গল্পেরা জোনাকি তে রীতা পাল (ছোট গল্প সিরিজ)

বসন্ত পঞ্চমী
কলকাতা বিমানবন্দরে নেমে জেসমিন জোরে একটা নিঃশ্বাস নিল। বহু বছর পর জন্মভূমির গন্ধটা টের পেল। বাইরে এসে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে দমদম পার্কের দিকে রওনা দিল। ওখানেই ওর পৈত্রিক বাড়ি। গাড়ির জানলা দিয়ে দেখে বোঝার চেষ্টা করল এতগুলো বছরে শহরটা কতটা পাল্টেছে। কৈখালীর কাছে এসেই একটা ক্ষত আবার রক্তাক্ত হয়ে উঠলো। চোখে পড়ল রাস্তার ধারে একটা গলির মুখ,একঝাঁক ছেলে-মেয়ে হলুদ শাড়ি আর হলুদ পাঞ্জাবি পড়ে চুটিয়ে আড্ডা মারছে। ইচ্ছে করে গাড়ির কাচটা নামিয়ে দিল। একটা অতীত হাওয়া মনটাকে ভাসিয়ে নিয়ে চলল পনের বছর আগে এক বসন্ত পঞ্চমীর রাতে।
সেদিনের সকালটাও ছিল এমনই রোদ ঝলমলে। গানের স্কুলে সবাই অঞ্জলি দিচ্ছে। জেসমিন হলুদ গাঁদা মুঠোয় পুরে একপাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। হঠাৎই অঞ্জলীর একমুঠো ফুল ওর মাথায় এসে পড়ল। বুঝতে বাকি রইল না এই কাণ্ড কার। মাথার থেকে ফুলগুলো নিয়ে কাঁচা হলুদ শাড়ির আঁচলের খুঁটে বেঁধে রাখল। দুপুরে খিচুড়ি ভোগ খাবার সময় জেসমিনের গা ঘেঁসে বসলো শুভ । একগাল হেসে বলল,“কি রে,পাত্তা দিচ্ছিস না যে ?”জেসমিন সবার দিকে একটু চোখ বুলিয়ে কপোট রাগ এর ভঙ্গিতে বলল,“কি করো কি শুভদা? সবাই দেখছে যে। তখন অঞ্জলির সব ফুলগুলো আমার মাথায় দিচ্ছিলে কেন? সরস্বতী ঠাকুর রাগ করবেন তো।”
“ দূর,তুই তো আমার সরস্বতী,তুই ই আমার লক্ষী,বুঝলি? তাই তো দিচ্ছিলাম।”
“বাজে বকো না। রাতে নাটক আছে না,সব ডায়লগ ভুলে যাবে।”
সন্ধ্যায় উদ্বোধনী সংগীত দিয়ে শুরু হল বসন্ত পঞ্চমীর উৎসব। শুভ মুগ্ধ হয়ে জেসমিনের গান শুনছিল। শেষ হল রবি ঠাকুরের রক্তকরবী নাটক দিয়ে।
গানের টিচার অন্তরাদি শুভকে ডেকে বললেন, “শুভ তুই যাবার আগে জেসমিনকে একটু ছেড়ে দিয়ে যাস।”
গলির মুখেই জেসমিনের হাতটা ধরল শুভ।
“কি ব্যাপার? আজ সারাদিন এড়িয়ে যাচ্ছিস।”
“ছাড়ো,হাতটা ছাড়ো শুভদা। কেউ দেখে ফেললে কি হবে বলতো!”
“দেখলে দেখবে। তুই তো আমারই।”
“এই সমাজ কি মানবে! তোমার আমার ধর্ম আলাদা”
আকাশে শুক্লা পঞ্চমীর চাঁদ। শুভর গরম নিঃশ্বাস জেসমিনের ঘাড়ে পড়ছে। এক জোড়া ঠোঁট ডুব দিচ্ছে উষ্ণতার গভীরে।
“তুই পারবি আমাকে ছেড়ে যেতে?”
“কি করি বলো? বাবা ব্যাঙ্গালোরে বদলি হচ্ছে। ওখান থেকেই জার্নালিজমটা কমপ্লিট করব। তুমি আমাকে ভুলে যাবে না তো শুভ দা?”
গাড়িটা জোরে ব্রেক কষল। গাড়ির ড্রাইভার মুখ ঘুরিয়ে বললেন,“ম্যাডাম কিছু বললেন? দমদম পার্ক এসে গেছি। কোন গলি তে ঢুকব?”
জেসমিন গাড়ি থামাতে বলল। গাড়ি থেকে নেমে ভালো করে গলিটা দেখল। ড্রাইভারের টাকা মিটিয়ে পায়ে পায়ে গলির দিকে এগিয়ে গেল। খানিকটা দূরে দেখল এক তরুণ তরুণী হাত ধরে গলি পেরিয়ে দিগন্তের দিকে হেঁটে চলেছে। জেসমিন অনেক চেষ্টা করেও ওদের ছুঁতে পারছে না।