।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় রুদ্র সুশান্ত

জ্ঞান ও দিব্য জ্ঞান উভয়ই থাকতে হবে

♦ জ্ঞানঃ-

হিন্দু ধর্ম শাস্ত্র মতে- বেদ শব্দের অর্থ জ্ঞান এবং সেটি ভগবান থেকে প্রকাশিত হচ্ছে, বেদ শাশ্বত ও অপৌরুষেয়, পরম জ্ঞান নিত্য ও কোন মানুষের দ্বারা রচিত গ্রন্থ নয়। হিন্দু ধর্মশাস্ত্র এমন-ই বলে। বেদকে জ্ঞানের আদি উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কোন বিষয় সম্পর্কে জানা থাকাটাই হলো জ্ঞান। জ্ঞান লাভ করতে হয়। প্রকৃতি, পুস্তক কিংবা আবিষ্কার থেকে জ্ঞান আহরণ করা হয়, ব্যক্তি বিশেষ নির্ভর করে কে কোন জ্ঞান নিচ্ছে।
Cambridge dictionary তে বলা আছে- “Understanding of or information about a subject that you get by experience or study, either known by one person or by people generally”.
আর উইকিপিড়িয়া বলছে- ” জ্ঞান বলতে কোন বিষয় সম্পর্কে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক শিক্ষা থাকাকে বুঝায়। এটা বহিঃপ্রকাশ ধরনের হতে পারে (যেমন ব্যবহারিক গুনাবালী সম্পন্ন বা অভিজ্ঞতা সম্পন্ন) অথবা বহিঃপ্রকাশ ধরনের নাও হতে পারে (যেমন কোনো বিষয়ে শুধু তাত্ত্বিক দিকটি বোঝা) এটা কম বা বেশি ফর্মাল বা নিয়মার্বতিতা সম্পন্ন হতে পারে।” আবার ‘Collins english dictionary’ জ্ঞানের সংঙা দিতে গিয়ে লিখেন- “Knowledge is information and understanding about a subject which a person has, or which all people have.”
মূলত এক কথায় বলতে গেলে জ্ঞান হচ্ছে কোন বিষয়ে পরিচিতি থাকা, কোন কিছু সম্পর্কে বা কারো বিষয়ে জেনে থাকা বা বুঝে থাকা, হতে পারে কোন কিছুর প্রকৃত অবস্থা, তথ্য, বিবরণ, বা গুনাবলী সম্পর্কে জ্ঞান থাকা, যেটি অর্জিত হয়েছে উপলব্ধির মাধ্যমে, অনুসন্ধানের মাধ্যমে বা শিক্ষা গ্রহণের ফলে অভিজ্ঞ হওয়ায় বা পড়াশুনা করে।(উইকিপিড়িয়া)

