অথ শ্রী উপন্যাস কথা-তে সুতনু হালদার – ধারাবাহিক (অন্ধকারের উৎস হতে)

এগারো
আজ সকালে কচিপাতা ওয়েলফেয়ার সোসাইটিতে নির্ঝরদের কোনও প্রোগ্রাম ছিল না, সরকার থেকে রেশনের মাধ্যমে খাদ্যশস্য সরবরাহ করা হচ্ছে বলে ইদানিং তারা সপ্তাহে একদিন করে আশপাশের দুঃস্থ মানুষজনদের খাদ্যবস্তুসহ কিছু কিছু নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রাদি পৌঁছে দিচ্ছিল। তবে এখন থেকে সেটা পনেরোদিন অন্তর দেওয়া হবে বলে গতকাল মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আজকাল তাই উপযুক্ত সর্তকতার সঙ্গে তাদের সকালে কিছুক্ষণ আড্ডা চলে। আজকের দিনটাও এমনই একটা দিন। গৌতম, তনয় আর নির্ঝর প্রতিদিনই আসে, তবে সুফল আর শুভ অনিময়িতভাবে হলেও আসে। আজ যেমন এসেছে। পল্টুদা ইদানিং খুব কম আসে। যেদিন যেদিন খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেবার কাজ থাকে, সেদিন যথাসময়ে সকলেই হাজির হয়। কিন্তু সেটাও তো ইদানিং বেশ ব্যবধান রেখে হচ্ছে। আগামীতে আরো কমবে। তাই তাদের দ্যাখা সাক্ষাৎটাও কিছুটা অনিয়মিত হয়ে গিয়েছে। গতকাল তাদের কার্যকর কমিটির মিটিংয়ের সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে। এই খবরটা পল্টুদা সকলকে মোবাইলে জানিয়েছে। যদিও নির্ঝর আর গৌতম, কমিটির মেম্বার হিসাবে চেয়েছিল ওটা পনেরো না করে দশদিন অন্তর হোক। কিন্তু পল্টুদা জোরাল আপত্তি জানিয়ে পনেরো দিন অন্তর করে সামগ্রী পৌঁছনোর ব্যাপারটাতে গোঁ ধরাতে, শেষমেশ সবাই সেটাই মেনে নেয়। দিন কয়েক হ’ল, পল্টুদা এই বেসরকারি সোসাইটির সম্পাদক হিসেবে মনোনীত হয়েছে, অতএব তাকে অমান্য করা ঠিক নয়। বিশেষত এইসময় তো একেবারেই ঠিক নয়। দানসামগ্রীর জন্য পল্টুদার সমান অর্থ এখানে কেউই দেয় না। নির্ঝর আর তনয় তো কিছু দিতে পারে না বললেই চলে। তাই তাদের জোরাজোরি এই অসময়ে কে-ই বা শুনবে? কেনই বা শুনবে? শুনলোও না কেউ। একতরফা ভাবেই পল্টুদার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ে গেল। নিজেদের ক্ষোভটা মনের মধ্যে চেপে রাখা ছাড়া, এখন অন্তত নির্ঝরদের আর কিছুই করার থাকল না। আজ এইসবই আলোচনা হচ্ছিল। মাঝেমাঝে দু’একবার পল্টুদার বাপবাপান্তও হচ্ছে। এমন সময় সেখানে স্বয়ং পল্টুদা হাজির। গতকাল অতক্ষণ থাকার পরে, আজ আবার সকালবেলায় পল্টুদা চলে আসবে, নির্ঝররা এতটা ভাবতে পারেনি। কিন্তু পল্টুদা এলো। সাবলীলভাবেই এলো। গতকাল তার সিদ্ধান্ত সবাই মেনে নেওয়াতে স্বভাবতই সে একটু বেশি খুশিখুশি ভাবেই আজ এসেছে। তবে সেইসব কথা একবারের জন্যেও উচ্চারণ না করে বলল, ‘অবস্থা কেমন বুঝছিস তোরা?’
নির্ঝররা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে বলল, ‘কীসের অবস্থা?’
-‘কেন! রাজ্যের, দেশের, বিশ্বের আর করোনার?
