T3 শারদ সংখ্যা ২০২২ || তব অচিন্ত্য রূপ || বিশেষ সংখ্যায় রাই পারমিতা আইচ

ঐকতানের সুর

পেল্লায় সুদৃশ্য বাড়িটা বারো গ্রামের একটাই জমিদার বাড়ি। যতোদূর দৃষ্টি যায় এমন বাড়ি সকলের নজর কাড়ে। স্নেহসুলভ জমিদার কত্তা-গিন্নী অভিভাবকের সন্মান পান প্রজাদের থেকে। তার যথেষ্ট কারণ আছে। প্রজাদেরকে আগলে রাখেন যেমন লতিয়ে ওঠা নরম কান্ডকে আশ্রয় দেয় কাষ্ঠল কান্ড। বারোমাসে তেরোপার্বণ উনিশ-পুরুষের জমিদারিতে মহা ধুমধামে পালিত হয় এখানে। পার্বণের কদিন কারও বাড়ি হাঁড়ি চড়ে না।

শ্যামলিমা প্রকৃতি, ভেকের আনাগোনা, আকাশের গুড়ুগুড়ু ডাক শেষ হলে…প্রকৃতি অন্যসাজে মেলে ধরে নিজেকে। তুলোট মেঘের সারি। নদীর চড়, মাঠঘাট আকাশছোঁয়া লকলকে কাশের বিছানায় চলে বক-পাখপাখালির যাতায়াত। শিউলির সুগন্ধি ভোর। পদ্ম, কদম আরো রঙিন ফুলে সেজে প্রকৃতি জানান দেয় পুজো উপস্থিত। গ্রামের ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়ে গুলোর মজা বেড়ে যায় বহুগুণ। ওবাড়ি থেকে দেওয়া নতুন জামা পরে সকলে পুজোতে যাবে। অঞ্জলি দেবে। বিধুজ্যেঠার ঢাকের বাদ্যি, কাঁসর আর উলুধ্বনিতে ভরে উঠবে ঠাকুরদালান।

পুজোর কদিন চলবে সারা গ্রামের খাওয়া দাওয়া। গ্রামজুড়ে মেলা হবে, শহুরে জিনিসের সারি, নাগরদোলা… সে মজার জন্য ওরা অপেক্ষমান থাকে বছরভর। আনন্দের আতিশয্যের মধ্যেই বেজে ওঠে মন খারাপ করা দশমীর সুর। এঁয়োরা সিঁথিতে সিঁদুর রাঙিয়ে ঠাকুরকে বরণ করে নেয়। পরের বছরে আসার নিমন্ত্রণ জানিয়ে , তারপর বাড়ির পেছনের নিজস্ব পদ্মপুকুরটাতে মা’কে ভাসান দেওয়া হয়।

রাজনাথের ছোটছেলে ধীমান গ্রাম থেকে যেদিন শহরে ডাক্তারি পড়তে গেল,জমিদার গিন্নির সাথে দুর্গতিনাশিনির উদ্দেশ্যে সারাগ্রাম জোরহাত কপালে ঠেকিয়েছিল। এমন গ্রামে ডাক্তার অপ্রতুল। কাজেই ধীমান পড়ে এলে তাদের সুরাহা হবে।

প্রকৃতির নিয়মে বছর ঘোরে। ধীমান কলকাতার পড়া শেষ করে আজ বহুবছর পাড়ি দিয়েছে বিদেশে। গ্রামের অপ্রতুলতায় ফেরার কোন ইচ্ছে প্রকাশ করেনি। চোখের বালি সইকে ছোট্টবেলার দেওয়া কথা অগ্রাহ্য করে, যেদিন শুনলেন ধীমান দোসর করেছে এক মেমবৌ, পাকাপাকি থাকার ব্যবস্থাও তার বিদেশেই। সেদিন রাধারাণীদেবীর থেকেও আঘাতে ভেঙ্গে পড়েছিলেন রাজনাথবাবু।পরিবারের ঐতিহ্য ভুলে শেষে ম্লেচ্ছ! পুত্রশোকে সেই পুজো স্থগিত করেছিলেন তিনি। মনেমনে তাকে ত্যাজ্যপুত্র করার সিদ্ধান্তও নিয়েছিলেন।

