“গান ভালোবেসে গান” সংখ্যার গল্পে সোনালি

দরবারি

উত্তাপ ছড়াচ্ছে ।
পায়ের পাতা থেক ধীরে শিরশিরানি ছড়িয়ে পড়ছে গোড়ালি বেয়ে পায়ের গোছে , হাঁটুর পিছনের খাঁজে , উপরে সুডৌল জঙ্ঘায় , উপত্যকায় অরণ্যে, নাভিপদ্মের গভীরে, কে ফুটে উঠছে অলৌকিক আলোর পদ্ম হয়ে ?
দিশাহারা মেয়েটা ডূবে যেতে যেতে ভাবে, কোথায় এলাম আমি ? কোন অতলে তলিয়ে যাচ্ছি ? চেনা রাস্তায় ফিরব কি করে ?
কি এক আতংকে ছটফট করে উঠতে যাচ্ছিল । মনের ভেতরে বোধ বুদ্ধিরা বলছিল, এখনও সময় আছে, জেগে ওঠো, বেরিয়ে এস এই জাল ছিঁড়ে ।
পারল না ।
গরম আঙ্গুলের ছোঁয়া আর তরল আগুনের মত নরম এক জোড়া ঠোঁটের স্পর্শ ত্বকের প্রতি রোমকূপে কি মাদকতা ঢেলে দিয়ে অবশ করে ফেলেছে শরীর, মন, বোধ ।
ডুবে যেতে যেতে মেয়েটা ভাবে, আহা মৃত্যু, তুমি এত সুন্দর, কেউ ত কখনো বলেনি আমায় ।
চন্দনী । রাজস্থানের মেয়ে । রাজপ্রাসাদে আনাগোনা । অন্দরমহলে নানান কাজে ডাক পড়ে । অনেক সময় থেকেও যায় সহেলি রোশনির ঘরে । রোশনি বড় রানির প্রাসদের খাস লোক । রানির পুজো আচ্চার পাট সামলানোর দ্বায়িত্ব তার ।
চন্দনী ভাল গান গায় বলে রাজ ঘরানার মেয়েরা অনেক সময় আটকায় তাকে । নাচেও । ফুল মালা নিয়ে আসে বাইরে থেকে । এসে এখানেই খেয়েদেয়ে থেকে যায় অনেক সময় তাই ।
বিরাট প্রাসাদ । হাজার হাজার ঘর । কত লোক থাকে , হিসেব রাখতে হিমশিম খায় কোষাধ্যক্ষরা । তাও সব কিছুর হিসেব থাকে না ।
আজ রাজকন্যারা ঘিরে বসেছে চন্দনীকে ।
আসবার পথে দরবারের নাচের জলসায় উঁকি মেরে এসেছে কিনা সে ।
সবাইকে , সেই নাচেরই এক ঝলক দেখাচ্ছে কোমরে দুপাট্টা গুঁজে ।
আবছা সুর ভেসে আসছে বটে বাহির মহলের দিক থেকে ।
চন্দনী গলা মেলাচ্ছে সেই সুরে । সাথে পায়েলের বোল উঠছে ছম ছম ছম ছম ।
ছনন ছনন তোরি বাজে পায়েলিয়া —–
দ্রুত আরও দ্রুত চলছে লয়কারি । দরবারে , এর সঙ্গতে সেতারে ঝালায় ছুটছে সুর ।
মেয়েরা উল্লাসে হাততালি দিয়ে উঠছে চন্দনীর তালের সংগে ।
চলছে সুর আর তালের উন্মাদনা ।
হাঁফাতে হাঁফাতে চন্দনী এক ফাঁকে বলে , রাগ দরবারি ।
পরের দিন বাড়ি ফেরার সময় বাইরে থেকে প্রাসাদের দিকে নজর ফেরায় চন্দনী । অজস্র ঝরোখা । এক একটি এক এক রানির । ছাপান্ন জন রানি এখনকার রাজা মশাইয়ের ।
ছাপান্ন !
বিতৃষ্ণায় মুখ বেঁকায় চন্দনী ।
রাজা মশাই রসিক লোক । অন্দরের খেল মহলে শ্বেত পাথরের মেঝেতে বিরাট পাশার কোট পাতা আছে । চুন্নি পান্নার ঘুটীতে , হাতির দাঁতের অক্ষ ফেলে চাল দেন রাজা রানি । যেদিন রাজার সংগে পাশা খেলে যে জেতে , সেই নাকি মহারাজের মহলে নেওতা পায় রাত কাটানোর ।
থুঃ
মুখ ঘুরিয়ে থুতু ফেলে চন্দনী । এরা এই ভাবে পোষা পাথির মত খাঁচায় খাঁচায় বসে থাকে মাপের দানাপানি আর দয়ার দানে ? ছ্যা ছ্যা । নিজেদের কাছে নিজেদের কোন দাম নেই ?

