সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায় (পর্ব – ৩৪)

ইচ্ছামণি

পর্ব ৩৪

আলমারির লকার থেকে পাথরটা বের করতে গিয়ে বুকটা ধক্ করে উঠল; তারপর খালি হয়ে গেল। কোথায় গেল আঙুর রঙা ইচ্ছামণি? আলমারি বন্ধ করে চাবি যথাস্থানে রাখতে ভুলে গিয়েছিল। চাবিটা আলমারির গায়েই ঝুলছিল। কী হবে? কান্না ঠেলে আসছিল। চাবিখানা ড্রেসিংটেবলের ড্রয়ারে রাখতে গিয়ে দেখে সবজে পাথরটা নেহাৎ খোলামেলা ভাবে পড়ে আছে সেখানে। চোখ মুছে পাথরখানা দেখাল অতীনকে।
“এই হল আমার ইচ্ছামণি। এর জিন বল কি পেত্নীই বল, আমার সংসার পাকা হাতে সামাল দিচ্ছে। আমি আগের মতোই বই, শব্দছক, সুডোকু আর ঘুম নিয়ে আছি। শুধু গুবলুকে পড়ানোটা ওর হাতে ছাড়িনি।”
প্রতিশ্রুতি ভুলে মুখ ত্যারছা করে হেসে উঠল অতীন। সব বৃত্তান্ত শোনার পরও রসিকতা থামল না। “পাথরটাকে যেখান সেখান না রেখে তোমার ইচ্ছামণিকে বল সোনার চেনে বাঁধিয়ে দিতে, তারপর তোমার গলায় পরে নাও। তাহলে হারানোর ভয়টাও কম থাকবে, আর ওও তোমার সঙ্গে সঙ্গে থাকবে সব সময়।”
“ওসব টাকা পয়সা সোনাদানা দিতে পারবে কিনা জানিনা। কাজ করে দেয় এই পর্যন্ত।”
“জিন যখন, তখন সবই পারার কথা। সোনার গয়না থেকে ভালো হাউসিং কমপ্লেক্সে ফ্ল্যাট – মানে যা তোমার শখ আর আমি পুরণ করতে পারছি না। পাথরের পেত্নী যখন, যা যা চাইবে তাই তাই তো পেয়ে যাবে। ইস্! কী বোকা! শুধুমাত্র রান্নাবান্না আর ঝাড়পোঁছ করিয়ে রেখে দিয়েছ?”
“দেখো পাথরটা আমি পেয়েছি। ও কী পারে না পারে তা আমার বেশি জানার কথা। আমি তো বাড়ির কাজ করিয়েই খুশি আছি। ইচ্ছা আজ পর্যন্ত আমায় কী কী কাজ করতে হবে সেটুকুই জানতে চেয়েছে আর নির্দেশ মতো কাজ করে দিয়েছে। বেশি লোভ করলে যদি চলে যায়? তখন সোনার ডিম পাড়া হাঁসের পেট কেটে ফেলার মতো আফসোস হয়ে না?”
“উপার্জন করাটাও তো একটা মস্ত কাজ। তোমার লসে রান করা শেয়ারগুলোকে রোজ কেনা বেচা করে লাভ পাইয়ে দিক না, অ্যাট লিস্ট তোমার লোকসানটা তো কমিয়ে দিতে পারে”।
“এই আইডিয়াটা কিন্তু মন্দ নয়। এই কদিন আরামসে রিল্যাক্স করে শেয়ারের চিন্তাটা মাথা থেকে একেবারে বেরিয়ে গিয়েছিল। আমার লেখাগুলোরই হিল্লে করার কথা বলতে পারি। সেগুলোও তো কাজ, অনেক বেশি ইম্পর্টেন্ট কাজ। কিন্তু তুমি চান্স পেলেই আমার শেয়ারে ইনভেস্টমন্টের কথা তোল কেন বল তো?”
“তুমি যেমন চান্স পেলে, চান্স দিতেও হয় না, কথা তৈরি করে আমার ফ্যামিলির কাঁথা কাচতে বসো।”
“ঐ গন্ধযুক্ত গদ্ধড় কাঁথা কাচতে আমার বয়েই গেছে। জানো তো লোডশেডিং হলে আর কারেন্টের অপেক্ষায় সাবানে ভেজা ময়লা কাপড় নিয়ে বসে ধাকতে হয় না। ইচ্ছামণি সব কেচে দেয়। ও যা কাজ করে, কোনও কাজের লোক তা করবে না। সেই কাজের মনিটরি ভ্যাল্যু কম নাকি?”
“তাহলে তুমি মাসে মাসে হিসাব করে আমার কাছ থেকে ওর মাইনে বাবদ কিছু নিয়ে রাখো। তোমাকে টাকা দিলে জমবে আমি জানি, যদি না শেয়ারে লাগিয়ে দাও।”
“আবার? এই যে বললে ইচ্ছাকে দিয়ে ইন্ট্রাডে ট্রেড করে প্রফিট করতে। সিগনিফিকেন্ট প্রফিট করতে হলে তো ইনভেস্টমেন্টটাও সিগনিফিকেন্ট হতে হবে। কিন্তু যা ঝাড় খেয়ে বসে আছি, তাতে জিনিকেও ভরসা করতে পারছি না। সেও না লোকসানের বোঝায় শাকের আঁটি ফেলে। হয়তো দেখব শাক নয়, বদলে বড় বড় খড়ের আঁটি ডাম্প করতে শুরু করেছে। কিন্তু তুমি তো টাকা পয়সা নিয়ে একদম ভাবতে না। আমার তুচ্ছ সেভিংস্‌ নিয়ে তো গত বারো বছর ধরে ঠাট্টা বিদ্রূপই শুনে গেলাম। দেখেছি তোমার আর তোমার মায়ের.. ও স্যরি, আবার ঐ কথা তুলছি। কিন্তু তুমি সুজয়কে ফেবার করার জন্য কতগুলো অলাভজনক এলআইসি ছাড়া আর কোনও সঞ্চয় তো করতে চাওনি। ব্যাটা এমন সব পলিসি এমন গছিয়েছে, যেগুলোর সাম অ্যাশিওরড-এর চেয়ে টোটাল প্রিমিয়াম পেয়েবল অনেক বেশি। সুজয়ের চেয়েও ওর বস ঐ ডিও অনন্তটা বেশি বজ্জাত। বেশি রিটার্নওয়ালা পলিসিগুলো ডিটেইলিং করেইনি। সুজয় বছরে আমাদের এত টাকা লাইফ ইন্সিওরেন্সের পেছনে গুঁজিয়েও আবার পলিসির জন্য ঘ্যান ঘ্যান করে সেদিন আরও একটা বাজে পলিসি তোমার ঘাড় মটকে গছিয়ে দিয়ে গেল।”
“আমার মায়ের পরেই কি সুজয়? ছেলেটাকে তুমিই বাড়িতে ডেকেছিলে। এখন তুমিই সহ্য করতে পারো না!”
“তোমার মা আমার শাশুড়ি, আর ঐ সুজয় আমার সতীন। সত্যি ঐ মহাজনকে বাড়িতে ঢুকতে দেখলে এমন প্যালপিটিশন হয় যা তোমার সঙ্গে কোনও পরমা সুন্দরী মহিলাকে দেখলেও হবে না – হিঃ হি হিঃ…”
যাক, আলোচনাটা শেষমেষ হাসি মস্করার দিকে এগোচ্ছে, ঝগড়ার বাঁক নেয়নি।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।