♦ দিব্য জ্ঞানঃ-

আমাদের (সনাতন ধর্ম) সৃষ্টতত্ত্ব-অনুসারে আমরা সদা-সর্বদা, সবসময়, সারাক্ষণ, প্রতিমুহূর্ত-প্রতিনিয়ত, নিরন্তর, অহর্নিশ, চিরকাল, দিবানিশি, অহোরাত্র, অবিরত, অবিরাম, সর্বক্ষণ, সর্বকালে- সর্বত্র, সর্বতোভাবে সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরের নিত্য দাস। ঈশ্বর প্রদত্ত জ্ঞাননুসারে নিজের স্বরুপ অর্থাৎ আত্মাকে দর্শন করার আত্মো-উপলব্ধিকৃত জ্ঞানকে দিব্য জ্ঞান বলে। যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা আমাদের স্বরূপে অধিষ্ঠিত হতে পারব ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা প্রকৃত শান্তি লাভ করতে পারব না, তারমানে দিব্যজ্ঞান প্রাপ্তি না ঘটা পর্যন্ত মানুষের পূর্ণমুক্তি সম্ভব নয়।
অদ্বিতীয় এবং এক ঈশ্বরের আরাধনা, প্রার্থনা, ভজনা করে এই মহা দিব্যজ্ঞান লাভ করতে হয়। “ব্রহ্ম সংহিতা” বলছে–
“অদ্বৈতম-অচ্যুতম-অনাদিম-অনন্তরূপম
আদ্যং পুরাণপুরুষং নবযৌবনঞ্চ
বেদেষু দুর্লভম-অদুর্লভম-আত্মভক্তৌ
গোবিন্দম-আদি পুরুষং তমহং ভজামি …”
ব্রহ্ম সংহিতা (৫/৩৩)
অর্থঃ- “যিনি অদ্বৈত, অচ্যুত, অনাদি, অনন্তরূপসম্পন্ন, আদি পুরাণপুরুষ হয়েও নিত্যনবনবায়মান যৌবনসম্পন্ন সুন্দর পুরুষ, বেদাদি শাস্ত্র পাঠে দুর্লভ কিন্তু শুদ্ধ আত্মভক্তির লভ্য, সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি.”
অনাদি-অনন্ত, অসীম, অশেষ, অপার-অক্ষয় ভগবানের কাছ থেকে দিব্যজ্ঞান প্রাপ্ত হলে ব্যক্তি জীবনের পাপের বিনাশ ঘটে, এবং ক্রমে দিব্যধাম প্রাপ্তি ঘটে। আমরা সদাসর্বদা সবসময় ভগবানের নিত্য দাস । সৃষ্টির শুরুতে ভগবান কি করে কিভাবে এই জ্ঞান (দিব্যজ্ঞান) ক্রমেক্রমে, কালেকালে, ক্রমান্বয়ে, উত্তরোত্তর, ধারাবাহিকভাবে মানুষের কাছে পৌঁছে দেন “ব্রহ্ম সংহিতা”য় এ নিয়ে বলা আছে। (ব্রহ্মা পরমেশ্বর ভগবানকে অন্তরে ধারণ করে এবং ভগবানকে জেনে ভগবান সম্পর্কে যে কথাগুলি বলে গেছেন সেটি হচ্ছে “ব্রহ্ম-সংহিতা”) ব্রহ্ম সংহিতায় দিব্যজ্ঞান প্রদানের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে- “প্রথম সৃষ্ট জীব ব্রহ্মাকে ভগবান স্বয়ং এই
দিব্য জ্ঞান দান করেন, ব্রহ্মা সেই
দিব্যজ্ঞান দান করেন তাঁর পুত্র নারদ মুনিকে, নারদ মুনি সেই জ্ঞান দান করেন ব্যাসদেবকে, ব্যাসদেব তা প্রদান করেন মর্ধ্বাচার্যকে। এইভাবে গুরু-শিষ্য পরম্পরা ধারায় এই দিব্যজ্ঞান প্রবাহিত হচ্ছে।” সুতরাং “ব্রহ্ম সংহিতা” মতে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায় যে- সৃষ্টির আদিতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রথম সৃষ্ট জীব ব্রহ্মাকে ভগবান স্বয়ং এই দিব্য জ্ঞান দান করেন। ব্রহ্ম থেকে কালে কালে এই মহান শাস্ত্রীয় দিব্যজ্ঞান মানুষ কাছে এসে পৌঁছায়।
এই দিব্যজ্ঞান প্রাপ্তির উপায় কি? মানুষ এই মানব জীবনপথে ভুলের সাগরে ভেসে চলেছে। কতজনের-ই বা আত্মোৎকর্ষ সাধন হয়? কতজনের-ই বা আত্মোপলব্ধি আসে? বর্তমানে হিন্দু সমাজ গুরুবাদে বিভক্ত, সদগুরুর সরণাগত হয়ে দিব্যজ্ঞান লাভ করা যায়, কিন্তু সদগুরু কে বা কারা? (এই বিশ্লেষণে আজ গেলাম না, সদগুরু বর্ণনা, বন্দনা, পরিচয় আরেকদিন লিখবো)। এই দিব্যজ্ঞান প্রাপ্তির উপায় হচ্ছে শ্রীগুরুদেবের যুগল চরণে নিজের আত্মোৎসর্গ করা। গুরুদেবের কাছ থেকে শিষ্য এই জ্ঞান প্রাপ্ত হন, যথাসময়ে শিষ্য গুরু হয়ে তাঁর শিষ্যকে সেই জ্ঞান দান করেন, তাঁর শিষ্য আবার কালক্রমে