি তো রাজ্যজয়ের শেষে সম্রাজ্ঞী বসেছ নোনা হাওয়ার অট্টালিকায়
আমার যে সব গেল, সব গেল
অপরাহ্নের আলোয় সাজিয়ে রেখেছি ঝুড়িতে ঝুড়িতে সমস্ত বৃথা আয়োজন
তুমি কিনবে না?
না’হয় দু’পয়সা কমই নেব, তুমি কিনবে না আমার অস্তিত্বগুলোকে?
অন্য আরেকদিনে যদি আমি ঘোড়ায় চেপে তোমার রাজ্য লুঠ করি?
পুনশ্চ: বোধ হয় শরৎকাল আসন্ন, আমি টিকিলাম না
নির্জন বসে থাকি
আর আমার পাশটিতে সমস্ত বিষাদ বসে থাকে নিবিড় হয়ে
বসুক, যতদিন চায় ওরা বসে থাকুক
একদিন তো ওরা বুনোফুল হয়ে উঠবে অরণ্যে অরণ্যে
এই যে চিঠি, চিঠির সমস্ত শব্দ, এবং বলার কথা শেষ হয় না মেঘমহাদেশে
এরা কী কখনও রোদ পাবে?
শরৎকালের ঘন নীলরঙা শরবতের মতো রোদ?
এরা কী গ্রাম খুঁজে পাবে? কপাল, চিবুক, ওষ্ঠ, বুক?
খুঁজে পাবে এরা সমস্ত একদিন?
না পেলে আমার পাশে বসুক কিছুদিন
ঘ্রাণ পাই, খবর পাই, জলের নাম বদলে শিশির হয়ে যাবে অদূর ভবিষ্যতে
সাঁকো বদলে যাবে ফ্লাইওভারে, ডাকনামের বদলে
রাস্তার সিগন্যালে জ্বলবে স্মৃতিলন্ঠন
আমি দাঁড়িয়ে যাব, আর কেউ দাঁড়াবে না জানি
নিরুদ্দেশ সম্পর্কে একদিন ঘোষণা হবে
দিঘিতে কিছু পদ্ম ফুটেছে, দেখে যেও।