একে একে বয়ঃজ্যেষ্ঠরা এরপর চলে গেছেন। এখন ঠাকুরদালানের গিরিজা বেঁচে আছেন শুধু ঘটে। ” সেই ছোট থেকে তোমার বাড়ির ঢাক বাজানোর ইচ্ছেটা রয়েই গেলো কত্তাবাবু, একটিবার সুযোগ দাও দেকি!” বিধুঢাকির ছেলে জোয়ান ভানু জমিদারবাবুর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে।

×××××××

এ বাড়ি আগলে সারাবছর এখন পড়ে থাকেন এই অসমর্থ প্রবীণ মানুষদুটো। ঠিক দা’মশাইয়ের লাগানো একটেঁরে তালগাছটার মতো। কয়েক প্রজন্ম গড়িয়ে গেলো এখনো একভাবে আছে। শুধু ছায়াটা লম্বা হয়েছে একটু। আর আছে রুনু বোষ্টমী। চুলে তাদের সকলের সোনালীরেখা। চোখের দৃষ্টিও আংশিক ঘোলাটে। তবু এ চাতালে বেলা পড়লে বোষ্টমীর কিছু শুনিয়ে যাওয়া চাই। চওড়া কপাল থেকে উন্নত নাসিকা অবধি রসকলি কেটে দেয় রোজ। মনমরা কত্তাগিন্নির কাছে বসে, ঠাকুর বিসর্জনে নিজের তলিয়ে যাওয়া মরা ছেলের শোক উথলে ওঠে গলায়। “জানো মা ঠাকরুণ কেউ কিছু ভোলেনা। ছেড়ে যায় না, বিদেশ তো কি ওর ও প্রাণপাখি ছটফট করে। তোমরা বোঝ না।”

ছেলেমেয়ে নাতিনাতনিদের সাথে বছরে একবার দেখা হওয়াই এখন অভ্যাস। অশ্বত্থ গজানো একাকী বাড়িতে যেনো ছেড়ে যাওয়া বয়ঃজ্যেষ্ঠদের অলৌকিক উপস্থিতি ঘুরে ফেরে শুধু।

×××××××××××

বিগত বসন্তদের চোখে ধুলোর পালক বুলিয়ে সময় উপস্থিত হয়। তাই সেই দুর্গাপুজোর তোড়জোড় আবার ফিরিয়ে এনেছে রাজনাথবাবুর পরবর্তী প্রজন্ম, বাড়ির বড় ছেলে। এখন প্রতিমা তৈরী থেকে থেকে পুজোর তোড়জোর শহুরে ছোঁয়ায় বদলেছে প্রায় সবটুকু। আনন্দ যাপনে এসেছে দ্বিগুণ গতি। এ-কদিন জ্যাঠতুতো, পিসতুতো ভাইবোনেরা একত্রিত হয়। সপরিবারে এসে হৈ হুল্লোর করে, চলে দেদার আড্ডা। থাকার যদিও কোন অসুবিধা নেই, বরং সারাবছরের ঝুলধুলো সরিয়ে তালাবন্ধ নির্জীব ঘরগুলো একটু খুশীর ছোঁয়া পায়।

ঝাড়বাতি,পুজোমণ্ডপ, ঠাকুরদালানের সাজ, ঠাকুরের সোনার গহনা, পিতল-রুপোর বাসনের ব্যবহার এসবের দায়িত্ব গিন্নিমার। রান্নার মেনু পরিকল্পনা, হিসেব রাখা, বাজারের তদারকি সবকিছু দেখাশোনার দায়িত্ব স্বয়ং রাজনাথের। ওনারা দুজনেই এখন সে দায়িত্ব ভাগ করে দিয়েছেন। ঢাকি ও মৃৎশিল্পী পরিবারের বাঁধা।

” ওহে গৌড়, তাড়াতাড়ি হাত চালাও বাবা, আরেকবার দেখিয়ে দাও তোমার হাতের কারুকুরি। দেখিয়ে দাও মাটির তাল আজও কথা বলে তোমার হাতে। কাল যে পঞ্চমী। ”

