গদ্যের পোডিয়ামে রূপক সান্যাল

অন্য হিটলারের গল্প

হিটলার কারুর নাম নয়, ওটা একটা উপাধি। হিটলার বলতে আমরা যাকে চিনি তিনি এ্যাডল্ফ হিটলার, কিন্তু ওই একই উপাধিসম্বলিত আরো কিছু মানুষ ছিলেন যাঁরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং তার পরবর্তী সময়ে ওই উপাধির কারণেই পড়েছিলেন মহা বিড়ম্বনায়। তাদেরই একজনের নাম ছিল উইলিয়াম প্যাট্রিক হিটলার।

উইলিয়ামের বাবা অ্যালোইস হিটলার (জুনিয়র) ছিলেন এ্যাডল্ফ হিটলারের বৈমাত্রেয় ভাই অর্থাৎ এ্যাডল্ফ হিটলার ছিলেন সম্পর্কে উইলয়ামের সৎ-কাকা।

উইলিয়াম প্যাট্রিকের জন্ম ইংল্যাণ্ডের লিভারপুলে, ১৯১১ সালে। তাঁর ১৮ বছর বয়সে উইলিয়াম প্রথম জার্মানী ভ্রমণ করেন। তাঁর বাবা অ্যালোইস তখন সেখানে নাৎসী সরকারের অধীনে কর্মরত ছিলেন। তিনি সামরিক বাহিনীর একটি শোভাযাত্রায় ছেলেকে নিয়ে যান যেখানে উইলিয়াম প্রথমবার এ্যাডল্ফ হিটলারকে চাক্ষুস করেন।

এরপর ১৯৩০ সালে দ্বিতীয়বার উইলিয়াম জার্মানীতে গেলে এ্যাডল্ফের সাথে তাঁর সামনাসামনি পরিচয় এবং কথা হয়। ১৯৩১ সালে ফিরে আসেন উইলিয়াম,লেখেন তাঁর কাকাকে নিয়ে কয়েকটি নিবন্ধ, যেগুলি গ্রন্থ আকারে প্রকাশিত হবার পর থেকে ইওরোপের বিভিন্ন দেশ আর আমেরিকার পাঠকদের মধ্যে তাঁর নাম এবং লেখাগুলো বেশ পরিচিতি লাভ করে।

এই গ্রন্থটি এ্যাডল্ফ হিটলারের নজরেও আসে এবং তিনি সেগুলো পড়ে যথেষ্ট ক্রুদ্ধ হন আর পত্রপাঠ ভাইপোকে হুকুম দেন লেখাগুলো প্রত্যাহার করে নিতে। ওদিকে ইংল্যান্ডে ততোদিনে সকলেই জেনে ফেলেছে উইলিয়ামের আসল পরিচয়, অর্থাৎ তিনি এ্যাডল্ফ হিটলারের ভ্রাতুস্পুত্র। আর এই ‘অপরাধে’ ১৯৩২ সালে তাঁর চাকরি গেলো, ইংল্যান্ড সরকার তাঁকে ‘পার্সোনা-নন-গ্রাটা’ অর্থাৎ ‘অবাঞ্ছিত ব্যক্তি’ হিসেবে ঘোষণা করলো। বাধ্য হয়েই তাঁকে আবার চলে যেতে হলো জার্মানীতে।

এ্যাডল্ফ হিটলার তখন জার্মানীর চ্যান্সেলর, বিপুল ক্ষমতা তাঁর। উইলিয়ামকে একটা চাকরিও জুটিয়ে দিলেন তিনি, যেখানে উইলিয়াম বেশ কয়েক বছর ছিলেন, তারপর ছেড়ে দিয়ে যোগ দিলেন একটি অটোমোবাইল কোম্পানিতে। কিন্তু কাজ পছন্দ হয়নি বলে সেখান থেকেও বিদায় নেন।

ইতমধ্যে উইলিয়াম জানতে পারেন যে, যে এ্যাডল্ফ হিটলার এমন চূড়ান্ত ইহুদি বিদ্বেষী, তাঁরই ঠাকুরদা আদতে ছিলেন একজন ইহুদি বণিক। এই গোপন খবরটা তিনি সংবাদমধ্যমে ফাঁস করে দেবেন একরকম ভাবে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করলেন তাঁর কাকাকে, যাতে কাকার সাহায্যে আরও ভালো কোনও চাকরি আর পদ পাওয়া যায়।

