“কি চায় ও” ধারাবাহিক বড়ো গল্পে সায়নী বসু (পর্ব – ৫)

সদ্য ফিজিওলজি তে মাস্টার্স করে উঠেছে সায়নী বসু। ছোটবেলা থেকে নাচ গান আর সব রকম গল্প উপন্যাস নিয়ে চর্চা করতে ভালোবাসে। তবে ভৌতিক সাহিত্যের ওপর ঝোঁক চিরকালই বেশি। কয়েক বছর নিজেও লেখালিখি শুরু করেছে। পাঠক পাঠিকাদের ভালোলাগাই তার প্রেরণার উৎস।
– আমি এখন কিছু প্রমাণ করার মত অবস্থায় নেই, শুধু আমার ছেলেটাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিন, আমার ছেলেটা…
কান্নায় ভেঙে পড়ে পিয়ালী। ঠিক তখনই বাড়ির ভিতর থেকে একটি মহিলা তাদের সামনে বেরিয়ে আসে এবং ওই ভদ্র লোক কে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
– তুমি সব কিছু জেনে শুনে ওনাদের এভাবে ভুল কেনো বোঝাচ্ছো?
– আহ্ সান্তা তুমি কেনো এখানে এলে? ভিতরে যাও। আমি তোমায় বারণ করেছিলাম তো..
– তুমি বারণ করলেও শুনবো কেন? দেখছ না এনাদের কত বড় বিপদ? সন্তান নেই বলে কি সন্তান হারানোর কষ্টটাও বুঝিনা?
– আহা এতে আমাদের কি করার আছে? এসব কি আমার দোষ নাকি? আর ওসব আত্মা তাত্মা বলে কিছু হয় না, সব বুজরুকি।
– এত কিছু ঘটে যাচ্ছে, একটা সংসার তো নষ্ট হল আর একটা নষ্ট হতে চলেছে, তুমি তাও বলছ সব বুজরুকি? আমি ওনাদের ও সাহায্য করার চেষ্টা করেছি এনাদের ও করব।
মহিলার সাহায্যের কথা শুনে পিয়ালীর মনে একটু আশার আলো জাগে। ভদ্রলোককে কোনো পাত্তা না দিয়ে সে সোজা ওই মহিলার দিকে এগিয়ে তার হাত দুটি ধরে আকুতি করে বলে
– প্লিজ যা পারেন সাহায্য করুন। আমি যে কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিনা। আমার ছেলে টা..
– কেঁদোনা ভাই আমি তোমায় একজনের কাছে নিয়ে যাচ্ছি এখুনি চলো, তিনি নিশ্চই তোমাদের সাহায্য করবেন।
– কে? কার কাছে?
– একজন আছেন, তিনি এইসব নিয়ে অনেক সাধনা করেছেন অনেক কিছু জানতে পেরেছেন। ঠিক তান্ত্রিক বলা যায় না ওনাকে তবে কম কিছু নয়, গেলেই বুঝতে পারবে।
মহিলাটি যখন এইসব কথা পিয়ালী কে বলছিল তখন ওনার স্বামী মানে মালিক ভদ্রলোক টি নিচু স্বরে রৌনককে বলে
– কি হে আপনিও এসব বিশ্বাস করেন নাকি?
– না মানে।
একটু তোতলায় রৌনক।
– তাহলে এসবে জড়াবেন না। বারন করুন আপনার স্ত্রী কে।
রৌনক সত্যিই এসবে বিশ্বাস করতোনা। তার মন ও সায় দিচ্ছিলো না। কিন্তু ছেলের কথা মনে করে ও পিয়ালীর করুন মুখের দিকে তাকিয়ে সে কিছু বারণ ও করতে পারছিলো না।
– চেষ্টা করে দেখি না। যা ক্ষতি হওয়ার হয়েছেই। ভালো না হোক এর থেকে বেশি ক্ষতি তো আর কিছু হতে পারেনা।
রৌনকের থেকে এমন উত্তর টা যেন আশা করেন নি ওই ভদ্রলোক। তাঁর মুখ টা ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যেত যে তাতেও রয়েছে ভয়ের চিহ্ন। কিন্তু রৌনকের তখন সেসব খেয়াল করার মত পরিস্থিতি নেই। স্তিমিত কণ্ঠে ভদ্রলোক বললেন,
– বেশ তবে যা ভালো বোঝেন করুন ।
****
মিস্টার অসীম ত্রিপাঠী – দরজার পাশে নেমপ্লেটে এই নাম টুকু লেখা। সান্তা দেবীর সাথে রৌনক ও পিয়ালী তখনই গেছে সেই ব্যক্তির বাড়ি যেখানে সাহায্য পাওয়া যেতে পারে। দুতিন বার বেল বাজাতেই দরজা খুলে গেল, বেরিয়ে এলো এক লম্বা সুঠাম দেহের, মুখভর্তি পাকা গোঁফ দাড়ি ওলা বয়স্ক ভদ্রলোক।
– একি সান্তা তুই?