শুভ বলল, ‘তুমি যা বুঝছ, আমরাও তাই বুঝছি।’
-‘হুম, সে তো ঠিকই। একযাত্রায় আর পৃথক ফল হয় কী করে? তবে এই পুরো মে’ মাস জুড়ে সমগ্র ভারতবর্ষে করোনা যা তাণ্ডব চালালো, তাতে আগামীদিনগুলোর কথা ভাবতেই খারাপ লাগছে! কপালে আরো কী কী দ্যাখা বাকি আছে কে জানে! প্রত্যেকদিনই আক্রান্ত আর মৃতের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। সব থেকে আশ্চর্যজনক লাগছে যেটা, সেটা হ’ল এই বীভৎস পরিস্থিতিতে লকডাউন হাল্কা করতে করতে একেবারেই তুলে দেওয়া হ’ল! প্রথম থেকে ঠিকঠাক আঁটোসাটো অবস্থার মাধ্যমে করোনা আটকিয়েও শেষে লকডাউন শিথিল করে দেওয়া মানে দেশের মানুষকে জেনে বুঝে নিরস্ত্র অবস্থায় বাঘের খাচায় ঠেলে দেওয়া। এটাই ভয়াবহ সমস্যা।’
তনয় তাল মিলিয়ে বলতে শুরু করল, ‘প্রথম থেকে অনেকটাই সতর্ক পদক্ষেপ নিয়েছে আমাদের দেশ। তবে আরো আগেই যদি বিদেশ থেকে আসা বিমানগুলো দেশে ঢোকা বন্ধ করতে পারত, তাহলে হয়ত দেশের হাল অনেকটা ভালো হত। তা হয়নি! পররাষ্ট্রনীতি বিষয়টিও খুব গোলমেলে। এখন সেই ইমিউনিটি পাওয়ারই শেষ ভরসা। অথচ এই ইমিউনিটি পাওয়ারে ভরসা রাখতে গিয়ে ইংল্যান্ডের অবস্থা কারোরই অজানা নয়। আবার আমাদের দেশের সব রাজ্যে লকডাউন সমান কঠোরতায় মানা হয়েছে বলেও মনে হয় না। তাহলে মহারাষ্ট্র আর গোয়ার এতটা বিপরীতগামী অবস্থা হয়ত না হতেও পারত। কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই। এবার উঠে যাক লকডাউন। না হলে এবার না খেতে পেয়ে মরতে হবে।’
-‘হ্যাঁ। সেই। যে যেরকমভাবে দেখে আর কী। তবে জুন অবধি যদি টানা যেত, তাহলে হয়ত আশঙ্কাটা অনেক কমলেও কমতে পারত। করোনার হালহকিকত সম্পর্কে মোটামুটি বলা যায়, সারা দেশে করোনার যা বাড়বৃদ্ধির হার তার শতকরা ৭৭ ভাগ কেন্দ্রীভূত হ’ল — মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু, গুজরাট, দিল্লি, উত্তর প্রদেশ। এরপরেই আছে মধ্যপ্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ। মূলত দেশে দশটি জেলার পরিস্থিতি ভয়াবহ বলা চলে। এগুলো প্রত্যেকটিই মেট্রোপলিটন সিটি। যেমন মুম্বাই, আমেদাবাদ, চেন্নাই, পুনে, থানে, ইন্দোর, জয়পুর, কলকাতা, যোধপুর, সুরাট। দেখা যাচ্ছে করোনা আক্রমণটা বেশি হচ্ছে কেবলমাত্র বৃহদ নগরকেন্দ্রিক এলাকায়। তুলনায় গ্রামাঞ্চল বা মফস্বলে শহরগুলো অনেকাংশেই নিরাপদ। তবে আবহাওয়ার কারণেই হোক বা ইমিউনিটি পাওয়ারের জন্যেই হোক চীন কিংবা আমেরিকাসহ পশ্চিম বিশ্বের করোনা ভাইরাসের তুলনায় আমাদের দেশের করোনা ভাইরাস কিছুটা হলেও দুর্বল। এটাই একমাত্র আশার কথা। তবে বিশ্বের প্রেক্ষিতে মে’মাসের প্রথমার্ধের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখা গিয়েছে, ওই সময়কালে পৃথিবীতে সব চায়তে বেশি হারে করোনা ছড়িয়েছে ব্রাজিলে আর তারপরেই ভারতবর্ষে। এমনকি পাকিস্তান, বাংলাদেশ, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, ব্রিটেন, আমেরিকাতে এই সময় করোনা ছড়ানোর পরিমাণ যেন অনেকাংশেই কমে গেছে। ফ্রান্সে তো প্রায় নেই-ই বললেই চলে। অন্যদিকে চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, ইতালি, স্পেনের মতো যে সমস্ত দেশগুলোতে গত কয়েক মাসে করোনা হাজার হাজার মানুষের প্রাণ নিয়েছিল, আপাতত সেখানে করোনা যেন কিছুটা হলেও বর্তমানে স্তিমিত হয়ে পড়েছে। আগামীদিনে বিশ্বের অন্যতম বেশি আক্রান্ত দেশগুলোর মধ্যে ভারতের এসে যাওয়াটা কোনও আশ্চর্যের বিষয় নয়। এই তো ত্রিপুরাকে চতুর্থ করোনামুক্ত রাজ্য হিসেবে মেনে নেবার পরেও অবস্থা পাল্টে গেল! সেখানে করোনা আক্রান্ত রোগী পাওয়া যাচ্ছে। আসলে মেডিসিন যতদিন না বের হবে ততদিন কিছুতেই কোনও ভরসা নেই।’
