“ধর্ম এবং মার্কস” নিয়ে আলোচনায় সন্দীপ মুখার্জী

সন্দীপ মুখোপাধ্যায় যুক্ত ছিলেন ইতিহাসের অধ্যাপনার সাথে, বর্তমানে একজন পূজারী, আর তার পাশাপাশি চলছে সুগভীর পড়াশোনা আর লেখালিখি। ওনার স্বপ্ন হলো মহান ভারতীয় রাজরাজরাদের পুনঃমূল্যায়ন এবং প্রভূত কাহিনীর সৃষ্টির।
মার্কস ধর্ম প্রসঙ্গে সবিস্তারে কিছু লেখেননি। তবে বিভিন্ন রচনায় ধর্মপ্রসঙ্গ স্থান পেয়েছিল।এই সব রচনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলঃ ডেমোক্রিটাস এবং এপিকিউরাসের দর্শনচিন্তার মধ্যে তুলনা প্রসঙ্গে তার ডক্টরেটের নিবন্ধ( ১৮৪১),কন্ট্রিবিউশন টু দ্য ক্রিটিক অব হেগেল’স ফিলসফি অব ল ( ১৮৪৩),ইকনমিক অ্যান্ড ফিলসফিক্যাল ম্যানাক্রিপ্টস (১৮৪৪),থিসিজ অন ফয়েরবাখ( ১৮৪৫),জার্মান ইডিওলজি(১৮৪৬) এবং দ্য কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো (১৮৪৮)।
মার্কস মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী ছিলেন। মুক্তচিন্তায় অভ্যস্ত হওয়ার পথে একমাত্র ধর্মকেই তিনি সবচেয়ে বড় বাধা বলে গণ্য করতেন।ধর্ম তার কাছে একটা অবাস্তব বিষয়।মার্কস-এঙ্গেলস এলিট স্বার্থকেই সনাতনধর্ম ব্যবস্থার মেরুদন্ড বলে গণ্য করেন। তারা বোঝাতে চেয়েছেন যে, চিরাচরিত সম্পত্তি- সম্পর্ক থেকে যে শ্রেণী- দ্বন্দ্বের জন্ম হয় তাই হল যাবতীয় ধর্মীয় ভাবাদর্শের মূল।সুতরাং সাবেকি সম্পত্তি- সম্পর্কের অবসান ঘটালে ধর্মীয় ভাবাদর্শেরও স্বাভাবিক অবলুপ্তি ঘটবে। মার্কস- এঙ্গেলসের মতে, এ- কাজ সম্পন্ন করতে পারে কেবল কমিউনিস্ট বিপ্লব।
মার্কসের মতে,’ধর্ম হল আফিং’ এর মতো, মানুষকে নেশাগ্রস্ত করে থাকে। লেনিনের মতে, ‘ধর্ম হল এক ধরনের আধ্যাত্মিক মদ যেখানে পুঁজির দাসেরা তাদের মানবিক আকৃতি – প্রকৃতি ও সুন্দর সভ্য জীবনের দাবিকে ডুবিয়ে মারে’। মার্কসের মতে,মানুষকে ধর্ম সৃস্টি করে নি,মানুষই ধর্ম বা ঈশ্বরকে সৃস্টি করেছে।সুতরাং ধর্ম কোনোদিন সৃজনশীল শক্তি বলে বিবেচিত হতে পারেনা।সমাজের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দ্বারাই ভালো ও মন্দের ধারণা গড়ে ওঠে।ধর্ম সমাজের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা এক উপরিকাঠামো ছাড়া অন্য কিছু নয়।ঈশ্বরের আদেশ হতে ধর্ম ও নীতিশাস্ত্রের উদ্ভব বলে কোনো কিছু নেই,কারণ ঈশ্বরই মানুষ দ্বারা সৃস্ট।ধর্ম ও নীতিশাস্ত্র সমাজে জমিদার ও পুঁজিপতিদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে উপরিকাঠামো হিসাবে সৃস্ট বিষয়। সুতরাং,ধর্ম ও নীতিশাস্ত্র মধুর কথায় ভুলানোর কৌশল ও ধাপ্পা ছাড়া অন্য কিছু নয়।
মার্কসের এই মুক্ত চিন্তার উপর ভিত্তি করে কমিউনিস্টরা ভারতীয় সনাতনধর্মকে আক্রমন করে থাকেন। ভারতের জাতীয়তাবাদের ৯৮ শতাংশ ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ, তাই নিজেদের নাস্তিক প্রমাণ করার ছলে তারা এই জাতীয়তাবাদকে আক্রমণ করে থাকেন। তাহলে কি মার্কসের এই বক্তব্যের বিরোধিতা করার মতো কি কোনো যুক্তি নেই? আছে অবশ্যই আছে। চলুন আলোচনা করা যাক।
মার্কসের অভিন্নহৃদয় বন্ধু ফ্রেডেরিক এঙ্গেলস কিন্তু ধর্মের কল্পনাকে আগাগোড়া অযৌক্তিক বলেন নি। তার চিঠিপত্র থেকে জানা যায়, তিনি যখন ধর্মবোধের যৌক্তিকতা খুঁজতে আগ্রহী ছিলেন এবং তিনি তা পেয়েছিলেন মানুষের হৃদয়বৃত্তির মধ্যে। তিনি মন্তব্য করেছেন, মানুষের হৃদয়বৃত্তি যেহেতু বাস্তব, সেহেতু হৃদয়বৃত্তিসঞ্জাত ধর্মবোধও বাস্তব। এইজন্যই ‘outlines of a critique of political Economy ‘প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, প্রাক- ধনতান্ত্রিক যুগের স্বাভাবিক ধর্মচেতনা এলিটশ্রেনীর হাতে পড়ে নষ্ট হয়েছে। এই কথারই প্রতিধ্বনি শোনা যায় কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোতে, যেখানে মার্কস-এঙ্গেলস আক্ষেপ করেছেন এই বলে যে আত্মসর্বস্ব হিসাব- নিকাশের বরফজলে এলিটরা ডুবিয়ে মেরেছে ধর্মোন্মাদনার প্রশান্তদিব্য ভাবোচ্ছাসকে।
