“এই শ্রাবণে আষাঢ়ে গপ্পো” বিশেষ সংখ্যায় সোনালি

অন্য জগত

সহ্যাদ্রি পর্বতমালা। ভয়ঙ্কর সুন্দর প্রকৃতির আশ্চর্য বিরাট ক্যানভাস। কলকাতা দিল্লি মুম্বাই ছুঁয়ে থাকা মস্ত অফিসার সাহেব আর তাঁর কসমোপলিটান গিন্নি অবাক হয়ে যাচ্ছেন এই রুক্ষ পাথরের বিশাল পাহাড়ের সারি আর তার দুই পাশের নিশ্ছিদ্র গহন জঙ্গল দেখে।
তাঁরা অনেক বেড়ান। দামি কাজের,সাফল্যে্‌র, সামাজিক দায়বদ্ধতার চাপ মানে সম্মিলিত অনেকখানি প্রেসার কুকার।তাই উচ্চ উপার্জনের থেকে বড় স্লাইস কেটে দু এক দিনের ফাঁকেই আকাশে উড়ান দিয়ে বহু দূর পালান দম্পতি। নিঃশ্বাস নিতে। দেশ বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তকে অতি অল্প সময়েই ছুঁয়ে আবার কাজের জগতে ফিরে আসা যায় অর্থের ডানা থাকলে । তাই পাহাড়, নদী ,সমুদ্রের নানান ধরনের বৈচিত্রের সঙ্গে এঁরা পরিচিত।সহজে আশ্চর্য হন না।
তবু, পশ্চিম ঘাট পর্বতের প্রহরায় ঘেরা মহারাষ্ট্র এঁদের নিস্তব্ধ করে দিচ্ছে।
এখানে মাইলের পর মাইল শুধুই লালচে আর কাল পাথরের নিঃশব্দ স্তূপ ।
সাহেব অপূর্ব সাজানো হোটেলে এসেছেন। সেখানে পাথর ঢাকা আছে একেবারে সত্যিকারের মত বিদেশি ঘাসের লনে। চারিদিকে ঘাস আর ঝর্না, রেয়ার দামি ফুলের রঙের রায়ট, নীল টুকটুকে সুইমিং পুল,জাকুজি, গাছে দোলনা, চারদিকের ছোট সাজানো টেবিলে সারা বিশ্বের সব রকম খেলাধুলোর সরঞ্জাম। এই ছবির থেকেও সুন্দর আতিথেয়তার বাসায় ,লুকোনো স্পিকার থেকে সমস্ত দিনের ভেসে আসা সুরে, প্রতিটি কোনায় ছবির মত হাসি মুখ হোটেল স্টাফের আপ্যায়নে , ভাবাই যায় না, গেট থেকে বেরোলেই জঙ্গল, আর হোটেলের পিছন দিককে নিরাপদ রেখেছে খাড়াই পাহাড়ের আকাশে উঠে থাকা পাথরের স্তূপ। ভিতরের সব কিছুই এত মোলায়েম, এত রঙ মিলিয়ে কোঅর্ডিনেটেড ।
আরো একটা মজার ব্যাপার। এখানে সবই ট্যাক্সি। অল্টো, এস্টিম, ভ্যান যে গাড়িই হোক, হলুদ কাল রঙ করে দেওয়া আছে, আর তার নাম ট্যাক্সি । গাড়ি অনুযায়ী দাম আলাদা খালি।
এই রকম একটি বাহন নিয়েই রোজ বেড়িয়ে পড়তেন সাহেব আর গিন্নি।শিবাজি মহারাজের দুর্গ, স্ট্রবেরী বাগানের অজস্র গাছের মাঝে বসে স্ট্রবেরী উইথ ক্রিম আর ভুট্টার পকোড়া, সাহেবদের নাম লেখা সব ভিউ পয়েন্ট। আসলে মহাবালেশ্বর বৃটীশদের সামার ক্যাপিটাল ছিল ত, সাহেব মেমরাই নাম দিয়ে গেছেন জায়গা গুলোর ।
রাস্তাগুলো খুব যত্নে তৈরি। টুরিস্ট না এলে গরিব মানুষ খাবে কি। তিন চার মাস বর্ষার মরশুমে তো ঘর থেকেও বেরোনো ্যায় না ।জমানো খাবারপত্রে দিন গুজরান। এ পাহাড়ে বর্ষা মানে বন্যার স্রোতের মত জল।
এই সবই ড্রাইভারের সঙ্গে গল্প করে জানতে পারছিলেন সাহেব।তারপর বললেন, “তা এত যে চারদিকে হোর্ডীং লাগানো; চিতা হইতে সাবধান, বাঁদর হইতে সাবধান, হ্যানোত্যানো,টীক্কি ওতো দেখলাম না কিছুর।”
ড্রাইভার বলল, “আছে ত, এখন কি করে দেখবেন।ওরাও মানুষকে ভয় পায়। আমরা দেখি ত সব সময়েই সাঁঝের পর চলাফেরা করার সময়।”
এই সব কথা হতে হতেই পাশে অনেকগুলি পুরোনো কবর দেখা গেলো চলন্ত গাড়ির জানালা দিয়ে । গিন্নি বল্ললেন, দেখেছ?
সাহেব হা হা করে হেসে বললেন,“ কবরস্থান,তা জানোয়ার ত দেখেন, কখনো ভুত দেখেননি ড্রাইভার সাব ? দেখেছেন না কি ? ভুত?”
নিঃশব্দ হয়ে যাওয়া ড্রাইভারের বিরক্তি হঠাৎ দমবন্ধ করে দিল কাঁচতোলা গাড়ির ভিতরটা ।
গিন্নি অস্বস্তি মেখে জানলার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে ভাবলেন, “কেন যে এই শহুরে ওস্তাদির লোভটা আমরা সামলাতে পারি না…”
সেই মূহুর্তে জানলা পেরিয়ে গেল জঙ্গলের গাছের ফাঁকে একটা সুঁড়ি পথ।সেখানে একটা মেয়ে পিছন ফিরে মাটি থেকে কি একটা তুলছে। ঘাসের ঝুড়ি কি?
গিন্নি এক ঝলক অবাক হয়ে ভাবলেন,“বাবা কি কালো আর লম্বা পাগুলো, এত লম্বা মেয়ে এদিকে দেখিনিতো খুব একটা।”
এখানে গ্রামের মেয়েরা নওয়াড়ী, মানে কাছা দিয়ে ধুতির মত নয়গজি শাড়ি পড়ে ।এ মেয়েটা একটা চিতাবাঘমার্কা ছোট্ট শাড়ি কোন রকমে পেঁচিয়ে রেখেছে খালি গায়ে।কলকাতায় এমন ছাপা জামাটামা প্রচুর দেখা যায়।এখানে?
হঠাৎ মুখ ফেরাল মেয়ে।
না, মেয়ে কোথায় ;এর মুখখানাও ত চিতাবাঘ।
ইসস, কে যে কখন বদলে গিয়ে কি হয়ে যায়।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।