উপস্থিত সকলেই পল্টুদার কথার সত্যতা স্বীকার করে নিল। নির্ঝর বলল,’ তবে আমাদের দেশে এই স্টেজে এসে করোনা আস্তে আস্তে এবার নিজেও কিছুটা দুর্বল হয়ে নিস্তেজ হতে বাধ্য। সেক্ষেত্রে লকডাউনের পর ইমিউনিটি পাওয়ারের ওপর ভরসা রাখা যেতেও পারে। ইংল্যান্ড লকডাউন না করেই ইমিউনিটি পাওয়ারের কেরামতি দেখতে চেয়েছিল আর আমরা লকডাউন করার পর দেখতে চাইছি। সুতরাং রেজাল্টের কিছুটা ফারাক হওয়াটাই স্বাভাবিক। আর পশ্চিম বাংলার ক্ষেত্রে আবহাওয়াটাও একটা বড় কারণ হতে পারে। যদিও আমি শীত-গরমের প্রসঙ্গে যাচ্ছি না। কিংবা মিউটেশন ঘটিয়ে করোনা আরো শক্তিস্থালী হয়ে উঠবে কিনা সেই বিষয়েও কোনও কিছু নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু এটাও তো ঠিক যে, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, চিকনগুনিয়া, আন্ত্রিক, স্মলপক্স এইসব এত কিছুর সঙ্গে যুঝতে যুঝতেই বাঙালীরা বাঁচতে শিখেছে। তাই তাদের ইমিউনিটি পাওয়ার প্রথম বিশ্বে ধনীদেশের নাগরিকদের থেকে অনেকটাই বেশি। আর বাঙালিদের খাদ্যাভ্যাসে রসুন, পিঁয়াজ প্রভৃতির আধিক্যও এখন দেখা যাচ্ছে তাদের ইমিউনিটিকে অনেকের থেকেই উঁচুতে রেখেছে, সেই সঙ্গে পর্যাপ্ত পরিমানে এখন লেবু বা টক জাতীয় খাদ্য, যাতে ভিটামিন সি বাড়ে। এখন প্রশ্ন হ’ল নিরন্ন পরিবার এগুলো পাবে কোথায়? তবুও ইতিবাচক ভাবনা-চিন্তাকেই প্রাধান্য দিতে হবে। এইসব আশার বাণীগুলোতে নিজের মনকে সান্ত্বনা দিয়েই আগামীর জন্য প্রস্তুত হতে হবে। কিন্তু আমার মনে হয়, এখানকার সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে আলাদাভাবে সতর্কতা থাকা উচিত।’
গৌতম বলল, ‘সে না হয় বুঝলাম, কিন্তু করোনা আবহে দেশ জুড়ে অবশ্য নানাবিধ অঘটন তো লেগেই আছে। কয়েকদিন আগে বেশ কিছু পরিযায়ী শ্রমিক মালগাড়িতে কটা পড়েছে। দিল্লী থেকে বিহারে বাড়ি ফেরার পথে একজন সাইকেল আরোহী পরিযায়ী শ্রমিক বেপরোয়া লরির ধাক্কায় প্রাণ দেয়। করোনা প্রত্যক্ষভাবেই শুধু নয় পরোক্ষভাবেও দেশের প্রচুর প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। সরকার লকডাউন দীর্ঘস্থায়ী করতে আর তেমন আগ্রহী বলেও মনে হচ্ছে না। তাছাড়া আর কতদিনই বা লকডাউন চলতে পারে, এটাও তো ঠিক। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা তলানিতে ঠেকেছে। লকডাউনে খুব একটা আশানুরূপ সুফল দেখা না গেলেও, দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির বর্তমান অবস্থা চূড়ান্তভাবে শোচনীয়, একথা বলাইবাহুল্য। