সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সোনালি (পর্ব – ১০৮)

রেকারিং ডেসিমাল

রেকারিং ডেসিমালের ওই সুবিধে।
একটা ফুটকি দিয়ে রেখে আবার পাশের গল্পের গলিতে ঘুরে আসা যায়।
বেনারসি গলিতে ঘুরতে ঘুরতে মন ফিরে এলো কলকাতার হেমন্তের উত্তুরে হাওয়ার গল্পে।
পনেরোই নভেম্বর।
বাবার জন্মদিন।
সেই যে, আমার বা’ মশাই, বলাই ভট্টাচার্য, ওরফে সন্দীপন চৌধুরী, বিদ্যার্থীরঞ্জন পত্রিকার জনক, সম্পাদক, সাহিত্যিক। অনেক প্রাইজটাইজ পাওয়া নাট্যকার, অভিনেতা। বেতারজগত পত্রিকা, নব কল্লোল , ইত্যাদিতে তাঁর অভিনয়ের ঝুড়ি ঝুড়ি প্রশংসা। অলইন্ডিয়া রেডিওর প্রফেশনাল অভিনেতা।
গানের গলা কেমন সে তো, আমি, আমার বর আরও গুচ্ছ মানুষ, ইস্তক আমার ছানারাও মুগ্ধ হয়ে রইল, সারা জীবনের জন্য।
আর সুরকার, গীতিকার ত বটেই।
অসাধারণ তবলচি, পন্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের প্রিয় শিষ্য, নিজের ও তবলচি শিষ্যরা আছেন।
কত বা বলি।
সব ছাপিয়ে এমন আনন্দময় সুগন্ধি মানুষ।
ইংরেজিতে প্রেসেন্স বলতে কি বোঝায়, এই মানুষটির কাছে যারা এসেছেন, সবাই বলতে পারবেন।

আমি এই ভেবেই সারা জীবন ধন্য হয়ে থাকি যে, জীবন মশাই, এমন একটি বাবা আমায় দিয়েছেন।

ওদিকে তাঁর সীমাস্বর্গ বাড়ির ইন্দ্রাণী, দীপালি দেব্যা, যাঁর রূপ গুনের গল্প এখনো লোকের মুখে, তিনি এক দিকে লক্ষ্মী ঠাকুর অন্য দিকে মেম সাহেব।
মায়ের অফিসে ছুটি থাকলেই, আমি ইস্কুল থেকে ফিরে দেখি, বিছানার ওপরে প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস, আর মোটকা অস্কার ওয়াইল্ড, কম্পলিট ওয়ার্ক্স খানা, শুয়ে। বাকি সব বইয়ের সাথে ঘুরেফিরে এই প্রিয় লেখনীতে ফিরে আসেন তিনি ।
আমাদের মেয়ে আজ এই মূহুর্তে, বাথ শহরে। জেন অস্টেনের বাড়িতে। মিস্টার ডার্সির পাশে, গাউন আর অস্ট্রিচের পালক লাগানো বনেট মাথায় দিয়ে ছবি পাঠাচ্ছে।
আমার মা মুচকি হাসছেন কোথাও বসে।
ওদিকে ছেলের বেশি পছন্দ, অস্কার ওয়াইল্ড। পিকচার অফ ডোরিয়ান গ্রে।

আমি দুই আলোকবর্তিকার আলো অঞ্জলি ভরে নিয়ে রাস্তা হাঁটি।
পরের প্রজন্মের দুই মানুষ, সেই আলো থেকে তাদের প্রদীপের শিখা জ্বালিয়ে নিয়ে পৃথিবীর অন্য অন্য প্রান্তে আলো জ্বালাবার ব্যবস্থা করে।
ভাবিনি ত কখনো, বাবা রোজ মজা করে অজস্র কবিতা, ছড়া, শব্দের ফুলকির মধ্যে কি বলে রাখলেন।
” পাটি গনিতের পাট করেছি লোপাট
বীজ গনিতের বীজ দিয়াছি ফেলিয়া
জ্যামিতিরে স্মৃতি পথে জ্যামুক্ত করিয়া
নির্লিপ্ত হয়েছি আমি অংক শাস্ত্র হতে… ”

আজ চব্বিশ বছর বয়েসে পৌঁছে সর্বজিৎ কত মাইল দূরে বসে শৈশবের বীজ থেকে গাছে ফুল ফোটাচ্ছে।
পাট দিয়ে হিসেবে করে মানুষ, বীজ গণনা দিয়ে গণিত চর্চা করা আমার দেশের ধারা, আর জ্যা আর ধনুকের ছবি, জ্যামিতিক মাপ, আজকের ” প্রট্র‍্যাক্টর” শেখায় জিওমেট্রি বাক্সের ভেতরে বসে, এমন ভাবে আমি কখনো ত বিশ্লেষণ করে ভাবিনি।
আমি শুধু আলোকে পৌঁছে দিয়েছি। ধরে রেখেছি।
বাবা মশাই, সেই রেখা ধরেই থেকে যাচ্ছেন। ছোটো মানুষ, নতুন সময়ের মানুষের কাছে।

দুই প্রজন্মের দুটি দুটি বুদ্ধিমান মানুষ, আর আমি মাঝখানে সেতু হবার আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে আছি।
মানুপুপুর বা, ভাগ্যিস তুমি ছিলে আমাদের নিয়ে।
হ্যাপি বার্থডে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।