সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সোনালি (পর্ব – ৪৬)

রেকারিং ডেসিমাল

অদেখা ব্যানার্জি মশাইয়ের কথা সারাক্ষণ তাঁর গিন্নীর মুখে।
তার থেকেই টুকরো টুকরো ছবি জুড়ে গল্প তৈরী করে নতুন বউ।
এখন যাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা দেয়া হয়েছে সে তখনও শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ।
মেশোমশাই সেখানেও পড়াতেন, গণিত। তারপর ও এন জি সি, রাশিয়ায় ট্রেনিং,  আরও পরে নানান বিদেশ।
মোদ্দা কথা জানা গেল, মানুষটি অবশেষে জিওফিজিএক্স বিষয়ে মস্ত পণ্ডিত মানুষ। অথচ শ্বাশুড়ি মা বলেন, নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ। রোজ দেরাদূনের ঠাণ্ডাতেও ধুতি পরে পরম যত্নে শিবপুজো করেন।
দাদুভাই তাঁর শ্বশুর।
তাঁকে ও পরম যত্নে কাছে রেখেছেন বড় মেয়ে জামাই।
শোনা যাচ্ছে, তাঁর স্ত্রী ও এখানেই ছিলেন শেষ অবধি।
তিনি চলে গিয়ে থেকে,  মাস্টারজী ছাত্রদের নিয়েই ব্যস্ত হয়ে আছেন।
দাদুভাই আস্তে আস্তে বলেন,  জামাই ই আমায় সক্কালবেলা চা দিয়ে যায়। সে জানে আমি কি খাই। সকালে একসঙ্গে বসে চা খাই দু জনে।
একটু একটু করে গল্পের ঝাঁপি খুলতে থাকে।
তারমধ্যে  ভারি মনখারাপ করা দুঃখের গল্প ও থাকে।
তিন মেয়ের মধ্যে সবার ছোট্ট মেয়ে।
বাবা মাকে ছেড়ে থাকতে পারে না। তাকেই বিলেতে পাঠিয়েছেন বাপ। সে জামাই ও ভারি বিদ্বান। কিন্তু মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে প্লেনে উঠলো।
আর ত দেশে আসতে পারলো না।
মন কেমন করে বউয়ের।
আহা। আর কখনো বাবা মা দিদিদের, নিজের দেশ,  কিচ্ছুটি দেখতে পেলো না সে মেয়েটা ?
দাদুভাই বলে চলেন। তার ও তিনটি মেয়ে। তারা এখন বড় হয়েছে।
আমাদের বাড়ির ধারায় আইন নিয়ে পড়াশোনা ও করেছে তাদের কেউ। যোগাযোগ করে এসেছিল আমার কাছে। দেখা করে গেছে দেরাদুন এসে।
আর ছোট মাসি ?
নড়ে চড়ে বসে বউ।
ফিরে আসতে পেরেছিল সেই মেয়েটা তবে কি একটি বারের তরেও?
নাহ।
বিষন্ন উদাস দৃষ্টি জানালা দিয়ে বাঙ্গুর হাসপাতালের দিকে ভাসিয়ে দেন গম্ভীর বাপ।
সে আর আসেনি।
সেই যে যুদ্ধ হল।
জানো তো ? যাকে এখন মুক্তিযুদ্ধ বলে ইন্ডিয়াতেও?
হ্যাঁ হ্যাঁ।
ছোটবেলার ইতিহাসের গল্পরা ভেসে আসে মনে।
ইন্দিরা গান্ধী ভারত সরকারের হয়ে বিমান, সৈন্য পাঠিয়েছিলেন। ওপারে ভুট্টো, ইয়াহিয়া খান। শেষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জিতলেন।
দাদুভাই আমার তখন নার্সারি ক্লাস।
ছোটদের পত্রিকা ঝুমঝুমিতে পড়তাম গো।
আর মাইকে গান বাজত, তোমার ভয় নেই মা আমরা প্রতিবাদ করতে জানি।
ম্লান হাসেন দাদুভাই।
রাজাকারেরা ছিলো।
বাঙালী হিন্দু উচ্চপদস্থ মানুষের টার্গেট লিস্টে নাম ছিলো আমার।
টাকা পয়সা কোমরে বেঁধে নিয়ে তোমাদের দিদিমাকে সঙ্গে নিয়ে পালাচ্ছিলাম।
সে কত দিন।
কি জানো, সোনালি ডার্লিং,  আগে ত গ্রামে আমাদের পরিবারকে জমিদার গোছেরই মনে করত। গরীব মানুষ নিজেদের জানত প্রজা। আর ভারি ভালো বাসত আমাদের। মুসলমান মানুষ নিজেদের প্রাণভয় তুচ্ছ করে লুকিয়ে রেখেছে আমাদের। দিনের পর দিন।
দে ওয়ার ফিয়ার্স্লি লয়াল।
চোস্ত বৃটিশ ইংরেজি উচ্চারণের সাথে চোখ চিকচিক করে ওঠে সাহেব মানুষটির।
শ্বাশুড়ি জলখাবারের থালা  নিয়ে এসে বলেন,  এত দিন মাটির ঘরে, কখনো খড়ের গাদায় লুকিয়ে থাকতে থাকতে কোমরে বেঁধে রাখা টাকার থেকে ঘা হয়ে গিয়েছিল  জানো?
সে যে কি দিন গেছে আমাদের।
আমাদের সবার ছোটো বোনটা, বাঘু,  ইংল্যান্ডে বসে সারাদিন বিবিসিতে খবরে বাঙালিদের ওপর অত্যাচার আর এই হাজারো লোক খুন হবার খবর শুনতে শুনতে বাবা মায়ের জন্য আতঙ্কে কেমন হয়ে গেল। আর যোগাযোগ করে না।
যাক গে।
এসব কথা আর নয়। যাও ওঠো দেখি। কেবল গপ্পো পেলে আর কিছু চায় না এই ফাঁকিবাজ বউ।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।