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য প্রত্যেকটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে বারবার ভারচুয়াল মিটিং করছেন এবং তিনি সমবেত মতামতের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নিতে ইচ্ছুক। কিন্তু সেখানে বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের মধ্যে কেউ লকডাউন আরও দীর্ঘস্থায়ী করার পক্ষে, কেউ বা নন, এটাতো গতবারেই দেখা গিয়েছিল। কিন্তু আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে অনুমিত হয়, এই লকডাউন আর বেশিদিন স্থায়ী করতে পারা যাবে না, একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। আরও বেশী দিন চললে দেশে দুর্ভিক্ষ লেগে যাবে। এই পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া সত্যিই খুব কঠিন। সিদ্ধান্তের যে দিকেই পাল্লাভারি হোক না কেন, রেজাল্ট সবার জানা। আর সেটা হ’ল সার্বিকভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষতি।’
কিছুটা সময় বোধহয় স্বাভাবিক নিশ্বাস প্রশ্বাসের ক্রিয়াকর্ম বজায় রাখার জন্য থেমে, গৌতম আবার বলতে শুরু করল, ‘তাছাড়া বর্তমানে আন্তর্জাতিক অবস্থাও খুব গোলমেলে। একে তো বিশ্ব জুড়ে করোনার তাণ্ডব, তার ওপর চীন সাগরকে কেন্দ্র করে চীনের আগ্রাসন, আমেরিকা সহ বিশ্বের অনেক দেশকেই ভাবিয়ে তুলেছে। এক্ষেত্রে ভারতের উদ্বিগ্ন হবারও যথেষ্ট কারণ রয়েছে। চীনের এই আগ্রাসন রোধ করা না গেলে, ভারত মহাসাগরের দিকেও চীনের লোভী দৃষ্টি পড়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। চীন সাগর সহ এই আন্তর্জাতিক জলপথগুলো হাতিয়ে নিতে পারলে ভবিষ্যতে চীনের পক্ষে অর্থনৈতিকভাবে মুনাফালাভের অনেক সুবিধা হবে। তাছাড়া চীন সাগরের ওই জলপথে প্রচুর সামুদ্রিক মাছ এবং খনিজপদার্থের আধিক্য চীনকে আর্থিকভাবে বিশ্বের এক নম্বর স্থান আদায় করিয়ে দিতে অত্যন্ত সহায়ক হবে। আর ভারত মহাসাগরের জলপথে হাত দেওয়া মানে তারপরেই ভারতের সার্বভৌমত্বের ক্ষেত্রে প্রশ্নচিহ্ন চলে আসবে। যেটা চীনের অনেকদিনের স্বপ্ন। সুতরাং আমেরিকা, জাপান সহ বিভিন্ন দেশ চীনের এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রীতিমতো উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে চীন সাগরের ওই স্থানে তাদের রণতরী মজুত রাখতে বাধ্য হয়েছে, যাতে চীন বে-আইনিভাবে ওই আন্তর্জাতিক জলপথ দখল করতে না পারে। ভারত সরকারও এক্ষেত্রে ইতিবাচক পদক্ষেপই নেন। খুব ধীরে সুস্থে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার মতো একটা যেন উদ্বেগজনক পরিস্থিতি। যদিও শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ হয়ত হবে না, কিন্তু বর্তমানে ভারতের সামনে দুটো সমস্যা; একটি হ’ল, আভ্যন্তরীণ সমস্যা- করোনা আর দ্বিতীয়টি অবশ্যই আন্তর্জাতিক সমস্যা- দেশের সার্বভৌমত্ব বজায় রাখা। এ যেন এক চূড়ান্ত দূরাবস্থা। আমেরিকার ক্ষেত্রে প্রশ্নটা আত্মসম্মানের। জাপান সহ বিশ্বের অন্য অনেক দেশের পক্ষে চীনের এই আগ্রাসনের বিষয়টা অস্বস্তির। তাই অনেকেই আজ চীনের বিরুদ্ধে। তবে পাকিস্থানের মতো কিছু সুহৃদ বন্ধুও তাদের আছে, একথাও অস্বীকার করার নয়।’
পল্টুদা হাঁ করে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, ‘ইরিশ শালা! তুই তো প্রচুর জানিস রে গৌতম! চাকরি পাচ্ছিস না কেন ভাই? জোরতোর লাগ এবার। হয়ে যাবে। সিরিয়াসলি বলছি।’
-‘চাকরি কোথায় দাদা? তোমার অফিসে দ্যাখো না একটা, যা হয় কোনও একটা..’