“ভরসা করেন কত্তা, সব তৈরী হইয়া যাইবো। ” অশক্ত কাঁপা হাতে সাধ্যাতীত চেষ্টা চালাচ্ছে গৌড়খুড়ো।

সকাল হতেই আগমনীসুর বেজে উঠেছে। এতোদিনে যেনো গুমড়ানো মেঘ সরিয়ে সূর্যের হালকা সোনালী আভায় ভরে উঠছে আনাচকানাচ। আজ বাদে কাল বোধন। পুরোহিত মশাই এসেছেন। শেষ সবকিছু গোছানোর জন্য। পুজোর জোগাড়, রেকাব সাজানো, পদ্ম ফোটানো, কুচোফুলের সজ্জা, এখনো একাহাতে করেন রাধারাণীদেবী। আজ ও করছেন যন্ত্রের মতো। মুখে শুধু হাসির অভাব। পঞ্চমী থেকে বাড়িতে নবমী অবধি নিরামিষ ভোজন। এ বাড়ির এটাই নিয়ম।

ছাদে চলছে তার আয়োজন লুচি, সুজি, পোলাও, পায়েস নানা পদের গন্ধে ভরছে আকাশ-বাতাস। পেছন দালানে মায়ের ছিয়ানব্বই পদে ভোগের ব্যবস্থা হবে কাল থেকে। রাধারাণী যান্ত্রিকভাবে করে চলেছেন তার তদারকি।

×××××××××××
থেকে থেকেই ছেঁড়া পাতার মতো মনে একরাশ কালো মেঘ ঘিরে ধরছে।

তিনতলার বারান্দা থেকে ভীষণ জড়োসড়ো হয়ে সব দেখছে ধীমান ও অ্যানিফ্র্যাঙ্ক। ওদের কোন তাড়াহুড়ো নেই, নেই আরো অব্যক্ত অনেক কিছু। মুখে হাসিটাও বড্ড কম। দূরত্বের সুতোয় যেন অদেখা রক্তপাত চলছে দুপক্ষেই। নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কোথাও হারিয়ে গেছিল রাধারাণী …”মা, নথগুলো বার করে দিন,আজ থেকে পড়তে হবে যে।” বড়বৌয়ের ডাকে হুঁশ ফিরলো রাধারাণীর। তড়িঘড়ি রাধারাণী ব্যাথা পা নিয়েই সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলেন দোতলায়। আলমারি খুলে প্রত্যেক বৌয়ের হাতে দেন নথগুলো।

“বাঃ! নতুন বেনারসি ও বাড়ির ঐতিহ্যময় গহনার সাজে তোমরা এক একজন যেন আমার সেই মা কাত্যায়নী।” বিরবির করে বললেন রাধারাণীদেবী।
নিজেও স্বল্প প্রসাধনীর সাথে নথটা পড়ে দৌড়য় দালানে, সময় অতিবাহিত হয়ে যাচ্ছে…।

ঘন্টাধ্বনি, ধূপ-ধুনো ঢাক কাঁসরের বোল সাথে নিজের সন্তানদের নিয়ে ভরা সংসার…এই তো মায়ের ঘর। ঠাকুরদালান থেকে চোখ ভরে দেখছেন রাজনাথ চৌধুরী। তবু মনের কাঁটাগাছটা যেনো সময়ে অসময়ে খচখচ করে বিঁধছে। বড্ড অব্যক্ত যন্ত্রনা বুকের মধ্যে অনুভব করছেন।

এখুনি মায়ের বোধন শুরু হবে। বড় বৌদির সাথে একপাশে আড়ষ্ট হয়ে নতুন ধুতি-পাঞ্জাবি ও বৌদির পড়িয়ে দেওয়া শাড়িতে অনভ্যস্তের মতো দাঁড়িয়ে শুধু ওরা, ধীমান আর অ্যানি। অ্যানিফ্র্যাঙ্ক ধীমানের সাথে আমেরিকার কালচারাল সেন্টারে পুজোয় সামিল হয়েছে বেশ কবার, তাই দুর্গাপুজোর ধারণা তার আছে স্পষ্ট। কিন্তু সে পুজোর সাথে এ পুজোটার অনেক পার্থক্য। এখানে প্রাণের স্পর্শ বড্ড আপন, যেন ছুঁয়ে যাচ্ছে তাকে। কি আন্তরিকতা।