– হ্যাঁ দাদা এক বিশাল বিপদে পড়ে তোমার কাছে এসেছি, সেই ফ্ল্যাট টা, ওই ফ্রিজে বাচ্ছা টা…
পুরো কথা শেষ করতে না দিয়েই অসীম বাবু ভ্রু দুটো একটু কুঁচকে বলে ওঠে,
– যা বলার ভিতরে এসে বল। আপনারা ও আসুন।
রৌনক ও পিয়ালী সান্তা দেবীর পিছন পিছন ঢুকতে ঢুকতে দেখলো অসীম বাবু তাদের পা থেকে মাথা অব্দি ভালো করে দেখছে, বিশেষ করে পিয়ালী কে, রৌনকের বিষয় টি পছন্দ না হলেও সে আর প্রতিবাদ করলো না। সান্তা দেবী ও পিয়ালী মিলে অসীম বাবু কে আবার সব ঘটনা সবিস্তারে বলতে লাগলো। সব শোনার পর বেশ গুরুগম্ভীর গলায় অসীম বাবু বললেন,
– বুঝলাম, বিপদ তো মাথার ওপরে উঠে নাচছে। আমি বলেছিলাম না এভাবে বেশিদিন আটকে রাখা যায়না। ওরা যা চায় সেটা নিতে ওরা ফিরে ফিরে আসে।
– মানে? ওরা কারা? ফিরে আসে মানে? আমি তো আপনার কথা মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝছিনা।
রৌনক উচ্চস্বরে বলে ওঠে।
– আস্তে আস্তে, এত উত্তেজিত হবেন না। সব বলছি আমি বুঝিয়ে। তবে আপনি বিশ্বাস করবেন কি করবেন না সেটা আপনার ওপরই নির্ভর করবে। ওরা মানে আত্মারা। তারা ততদিন শান্তি পায় না যতদিন না তাদের অভীষ্ট সিদ্ধ হচ্ছে। ওরা কি চায় তা ওরাই জানে। তবে আমাদের উচিৎ সেটা তাদের পাইয়ে দিয়ে তাদের শান্তি দেওয়া। জোর করে আটকালে তারা কিছু সময়ের জন্য থেমে থাকলেও আবার সুযোগ মত ফিরে আসবে নিজের কাজ সম্পূর্ণ করতে।
অসীম বাবুর কথা গুলোয় কিছু একটা ছিল যা ঘরটার মধ্যে এক অন্যরকম পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। সবাই চুপ করে ওনার কথাগুলো শুনছিল। কারুর মুখে কিছুই আসছিল না মনে যত প্রশ্নই আসুক না কেন। এমন কি রৌনকের মত যুক্তিবাদী মানুষ ও কোনো প্রশ্ন করতে ভুলে গেছে। তবে সান্তা দেবী নিস্তব্দতা ভাঙেন।
– এটা তো খানিকটা আমার স্বামীর দোষেই হয়েছে। লোভে অন্ধ হয়ে যায় ও মাঝেমাঝে কোনো দিকে জ্ঞান থাকেনা। এ্যাপার্টমেন্ট এর কাজ টা সময় মত শেষ না করতে পারলে যাদের থেকে অ্যাডভান্স নিয়ে রেখেছিল তারা এসে ঝামেলা করতো। তাই ইলেকট্রিকের কাজ টা কোনোরকমে করেছিল এটা ও নিজে আমায় বলেছিল।
– আঃ চুপ চুপ। তোকে বলেছি না এসব কথা আস্তে বলতে। বাতাসের ও কান থাকে। কোন কথা কোত্থেকে কোথায় কে শুনে নেবে তা তোরা জানিস না।
অসীম বাবু যেন একটু রেগে গিয়েই বলেন সান্তা দেবী কে। সান্তা দেবী গলার স্বর আরো আস্তে করে ছল ছল নয়নে বলতে থাকেন,
– এটা কয়েক বছর আগের কথা। আপনারা যে ফ্ল্যাটে উঠেছেন সেখানে আগে আপনাদেরই মত এক দম্পতি তাদের শিশু কে নিয়ে থাকতেন। শুনেছিলাম খুব সুখেই ছিল তারা। তবে হঠাৎ করেই তাদের জীবনে এক অঘটন ঘটে যায়। তাদের বাচ্ছাটি মারা যায় মর্মান্তিক ভাবে। কিন্তু মৃত্যুর পরেও সে তার বাবা মা কে বিশেষ করে মা কে ছেড়ে যেতে চায়না। তার আত্মা ঘুরে বেড়াতে থাকে ওই ফ্ল্যাটেই। তাই ছেলে চলে যেতেও বাচ্ছাটির মা এর আচরণে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেলো না। আগেও যেমন সারাক্ষণ ছেলের সাথে কথা বলত, খেলতো, খাওয়াতো সেসবই করত। কেউ এই বিষয়ে কিছু বলতে গেলে তার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে চলে যেত। কিন্তু যারা এসবে বিশ্বাস করেন তারা অনেকেই বুঝতে পারছিলেন কি হচ্ছে এবং সেই কথা বাচ্ছা টার বাবা কে তারা জানায়।