-‘এখন কি আর ওভাবে হয়! লেগে থাক। ভালো করে প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষা দে। ঠিক হয়ে যাবে।’
-‘এতদিন লকডাউনের পর নতুন সমস্ত নিয়োগ বন্ধ হয়ে যাবে। আমাদের কপালে আর চাকরিবাগরি হয়ত জুটল না।’ নির্ঝর একটু গম্ভীর গলায় বলে উঠল।
এইসব আলোচনা যখন তুঙ্গে, ঠিক তখনই প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে শ্রাবণী এসে নির্ঝরকে ডেকে জানালো, ‘নির্ঝরদা বাপির শরীরটা খুব খারাপ করছে। দাদা একা, তোমরা একটু আসতে পারবে?’
পল্টুদা ছাড়া ওরা বাকি সবাই ছুটে গেল। শিশির বাবুকে দেখে মনে হচ্ছে ওনার শ্বাসকষ্ট জনিত একটা সমস্যা হচ্ছে। উনি খুব কষ্ট করে বললেন, ‘বুকে চাপ লাগছে। এত করে সাবধানে থেকেও করোনা আমাকে ছাড়ল না!’
‘আঃ! চুপ করো তো।’ শ্রাবণীর মা প্রায় ধমকের সুরেই শিশির বাবুকে থামিয়ে দিলেন।
নির্ঝররা ওনাকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটল। হাসপাতালের অবস্থাও তথৈবচ! হাসপাতালের সামনের বিল্ডিংটা সাধারণ রোগীদের জন্য, আর ক্যাম্পাসের একদম শেষের বিল্ডিংটা করোনা আক্রান্তদের জন্য। যদিও করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসা এখানে হয় না। প্রাথমিক অবস্থায় রাখা হয়। টেস্টে কোভিড নাইনটিন পজেটিভ কেসগুলো করোনার জন্য সংরক্ষিত হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। কিন্তু সেই জায়গাতে চোখ রাখা দায়। প্রচুর রোগীর ভীড়। হাসপাতালের করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসার দিকেই শিশির বাবুকে তন্ময় নিয়ে যাচ্ছিল, নির্ঝর বাঁধা দিল। ‘এদিকে এসো তন্ময় দা। আগে আউটডোরে দেখিয়ে নিই, ওঁরা বললে তখন ওদিকে নিয়ে যাব। জ্বর-জ্বালা, ঠাণ্ডা লাগা, সর্দি-কাশি যখন নেই, আগেভাগে তখন করোনা ভাবার কারণ নেই। শ্বাসকষ্ট অন্য কারণেও হতে পারে। আউটডোরে দ্যাখাব আগে।’
আউটডোরের ডাক্তার দেখে বললেন, ‘খাওয়া-দাওয়ার গন্ডগোলের জন্য সামান্য গ্যাস ফর্ম করেছে। ভয়ের কিছু নেই। একটা ইঞ্জেকশন দিচ্ছি। ঘন্টা খানেক দেখুন, কমে গেলে বাড়ি নিয়ে যাবেন।’
ঘন্টাখানিকের মধ্যেই শিশির বাবু সুস্থ হয়ে উঠলেন। ডাক্তারের কাছে রিলিজ নেবার সময় ডাক্তারবাবু বললেন,’এত চিন্তা কীসের করেন মশাই? কেন করেন?’