গুরু হয়ে তাঁর শিষ্যকে এই জ্ঞান দান করেন। (এখানে সেইসব শিষ্য দিব্যজ্ঞান প্রদান করার ক্ষমতা রাখেন, যাঁদের দিব্যজ্ঞান প্রাপ্তি হয়েছে, ব্রহ্ম সম্পর্কে যাঁরা জেনেছেন এবং বৈদিক জ্ঞানে যাঁরা বিজ্ঞ, আপনি আমি যে কেউ সদগুরু দীক্ষামন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে নিজে দিব্যজ্ঞানী দাবি করে নতুন শিষ্য তৈরীর উদ্দশ্যে প্রলোভিত হলে সেটা হবে নিকৃষ্ট মানের মূর্খামি এবং উৎকৃষ্ট মানের ভণ্ডামি, প্রথম শ্রেনীর নির্বুদ্ধিতার পরিচয়) এই গুরু ও শিষ্যের পারস্পরিক জ্ঞান প্রদান এবং গ্রহণের যে ক্রিয়া সেটিকে বলা হয় গুরু-শিষ্য পরম্পরা। গুরুশিষ্যের এই বৈদিক পরম্পরার মাধ্যমে স্বয়ম্ভু ভগবান প্রদত্ত দিব্যজ্ঞান কালে কালে মানুষের মাঝে পরিবেশিত আছে, পরিবেশিত হচ্ছে। দিব্যজ্ঞান নিয়ে “মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর” লিখেছেন-
“দেহো জ্ঞান- দিব্য জ্ঞান,
দেহো প্রীতি- শুদ্ধ প্রীতি,
তুমি মঙ্গল-আলয়। (তুমি মঙ্গল-আলয়)
ধৈর্য দেহো, বীর্য দেহো-
তিতিক্ষা, সন্তোষ দেহো-
বিবেক বৈরাগ্য দেহো-
এ পদ-আশ্রয়। (দেহ ও পদআশ্রয়)॥”
এটাকে বলা হয় “ব্রহ্মসঙ্গীত”
(সংকলন-বাঙ্গালীর গান (১৯০৫), সম্পাদক- দুর্গাদাস লাহিড়ী)
আবার আমাদের একদল হিন্দু বলছেন- কৃষ্ণকে জানা হলো দিব্যজ্ঞান, শ্রীকৃষ্ণ যেহেতু ভগবান শ্রীবিষ্ণুর রুপ সেহেতু কৃষ্ণ জ্ঞান লাভও দিব্যজ্ঞান হিসেবে ধরা হয়, এরপরও একটা বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, ইসকন শ্রী কৃষ্ণকে নিয়ে যে অতিরঞ্জন করছে সেসব ত্যাগ ছাড়া দিব্যজ্ঞান প্রাপ্তি সম্ভব নয়। ইসকন পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণকে যাত্রপালার নায়ক বানাতেও পারে, অহেতুক রাধা চরিত্র সৃষ্টি করে বিশ্বব্যাপী ইসকন শ্রীকৃষ্ণকে যুবক ও প্রেমিক হিসেবে উপস্থাপন করছে, যা পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের রুপ নয়, শ্রীকৃষ্ণলীলাকে ইসকন রাধাকৃষ্ণলীলা হিসেবে প্রচারিত, প্রসারিত করছে, যেটা হিন্দুদের সার্থে পরিত্যাগ করা উচিত। “ঋগবেদ” বলছে-
“ঔঁ তদবিষ্ণোঃ পরমং পদং সদা
পশ্যন্তি সূরয়ো দিবীব চক্ষুরাততম।
তদবিপ্রাসো বিপন্যবো জাগৃবাংষঃ
সমিন্ধতে বিষ্ণোর্যৎ পরমং পদম।।”
ঋগবেদ (১/২২/২০)
অর্থঃ- “পরমেশ্বর বিষ্ণুই হচ্ছেন পরম সত্য। সুরগন তাঁর পাদপদ্ম দর্শনে সর্বদাই উদগ্রীব। সূর্যের মতোই ভগবান তাঁর শক্তিরশ্মির বিস্তার করে সর্বত্র ব্যাপ্ত আছেন।”
সর্বত্র বিরাজিত, সর্বতোভাবে প্রকাশিত, সর্বত্রস্থিত পরমেশ্বর ভগবান শ্রীবিষ্ণু-ই সকল জ্ঞানের মূল জ্ঞান। এই উপলব্ধি থেকে ব্রহ্মত্ব অর্জন-ই দিব্যজ্ঞান।
আমাদের এই পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় জীবনযাপনে দিব্যজ্ঞান করার কোন সুযোগ নেই। (আপনি গভীরভাবে ভাবলে ও নিজে উপলব্ধি করলে আমার সাথে একমত হবেন) তবে কি আমরা দিব্যজ্ঞান লাভ করতে পারবোনা? শতভাগ পারবোনা, জানি। এই মনুষ্য জীবন নিয়ে আমরা বৈদিক মুণিঋষিদের মতোন আত্মোৎসর্গ করতে পারবোনা। তবে সবাই বৈদিক হিন্দু শাস্ত্র মেনে একাগ্রতার সাথে একাগ্রচিত্তে একসাথে বসবাস করে সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে নিজেরা সদগুরুর মাধ্যমে দিব্যজ্ঞানের অধিকারী হতে পারি, তবে বর্তমান বিশ্বে ঠিকে থাকার জন্য হিন্দুদের সামগ্রিকরুপে দিব্যজ্ঞানের চেয়ে দিব্যবিজ্ঞান বেশি প্রয়োজন।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।