এক্ষুণি অঞ্জলি শুরু হবে, মনক্ষুন্ন রাধারাণী বড়বৌয়ের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন “কিছু বলবেন মা”! রাধারাণীর মনে তখন উথাল পাথাল ঝড় চোখের কোণ ভেজাতে চাইছে। তবু অসহনীয় বিরক্তিতে কিছু বলতে যেতে নজরে পড়লো শাড়ি পড়ে , সিঁথি রাঙিয়েছে, পায়ে আলতার ছোঁয়া অ্যানির। মেয়েটার মুখটাও কেমন ঢলঢলে। রাধারাণী ভাবে মা হয়ে তার এমন বিচার হচ্ছে কি করে! ভেতরের ফলাশী পাখিটা খুঁটে খেতে চাইছে ইচ্ছেগাছের ফল। পরক্ষণেই চরম দোলাচলে ভুগছেন তিনি। নাঃ, না, পারছেন না কিছুতেই ক্ষমা করতে! এ অপমান কি ক্ষমাযোগ্য!

“রাণী একটু ভেতরে আসবে!” স্বামীর ডাকে হঠাৎ ঘরে যেতেই দোর বন্ধ হল সহসা। এমন হতচকিত ব্যবহারে বেশ কিছুটা সময় সবকিছু দমদেওয়া ঘড়িটায় মতো স্তব্ধ হয়ে গেল হঠাৎ। স্তম্ভিত হল সকলে।

×××××××××××

দরজা খুলে ধীর পায়ে নেমে আসছেন রাধারাণীদেবী। চোখের পাতায় লেগে আছে শেষ কান্নার প্রমাণ। তিনি থামলেন অ্যানিফ্র্যাঙ্কের সামনে। প্রথম চোখে চোখ মেলালেন। শাড়ির খুটটা দিয়ে দেওয়ালেন অপরিপক্ক হাতের ঘোমটা। ঐতিহ্যের নথটা পড়িয়ে দিলেন সকলের মতো। জড়িয়ে ধরলেন আবেগে। ঠোঁটের কোণায় চিলতে হাসি।

অঞ্জলির সময় উপস্থিত। রাধারাণী রেকাব থেকে ফুল নিয়ে হাত জোড় করিয়ে দিলেন। “শোন তোকে আমি অনি বলেই ডাকবো, ওসব ইংরেজি নাম আমি ধরতে পারবোনি”। সকলে সমস্বরে হেসে উঠলো। এই প্রথমবার ঠাকুরদালান থেকে নেমে অঞ্জলি দিতে হাসিমুখে পাশে এসে দাঁড়ালেন রাজনাথ। দুজনের চারচোখের মিলন হচ্ছে সামনের ত্রিনয়নীর শক্তিশালী দৃষ্টিতে। সত্যি তো কি করতে যাচ্ছিলেন তারা! সন্তানের দোষ তো মা’ই ক্ষমা করেন। মাটির তৈরী মায়ের যখন ধর্মে মাটির বিভেদ নেই, তখন চিন্ময়ী মা বিভেদ করার কে? এতোবছর বাদে গলার কাছে আটকে থাকা কাঁটাটা যেন সরে গেল। মন্ত্রগুলো মন হয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে শরীরকে, সতেজ করছে প্রাণ। এতোবছরে পুজোটা সার্থক মনে হচ্ছে রাধারাণী দেবীর। অদেখা সুতোর বন্ধনটা জুড়ে দিচ্ছে আবার হৃদয়গুলোকে। অনি জড়িয়ে ধরেছেন দেশীয় মাকে। বোষ্টমীর খুঁটির পাশে দাঁড়িয়ে চওড়া হচ্ছে হাসি। ” কেউ ভুলে যায় না…” মনে মনে বলে আর খঞ্জনীটা বাজায়। রাজনাথবাবু ততক্ষণে ঢাকিদের উদ্দেশ্যে আদেশ ছুঁড়েছেন ” ওরে আগমনী বোলটা আরো দ্বিগুণ জোরে বাজা রে দ্বিগুণ জোরে বাজা”। বাকি সোনালীদিনকটা এখনো যে আনন্দের অপেক্ষায়…।।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।