সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সোনালি (পর্ব – ৭৫)

রেকারিং ডেসিমাল

লম্বা বারান্দা অনেক কাজে লাগে।
সাদা কালো চক মেলানো। পুরোনো বাংলা হিন্দি ফিলিমের সেটের মত।
মাঝে মাঝেই দাদুকে খেপায় নাতবউ।

কি বাড়ি বানিয়েছো দাদু, ধ্যুত।
চারটে মাত্র ঘর, মানুষ কমে গিয়ে ও, দশটা বারোটা লোক। আর কেউ এক আধ জন, তোমার মেয়ে জামাই এলেও বা থাকার জায়গা টানাটানি। ওদিকে সারা বাড়ি জুড়ে এত্ত বড় বারান্দা। এত জায়গা কেউ এ ভাবে নষ্ট করে?

হাসতেন ফোকলা মানুষটি হা হা করে।

আরে তুমিই বুঝছ না। কত বাচ্চারা বড় হল এ বারান্দায়। নটা ত আমারই। তারপর আমার শালাদের। অরুণকে ত দেখো ?
ওরা এগারো জন।
বউ মনে মনে ভাবে ফুটবল টিম।
এরা খেলা করবে, হুল্লোড় করবে, খোলামেলা রোদে বাতাসে, তবে না। ওরা বড় হল পরে ওদের ছেলেপুলে। আমার মেয়েদের জামাইদের সব নিয়ে নিমন্ত্রণ করেছে তোমাদের দিদা কত বার। এইখানে ঘুরিয়ে বসলে কত লোক বসে জানো?
আমার বাড়ির কোন কাজক্রিয়া , খাওয়া দাওয়া, পুজো, কখনো বাড়ি ভাড়া লাগেনি।
এর মজাই আলাদা।
এই দেখো না, তোমার বাচ্চাদের ও অন্নপ্রাশন জন্মদিন, এই বার আস্তে আস্তে বুঝবে।

বোঝেনা যে নাতবউ এমন না।
ওই। দাদুর পিছনে লাগার আনন্দ।

দৈনন্দিন জীবনে বারান্দায় সাঁতার কাটার নানান রকম জীব।

এক, যারা হাসপাতালের দিকে বাথরুমে চান সেরে অফিসে রওনা, সক্কাল সক্কাল।

দুই, যারা ছেলেরা অফিসে আর ছোটরা ইস্কুলে চলে গেলে স্নান সেরে ঠাকুরের কাজ করে তবে আবার রান্নাঘরে ঢুকবেন।
তাঁরা রাম তেরি গঙ্গা মইলির মন্দাকিনী বা সত্যম শিবম সুন্দরমের জীনাত আমান।
সাদা বা হালকা শাড়ি, স্যারং স্টাইলে এক ফেরতা দিয়ে ভিজে গায় পেঁচানো। অথবা একটি সায়া বুকের ওপর খালি গায়ে গিঁট দেয়া। বলতে নেই কেউ দুবলা পাতলা সুন্দরী না।
তিন, কাজের মেয়েরা, যাদের অন্যতম গায়ত্রীদি সারাক্ষণ এ ঘর ও ঘর, যাই বৌদি, যাই দিদা বলে দৌড়ে চলে।

চার, সাধারণত স্কার্ট আর টপ, কিংবা টি শার্ট পরিহিতা ঘঞ্জ চুলে টপ নট ছিপছিপে মানুষ। এত বেশি ঘন বলে, চুলগুলো থেকে থেকে ফস ফস করে খুলে পড়ে। তিনি আবার পেঁচিয়ে গুঁতিয়ে সে গুলো মাথার ওপরে তোলেন। পায়ে হাওয়াই চটি। শীত কালে গায়ে একটি চাদর জড়ানো। ইনি ফটর ফটর করে পৃথিবীর কি কি গভীর সমস্যার সমাধান নিয়ে চিন্তা করতে করতে সারাক্ষণ এদিক থেকে ওদিক, আবার ওদিক থেকে এদিক সর্বক্ষণ হেঁটে চলেন, ” দেবা ন জানন্তি কুতঃ মনুষ্যাঃ “। গণিতের কনস্টান্ট কে -র মত এনাকে বারান্দাতেই দিনের বেশির ভাগ সময় দেখা যায়।

পাঁচ, ছুটির দিনে, এই পরিব্রাজিকার একজন সঙ্গী থাকেন।
না না, ঠিক সঙ্গী না, সহযোগী ভ্রমণকারী।
ইনি যখন গেটের থেকে বাঙুর হাসপাতালের দিকে হাঁটেন, অন্য জন তখন হাসপাতালের দিক থেকে গেটের দিকে। অন্যদিকের দেয়ালে পৌঁছে দু জনেই এবাউট টার্ন করে উল্টো দিকে। সমান্তরাল নিঃশব্দে হাঁটা
দ্বিতীয় মানুষটি ছ ফুট প্রায় লম্বা, বেশ খানিক চওড়া, এবং একটি ঢোলা পাজামা পরিহিত, যেটি পেটের ওপরে প্রায় বুকের কাছে তুলে বাঁধা। তিনি অন্য পায়চারি পরায়নার দাদা।

এই মাকুর মত উল্টো উল্টো দিকে হেঁটে চলা ভাই বোনের মধ্যে, মিসাইল বা ছুঁচোবাজির মত ছোট বোনের আবির্ভাব ঘটে যখন তখন।
আর তাহলেই ব্যস।

বারান্দা রণক্ষেত্র।
দিদি বলবে, এই গাধা আবার ঘাসের খোঁজে কেন।
বোন বলবে, তুই কি, তুই কি।
তারপর আরও দু একটা লাইন চালাচালি।
তারপর পাশের দেয়ালের সঙ্গে চেপে ধরে দিদির গলা টেপার প্রবল প্রচেষ্টা, এবং দাদার হস্তক্ষেপ। মাঝেমধ্যে দিদার থামানোর চেষ্টা।
সব কিছুর ওপরে টিপে ধরা গলা থেকে বেরিয়ে আসা সাইরেনের মত আর্তনাদ।

খুব বেশিক্ষণ চললে, এদের মাতৃ দেবীর ফিল্ডে নেমে ধাঁই ধপাধপ্ করে দু জনকেই পিটিয়ে দেবার সম্ভাবনা থাকত। তাই, এই সব সময়ে বাড়ির বাকিরাও বারান্দায় নেমে পড়তেন দুই যুযুধান যোদ্ধাকে ছাড়ানোর জন্য।

এদের দেখে এদের বউমণি রোজই মনে মনে রবীন্দ্রনাথ আওড়ায় ।

হুঁ হুঁ, মোগল শিখের রণে, মরণ আলিঙ্গনে, কণ্ঠ পাকড়ি ধরিল আঁকড়ি দুই জনা দুই জনে।
বাবা, সাধে রবিবাবুকে লোকে গুরুদেব মানে?
কোথায় বসে কত দিন আগে এই রসা রোডের বাড়ির কথা লিখে গেছেন।

ভাবা যায়!!

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।