১৯৩৮, এ্যাডল্ফ হিটলার ভাইপোকে প্রস্তাব দিলেন, সে যদি ইংল্যান্ডের নাগরিকত্ব ছেড়ে পাকাপাকি ভাবে জার্মানীতে চলে আসে তবে তিনি তাঁকে নাৎসী বাহিনীতে উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত করবেন। কিন্তু ইউলিয়ামের মনে হয়েছিল যে, এটা তাঁর জন্য পাতা একটা ফাঁদ। তিনি ইংল্যান্ডে ফিরে এলেন এবং “হোয়াই আই হেট মাই আঙ্কল” এই শিরোনামে একটি গ্রন্থ রচনা করলেন এবং ১৯৩৯–এ ‘লুক’ ম্যাগাজিনে তা ছাপাও হয়। জানা যায় যে, এই সময় উইলিয়াম ইংল্যান্ডের সেনাবাহিনীতে যোগ দেবারও চেষ্টা করেন, কিন্তু প্রত্যাখ্যাত হন। যদিও ১৯৩০ এর দশকের শেষের দিকটাতে তাঁর গতিবিধি অনেকটা ধোঁয়াশায় আচ্ছন্ন।

১৯৩৯-এ উইলিয়াম রাওনা হলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে। তিনি তাঁর কাকা এবং নাৎসী বাহিনী সম্পর্কে যতটুকু জেনেছেন সবটা শেয়ার করবেন এবং যুদ্ধে নাৎসীদের বিরুদ্ধে কাজ করবেন, এরকম অঙ্গীকার করে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে সুদীর্ঘ চিঠি লিখলেন এবং অনেক চেষ্টার পর তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে সক্ষম হলেন। অবশেষে ১৯৪৪-এ উইলিয়াম মার্কিন নৌবাহিনীতে যোগদান করলেন। তাঁকে নৌবাহিনীতে যোগ দেবার স্বপথ বাক্য পাঠ করালেন লেফটেন্যান্ট ক্রিস্টিয়ান ক্রিস্টোফারসন এবং তাঁর কর্মস্থল হলো নিউ ইয়র্ক। ১৯৪৭ পর্যন্ত তিনি সেখানেই বহাল ছিলেন।

যে প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে এতসব বর্ণনা করতে হলো এবার সেখানে অর্থাৎ উপাধির সেই বিড়ম্বনার প্রসঙ্গে আসা যাক।

যুদ্ধ শেষ। কিন্তু এর অনেক আগে থেকেই এ্যাডল্ফ হিটলার সারা পৃথিবীর কাছে ভিলেন। হিটলার বলতে মানুষ আর কারুকে চেনে না, শুধু ওই ভয়ানক ব্যক্তিটিকেই চেনে। ইউলিয়ামকে কেউ তাঁর নাম জিজ্ঞেস করলে ‘হিটলার’ শব্দটিতে এসে সবাই হোঁচট খায়। ক্ষোভে আর বিরক্তিতে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে, এই উপাধি পরিবর্তন করবেন। তাঁর নতুন নাম হলো উইলিয়াম প্যাট্রিক স্টুয়ার্ট হাউস্টোন। পরবর্তী সময়ে তিনি ওই নামেই পরিচিত ছিলেন।

১৯৮৭ সালের জুলাই মাসে নিউ ইয়র্ক শহরে মারা যান উইলিয়াম। তাঁর চারটি পুত্র সন্তান, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, তাদের কারুরই নিজস্ব কোনও সন্তান নেই। অনেকে বলেন যে, হয়তো তাঁরা চার ভাই যুক্তি করেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, তাঁরা এখানেই তাঁদের বংশধারার ইতি টানবেন। যদিও এই বিষয়ে কোনও কাগুজে প্রমাণ নেই। এই পরিবারটির গল্প একাধিক নিবন্ধকার এবং গ্রন্থকার তাঁদের রচনায় রেখে গেছেন।

[সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে এই রচনা।]

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।