এঙ্গেলস একথা মানতেন যে, সমাজবিকাশের প্রাথমিক স্তরে মানুষের কাছে ধর্মীয় ধ্যানধারণার একটা বিশেষ ভূমিকা ছিল। Dialectics of Nature ( 1873) এবং Anti Duehring (1878) গ্রন্থে তিনি দেখিয়েছেন, মানুষের বিজ্ঞানচেতনা যখন অপরিণত ছিল তখন সে জাগতিক ঘটনার জাগতিক ব্যাখ্যা দিতেও অপারগ ছিল। সমাজবিকাশের এই স্তরে মানুষ অতিপ্রাকৃতের দ্বারস্থ হয়েছিল।এককথায় ইহজাগতিক ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে গিয়েই মানুষ ধর্মীয় ধ্যানধারণা তথা ঈশ্বর- কল্পনার আশ্রয় নেয়।ইহাকে তিনি স্বতঃস্ফূর্ত ধর্ম বলেছেন। নিগ্রোদের ভক্তিবস্তুপূজা বা আর্যদের সাধারণ আদিম ধর্ম এর অন্যতম উদাহরণ। এর বিপরীতে রয়েছে কৃত্রিম ধর্ম যার উদাহরণ হল নবীন খ্রিষ্টধর্ম। স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মের বিশেষত্ব হল এই যে, কোনওপ্রকার সামাজিক প্রতারণার উদ্দেশ্যে তার উদ্ভব হয়না।কিন্তু কৃত্রিম ধর্ম শ্রেণীদ্বন্দ্ব- ভিত্তিক সমাজে আবির্ভাবের কারণেই সামাজিক প্রতারণা ও ছল- চাতুরির আশ্রয় নেয়।তার ফলেই জন্ম নেয় ভ্রান্ত চেতনা। তাহলে দেখা যাচ্ছে এঙ্গেলস আর্য ধর্মকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন এবং তার বিপরীতে কিছুই বলেননি। উল্টে এই ধর্মকে স্বতঃস্ফূর্ত বলেছেন।
আসলে মার্কস ধর্ম ও নৈতিকতা সম্পর্কে এই বিকৃত ধারণার অধিকারী হয়েছিলেন জার্মান ফিলোসোফার ফয়েরবাখের ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন করে, যেখানে ঈশ্বরকে মনুষ্য সৃস্ট বলে বর্ণনা করা হয়েছে। মার্কস ধর্ম ও নীতিশাস্ত্রকে অব্যয় বলতে নারাজ।কিন্তু নীতিশাস্ত্র অব্যয় ও চিরন্তন। মানুষ যদি মার্কসের মতানুযায়ী যৌনক্ষুধা ও ভৌতিক প্রয়োজনের অধিকারী জৈবপ্রাণী বলে বিবেচিত হয়ে থাকত,তাহলে তার কাছে ধর্ম সম্পূর্ণভাবে অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হত।কিন্তু সমগ্র পৃথিবীতে মনুষ্যসমাজে তা সম্ভবপর হয় নি।এমনকি সমাজতান্ত্রিক সাম্যবাদী রাশিয়া ও চীন হতেও ধর্ম বিলুপ্ত হয় নি।ধর্ম ছাড়া মানুষকে পরম শান্তি আর কোনো কিছুই দিতে পারেনা। এ প্রসঙ্গে ফিশারের বক্তব্য, ” শোষিত ও বঞ্চিত মানুষরা ধর্মীয় আবেগের মাধ্যমেই তাদের জীবনের ব্যর্থতাজনিত দীর্ঘশ্বাস ফেলে এবং মুক্তির পথ খোঁজে……..”” Man is something more than a biological being ; he has a spiritual side on account of which he is akin to God ; nay,a spark of the Divine fire.” শুধু তাইই নয়,মানুষের মধ্যে আধ্যাত্মিক ধারণা বিরাজ করে বলেই মানুষ মানুষসহ সমস্ত সচেতন বা বোধক্ষম জীবকেই ভালোবাসতে পেরেছে নিজের মূল্যবান জীবনের বিনিময়ে।
তত্ত্বগতভাবে মার্কসবাদ ধর্মকে পরিত্যাগ করলেও কার্যত যে আবেগ সৃস্টি করেছে তা কম ধর্মীয় নয়।এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক হলওয়েলের মন্তব্যটি স্মরণীয় ঃ “In theory Marxism rejects religion but in practise the passion which informs it is religious in character……………. God Marx substitutes Historical Necessity for the chosen people, the proletariat, and for the Messianic kingdom, the Realm of Freedom.
গ্রন্থসূত্র – The Historical Experience of the Dictatorship of the proletariat : Hill,christopher.
রাজনীতি ও প্রশাসন : ডক্টর অমল কুমার মুখোপাধ্যায়।
ডক্টর ভোলানাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। (p- 34- 36)
পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাস :ডক্টর সুভাষ চন্দ্র সোম -( p- 176- 177)
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।