বাচ্ছাটার বাবা প্রথমে বিশ্বাস করতেন না, ভাবতেন পুত্র শোকে ওনার স্ত্রী ওরকম করছেন। কিন্তু পরের দিকে তার মনেও সন্দেহ জাগতে লাগলো। উনিও কারুর অস্তিত্ব টের পেতে লাগলেন। তখন উনি সিদ্ধান্ত নিলেন ওই ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে যাবেন। যদিও স্ত্রী কে কিছু জানালেন না।
– তারপর একদিন ঘটলো সেই ঘটনা টা। ওই ভদ্রলোক ঘুরতে বেরোনোর নাম করে নিজের স্ত্রী কে নিয়ে আমাদের বাড়ি এলেন আমার স্বামীকে ফ্ল্যাট টা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত টা জানাতে। ভাগ্যক্রমে অসীম দা সেদিন আমাদের বাড়ি গেছিলেন। আমরা ভিতরে বসে গল্প করছিলাম তখন আমার স্বামী যখন বাইরের ঘরে ওদের সাথে কথা বলতে গেলেন। হঠাৎ এক পরিত্রাহি চিৎকার শুনে আমরা বাইরের ঘরে ছুটে যাই। গিয়ে দেখি ওনার স্ত্রী আমার স্বামী কে মাটি তে ফেলে গলা টিপে ধরেছে আর উনি বাঁচাতেও পারছেন না, ছাড়ানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হচ্ছেন। আমি তখন ছুটে এগোতে যাচ্ছিলাম কিন্তু দাদা বললো ওভাবে হবেনা, তাড়াতাড়ি গঙ্গা জল নিয়ে আসতে। আমি কি হচ্ছে কিছু না বুঝেও দাদার কথা শুনে গঙ্গাজলের গোটা ডিবে টা নিয়ে চলে আসি তাড়াহুড়ো করে। ওই দৃশ্য দেখে ভয়ে আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেছিলো, তখন আর মাথায় কিছুই আসছিল না। আমার হাত থেকে ওটা নিয়ে দাদা কিসব মন্ত্র বলতে বলতে গঙ্গাজল ছুঁড়তে থাকে ওনার স্ত্রীর দিকে। মহিলা প্রচণ্ড চিৎকার করছিলেন, চোখ মুখ পাল্টে গেছিলো ওনার, আমাদেরও কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার মত হাল হয়েছিল। খানিকক্ষন পর ধীরে ধীরে মহিলা একটু শান্ত হতে জোর করে ওনার স্বামী ওকে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।
কথাগুলো বলতে বলতে সান্তা দেবী হাঁপিয়ে উঠেছিলেন, পিয়ালী আর রৌনক চুপচাপ দাঁড়িয়ে সব শুনছিল, অসীম বাবু ওদের জন্য গ্লাসে জল এনে দেয়, একটু জল খেয়েই সান্তা দেবী ফের বলতে আরম্ভ করলো,
– ওনারা চলে যেতে আমি আমার স্বামীর কাছে ব্যাপারটা জানতে চাইলে উনি বললেন উনিও কিছু বুঝতে পারেননি। ওনারা ফ্ল্যাট বিক্রির কথা বলছিলেন তখন ঐ মহিলা প্রথমে চুপ করেই দাঁড়িয়ে ছিল, হঠাৎ কেমন গোঁ গোঁ করে শব্দ করে ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। তখন অসীম দা আমার স্বামী কে হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করে যে সত্যি বলতো পরেশ তোমার জন্য কারুর কোনো ক্ষতি হোয় নি তো, যাকে বলে মারাত্মক ক্ষতি? এই প্রশ্ন টা শোনার পর থেকে আমার স্বামী কেমন যেন অসীম দা কে দু চক্ষে দেখতে পারেনা।
এই অব্দি বলে সান্তা দেবী চুপ করে যান। অসীম বাবু বলে ওঠেন,
– হ্যাঁ মহিলা টি যখন পরেশের গলা টিপে ধরেছিল তখন আমি ওর চোখ দুটো দেখেই বুঝেছিলাম যে সে নিজের মধ্যে নেই, তার মধ্যে রয়েছে অন্য কেউ, আর সেজন্যই দেরি না করে সান্তা কে নিয়ে গেছিলাম ওই ফ্ল্যাটে। তবে বাকি কথা পরে হবে, আমার এখন কেমন একটা ঠেকছে, সান্তা তোর বর বাড়িতেই তো? আর আপনাদের ছেলে হসপিটালে তো?
এমন প্রশ্ন শুনে বাকিরা অবাক হয়। সান্তা দেবী বলেন উনি তো পরেশ বাবু কে বাড়িতেই দেখে এসেছেন। আর পিয়ালী রাও বলে যে ছেলের জ্ঞান ফিরছেন সে হসপিটাল ছেড়ে কোথায় যাবে! ঠিক এমন সময় রৌনকের ফোনে রিং হয়, রিসিভ করতেই শোনা যায় ওপারের উদ্বিঘ্ন কণ্ঠস্বর,
– আপনি কি ঋক এর পেরেন্ট? রিককে ওর বেডে এমন কি হসপিটালের কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।