।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় শ্যামলী আচার্য

পিকনিক

‘অ্যাই রতুদা, পিকনিক জাগাটা কোথায় রে?’
‘ক্কিঃ?’
শুন্টির প্রশ্নে বেশ অবাক হয় রতু। বিরক্তও হয়। এই সময়টায় ওর প্রচুর কাজ। মরার ফুরসত পর্যন্ত নেই। সবে পুজোর মরসুম কেটেছে। এখন সামনে আইপিএল। ক্রিকেট মরসুম ভরপুর। একের পর এক বস্তায় এই সময় প্যাকেটবন্দি বাজিগুলো ভরে ফেলতে হয়। বাজির বিরাট চাহিদা সর্বত্র। এখান থেকে ক’দিন পরেই সুজনদা এসে সব গুনেগেঁথে বুঝে নিয়ে যাবে। সব বাজি ঠিকঠাক ভরে গুছিয়ে দিতে না পারলে হারানজ্যাঠা বিস্তর গাল পাড়বে। সুজনদারও খিটিমিটি লেগেই থাকে। তার মধ্যে শুন্টির হঠাৎ পিকনিক মাথায় ঢুকল কেন?

‘লে হালুয়া, পিকনিক দিয়ে কি করবি তুই?’

রতুর হাতে গুঁড়ো গুঁড়ো বারুদ ভর্তি। সোরা, গন্ধক আরও কি কি সব। চোখ জ্বলে। ভুলেও চোখে হাত দেওয়া বারণ। একটা বাক্সে লম্বা লম্বা পলতে লাগানো বাজি পরপর সাজিয়ে বড়সড় প্যাকেটটা এবার এগিয়ে দেয় শুন্টির দিকে—
‘নে নে তো এবার, ধর এটা। এই বাক্সটাতে আঠা মাখিয়ে বন্ধ কর চটপট। দেখিস খুলে না যায়। কাজের সময় তোর যত আং-সাং কথা’।
‘এই রতুদা, বল না রে, পিকনিক কী? কোন জাগায় সেটা?’
‘তার আগে তুই আমারে বল, কোদ্দিয়ে শুনলি?’

শুন্টির বয়স কম। বাজির কারখানায় ও সবচেয়ে ছোট। বছর আটেক হবে। বা সামান্য কম-বেশি। ওর কাজ শুধু কাগজের বাক্সে আঠা মেরে সিল করা। দিনে পঞ্চাশটা বাক্স সিল করলে পঁচিশটা টাকা পাওয়া যাবে। হারানজ্যাঠা নিজের জন্য পনেরো টাকা রেখে ওর হাতে বাকিটা গুঁজে দেয়।
শুন্টির অনেক কৌতূহল। ছেলেমানুষ বয়স। প্রচুর প্রশ্ন।

শুন্টি বলে, ‘কাল পাপন বলছিল, ওরা সব পিকনিকে যাবে। ওদের পড়ার মাস্টার দল বেধে নিয়ে যাবে ওদের। ছেলে-মেয়ে সক্কলে মিলে যাবে। সেখানে সব কত কিছু রান্না হবে। কাঠ জ্বেলে… উনুনে রান্না হবে… বড় বড় হাঁড়িকড়া সব ভাড়া নেছে, জানিস… ওই সুশীলদা আছে না? ওই যে মা তারা ডেকরেটরের সুশীলদা, ওই সুশীলদার থেকে নেবে সব। সকলে মিলে নাকি পাত পেড়ে খাবে। কীসব ওই যে… ফাইড রাইছ বলে না? আর মাংস– হ্যাঁ রে, পিকনিক জায়গাটা কোথায় রে রতুদা? তুই জানিস?’