যেতে আসতে চোখ যায় রাজদরবারের দিকে ।
সোনার মত রঙ । তীরের মত নাক । ঢালের মত কপাল । পাতলা খাঁজকাটা ঠোঁটে ছুরির মত ব্যঙ্গের হাসি ঝিলিক দেয় বেশির ভাগ সময় । ঠোঁটের ওপরে কুচকুচে কাল গোঁফের বাহার দেখার মতই ।
রাণা বাহাদুর ।
ওই যে অত অত রানির মালিক স্বয়ং ।
রাগে ব্রহ্মরন্ধ্র অব্ধি রক্ত উঠে যায় চন্দনীর ।
মনে মনে ভাবে , বেত্তমিজ , একে সবত শেখানোর মত একটাও মেয়ে নেই কি এত বড় অন্দর মহলে ?
সব রানিরাই দেখি ভিখিরির মত হাপিত্যস করে মরে , আজ কে জিতবে রে ? কার ডাক আসবে পাশা খেলতে ?
ছ্যাঃ মেয়ে নামের কংলঙ্ক সব ।
এক দিন বলেই ফেলল কথাখান । হিজড়া পাহারাওয়ালি সব থাকে অন্দরে , তাদের একজনকে ।
অন্দরমহল থেকে বাইরে বেরিয়ে চলে যাবার পথে পাশা খেলার ঘরখানার পাশ দিয়েই যাচ্ছিল চন্দনী । সে পাহারাওয়ালি তখন ঘুঁটি টুঁটি গুলো পরিষ্কার করে সাজিয়ে রাখছিল ফের ।
চন্দনীর ছ্যাঃ শুনেই ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছিল সে ।
তারপর বলল , বটে ছ্যাঃ কেন ?
চন্দনী লাল গনগনে মুখে চটে গিয়ে বলল , নয় ত কি ? আমি রানি হলে খেলায় জিতে , পেন্নাম ঠুকে নিজের ঘরে চলে যেতাম । বলে যেতাম , থাকুন আপনি নিজেকে নিয়েইন আজ , আমার কোন সখ নেই আপনার পালঙ্কে । এত ভাগাভাগির জিনিসের দামই ক পয়সা ? কে চায় তার সংগে থাকতে ? আমি ত না ।
গটগট করে চলে যেতে যেতে চন্দনী দেখতে পেল না , খোজা প্রহরিণী চোখে বিজলি জ্বালিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে তার দিকেই তাকিয়ে ।
সুন্দর রাজ পুরুষটিকে সে ও জান দিয়ে ভালবাসে ।
ডাক এল রাজঅন্তঃপুর থেকে । স্বয়ং মহারাজ নেমন্তন্ন করেছেন ।
পাশা খেলতে ।
রোশনি কাঁদতে থাকল চুপিচুপি এসে।
কি করেছিস হতভাগী ? যা মহারাজের পায়ে পড় । মাফি মেঙ্গে নে , প্রাণটা বাঁচবে হয়ত ।
সোনার হাতল দেওয়া রাজকীয় খঞ্জরের মত হাসি খেলে চন্দনী সুন্দরীর ঠোঁটে । চোখে বিদ্যুৎ ।
ভগবান বুঝি চোখ তুলে চেয়েছেন ।
জিতেছিল চন্দনী ।
মহারাজ বলেছিলেন আজ রাতে না বলে চলে যাবে সুন্দরী ?
—-জোর খাটাবেন , পুরুষ বলে ? তাতেই জিত হবে মহারাজ ?
—-কোন নারীর ওপর জোর খাটানোর প্রয়োজন হয়নি কখনও । তারা এমনিই পায়ের তলায় বন্দী থাকে ।
শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল মেয়েটা ।
একজোড়া পুরুষালি হাত পিছন থেকে আলতো করে অতি আদরে জড়িয়ে ধরবে ভাবেনি ।
গলতে গলতে শুধু ভেবেছিল , ডুবে গেলে হবে না । শেষ রক্ষা করতে হবে ।
এমন সবত শিখিয়ে যাব , ছাপান্ন কেন একশ হাজার মেয়ের শরীর পেয়েও ভুলতে পারবে না চন্দনীকে ।
শরবত বানিয়ে এনেছিল ঘর থেকেই । দুজনেই এক পেয়ালায় চুমুক দিয়েছিল চুম্বনের ফাঁকে ফাঁকে ।
বেহুঁশ রাজাকে পরের দিন রাজ বৈদ্য দেখে বলেছিলেন বিষ ক্রিয়া । তবে অল্প বিষ । বেঁচে যাবেন । নীল হয়ে পড়েছিল আদরে ভেসে যাওয়া তৃপ্ত চন্দনী ।
রোশনি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে এসে বলেছিল , আমায় চন্দনী বলে গিয়েছিল , কার যদি কোন বিপদ হয় এই রাগের মুখড়া শোনাতে ।
রানিরা ডেকে আনলেন রাজ গায়ককে ।
অচৈতন্য রাজার চেতনা ফিরল আলাপের সুরে —-
—মোরে বৈরন কান ভয়ে—–
দিশাহারা পুরুষটি বুঝতেই পারলেন না , একটা অতি সাধারন মেয়ে এমন দাগা দিয়ে গেল কি করে ?
বৈদ্য বললেন , ঠিক বটে , এ রাগ স্নায়ুকে সবল করে ।
এ যে রাগ দরবারি।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।