-‘হে! হে! না মানে। বর্তমানে যা পরিস্থিতি চলছে…’
-‘কীসের পরিস্থিতি?’
এবার শ্রাবণী মুখ খুলল, ‘বাপী সারাদিন করোনার ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে।’
-‘না, না। একদম ভয় পাবেন না। ওসব চিন্তা করবেন না। ওসব চিন্তা বাদ দিয়ে বরং হালকা ব্যায়াম করুন, সহজপাচ্য খাবার খান, মনকে ফ্রি রাখুন। সাবধানে থাকুন। কিস্যু হবে না। অযথা উল্টোপাল্টা চিন্তা করলে আবার এইসব উপসর্গ দেখা দেবে। যে ওষুধগুলো লিখে দিলাম, নিয়ম করে খাবেন। কোনও চিন্তা নেই। আপনার করোনা ফরোনা কিস্যু হয়নি। আপনার ইসিজি রিপোর্টও একেবারে ঠিক আছে। নির্ভাবনায় বাড়ি যান’।
বিকেল চারটে দশ নাগাদ নির্ঝর বাড়ি থেকে বেরিয়ে গ্যালো। সাড়ে চারটে নাগাদ ত্রিকোণপার্ক মোড়ে শ্রাবণীর আসার কথা; ওদের দ্যাখা হ’ল চারটে কুড়ি নাগাদ। অনেকদিন পর বলেই হয়ত আজ দু’জনেই একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছে। সচরাচর এমনটা হয় না। শ্রাবণীর ভূগোল পরীক্ষা বাকি আছে, কিন্তু কয়েকটি জায়গায় কিছু সমস্যা হচ্ছে বলে, আজ জয়িতা ম্যাডামের কাছে যাবার কথা। নির্ঝরও যাবে। তাদের বাড়ি থেকে জয়িতা সেনের বাড়িটা একটু দূরে, ভেতর দিয়ে একটা পথ আছে, সাইকেলে তাও প্রায় ঘণ্টাখানেকের। শ্রাবণী একা আসতে ঠিক সাহস পাচ্ছিল না। নির্ঝরকে আসতে বলেছিল। নির্ঝরও এই সুযোগ হাতছাড়া করেনি। এই সুযোগে নির্ঝর কিছুক্ষণ তুষার দার সঙ্গে আড্ডা তো দিতে পারবে। সেটাই তার কাছে পরম শান্তি। তাছাড়া যাওয়া আসার সময়টুকু অনেকদিন পর শ্রাবণীর সঙ্গলাভ, সেটাই বা কম কীসে? শিশির বাবুকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে ফেরার পথে যখন জয়িতা ম্যামের বাড়ি যাবার কথা শ্রাবণী বলেছিল, নির্ঝর শোনামাত্রই যেতে রাজি হয়ে গিয়েছিল।
ওরা যখন ম্যামের বাড়িতে এসে পৌঁছল ঘড়িতে তখন প্রায় সাড়ে পাঁচটা বাজে।
ম্যামের বাড়িতে ঢুকে ওরা দেখল অনন্যা ম্যামও ওখানে আছেন। জয়িতা সেন তাঁর আর অনন্যার মাঝেই শ্রাবণীকে ডেকে নিলেন। নির্ঝর চলে গেল তুষার সেনের স্টাডিরুমে।
জয়িতা ম্যামের ঘরে শ্রাবণী একটা চেয়ারে কিছুটা জড়সড় হয়ে এসে বসল। কিছক্ষণ কথাবার্তার পরেই অনন্যাম্যাম পাশের ঘরে চলে গেল। জয়িতা ম্যামের কাছে শ্রাবণী তার পড়াশোনার ব্যাপারে যা যা জিজ্ঞাস্য ছিল সেগুলো মিটিয়ে যখন নির্ঝরকে ডাকতে এলো, তখন নির্ঝর মন্ত্রমুগ্ধের মতো তুষার সেনের নতুন লেখা অর্ধ সমাপ্ত উপন্যাসটিতে চোখ বোলাচ্ছে। আর মাঝে মাঝে স্বগোতক্তি করছে, ‘কী সুন্দর লিখেছ গো দাদা! দারুণ লাগছে পড়তে।’
ক্রমশ…