রতুও জানে না পিকনিক জায়গাটা কোথায়। ওর কাছেও পিকনিক তেমন চেনা কোনও শব্দ নয়। ম্যাটাডোরে চেপে একবার পাশের পাড়ার বুম্বারা গেল— হেভি গান চলছিল— দিলবর দিলবর… আর সে কি নাচ! ঝিনচ্যাক পুরো। রতু ওদের সবাইকে নাচতে নাচতে যেতে দেখেছে। কিন্তু পিকনিক জায়গাটাতে গিয়ে ঠিক কি কি হয়, ও নিজেও তো কিচ্ছু জানে না।
কাজেই শুন্টির প্রশ্নের সঠিক উত্তর রতুর কাছেও নেই।
‘শোন না, হারানজ্যাঠাকে জিগ্যেস করব একবার?’
শুন্টিকে থামানোই যায় না। আজ যেন ও একেবারে সোজা পিকনিকে গিয়ে ছাড়বে। হুঃ। একবার জিগ্যেস করুক না হারানজ্যাঠাকে, জানে না তো। হারানজ্যাঠা ওর এই সব উতপটাং প্রশ্নে খাল খিঁচে নেবে একেবারে।
‘যা না জিগ্যেস কর। খুব মুখ শুলায় না? কাঁচা খিস্তি খাবি…’
শুন্টি হাসে। হলুদ দাঁতের নীচে ফ্যাকাশে মাড়ি। ডিগডিগে হাতে সে বাজির বাক্সে আঠা লাগানো কিন্তু বন্ধ করেনি। হাত চলছে পাল্লা দিয়ে।
চেঁচিয়ে ওঠে শুন্টি, ‘ও জ্যাঠা, জ্যাঠা গো— শোনো শোনো— শুনচ— আরে ও জ্যাঠা, ফেরো না একবার ইদিকে’…
হারান এই সময় সামান্য একটু গড়িয়ে নেয়। গোছানো আলসে ভাতঘুম, আজ মৌজ কাটালেই যা তুবড়ি ছোটাবে না! বাছা বাছা সব প্রাকৃত শব্দের ভাঁড়ার উপুড় করে দেবে একদম। রতু ভয়ে একেবারে সিঁটিয়ে থাকে।
নাঃ, ঘুমোয়নি ব্যাটা।
কিন্তু হাঁক পাড়ল খুব জোর।
‘কি হয়েছে কি? অ্যাঁ… হাতের কাজ ফেলে রেখে ফাঁকিবাজি সব। দেব এবার এক থাবড়া’।
শুন্টি একটু ফিক করে হাসে।
‘ও জ্যাঠা শোনো না এট্টুখানি, বলতেছি পিকনিক কোথায় গো?’
‘কি কোথায়?’
‘আরে পিকনিক। বলতেছি পিকনিক জাগাটা চেনো তুমি? কোথায় গো? উই ক্যানিং লাইনের দিকে?’
হারান থমকায়। ওদের সঙ্গে বকবক করার ফুরসত বা ইচ্ছে কোনোটাই নেই—তার ওপর এই ভাতঘুম মেজাজ চটকালে গোটা দিনটাই মাটি। সে খিঁচিয়ে উঠে বলে, ‘আরে মর হতচ্ছাড়া, পিকনিক জায়গা কেন হবে রে… সে তো … সে তো…’
শুন্টি আর রতু অবাক হয়ে চেয়ে থাকে।
‘পিকনিক কোনও জাগা নয়! সে কি গো! তবে কী গো সেইটা?’
‘আঃ, জায়গার নাম কেন হবে। পিকনিক মানে হল সবাই মিলে সক্কাল সক্কাল কাছেপিঠে কোথাও যাওয়া— হইচই হট্টগোল করা— একটু মস্তি, হুল্লোড়, সবাই মিলে রেঁধেবেড়ে খাওয়া আবার বিকেলে ফিরে চলে আসা… সে যে কোনও জায়গাতেই হতে পারে’।
ও মা! সে আবার কি! যে কোনও জায়গা? যে কোনও জায়গাই পিকনিক? মানে ওই বস্তির পাশে ডোবার ধারটাও পিকনিক… বাজারের পেছনে কাঁচা নর্দমার ধারটাও? ওদের ঝুপড়িঘরের এক চিলতে বারান্দাও পিকনিক? আর শুধু সবাই মিলে হইচই করে খাওয়া…
শুন্টির মনের মধ্যেটা তোলপাড় করে। তবে যে ওরা অত ঝলমলে মুখ করে বলল— ‘পিকনিকে যাচ্ছি শুন্টি। আমাদের মাস্টারের সঙ্গে। উফ আজ কত যে মজা হবে’।
শুন্টি সেই থেকে ভাবছে, পিকনিক বুঝি একটা দারুণ জায়গা। বেশ পরিষ্কার তকতকে। কোনও নোংরা গন্ধ নেই। একফোঁটা কাদা নেই। বেশ বিরাট বড় একটা মাঠ। সবজে সবজে ঘাস। পাশে একটা সরু নদী থাকলেও থাকতেও পারে। সেই নদীতে জলে নেমে বেশ হাত-পা ধুতে হবে না! মাঠে ছুটে ছুটে ওরা গঙ্গাফড়িঙের ডানা চেপে ধরবে। রবারের ফাটা ফুটবল নিয়ে ছুট ছুট আর ছুট। ছেঁড়া পেলাস্টিকের ঘুড়িটাও তাপ্পি মেরে উড়িয়ে দেবে একবার। লাটাইটা ধার নিয়ে নেবে নাহয়। বস্তির তপুদা দিলখোলা ছেলে। চাইলে দিলেও দিতে পারে।
সেদিন শুন্টি আর কারখানায় আসবে না।
সকলে মিলে পাত পেড়ে বসে জমিয়ে খাবে সেদিন। পেট পুরে খাবে। পিকনিকে কী চেয়ে চেয়ে খাওয়া যায়?
রতু, শুন্টি, মনা, পাপন, বাচ্চু সবাই মিলে খাবে। হ্যাঁ। ওই যে ফাইড রাইছ আর মাংস। গরম গরম খেয়ে নেবে। ওসব খাবার জুড়িয়ে গেলেই পুরো গোবর।
পিকনিক জায়গাটা চিনতই না শুন্টি– আজ বুঝল, যে কোনও ঝক্কাস জায়গার নামই পিকনিক। যেখানে সবাই মিলে পেট পুরে গুছিয়ে বসে খাওয়া যায়।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।