সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে রীতা পাল (পর্ব – ১০)

যাও পাখি দূরে

সবিতা দেবী আজ আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারলেন না। সোজা মেয়ের ঘরে ঢুকে গেলেন। কুমারী হেলান দিয়ে আগের মতই বইয়ের তাক টার দিকে তাকিয়ে বসে আছে। সবিতা দেবী এসেই দুই হাত দিয়ে ঝাঁকিয়ে বলল,“ আজ তোকে বলতেই হবে কে এমন সর্বনাশ করেছে তোর? এইজন্যই তুই চুপ করে আছিস? তুই ইচ্ছা করেই এসব করছিস। তোর কিছুই হয়নি। ”— বলেই কুমারীর গালে ঠাস ঠাস করে চড় মারতে লাগলেন। প্রথমে আয়া মাসি হকচকিয়ে গেছিল। সবিতা দেবীর হাত দুটো চেপে ধরে বলল,“ ও দিদি,ওকে অমন করে মেরো না। ওর সব হারিয়ে গেছে। তুমিও যদি এমন করো মেয়েটা বাঁচতে তো ভুলে যাবে!” “ মরুক। ওর মরাই ভালো।”– বলেই থমকে গেলেন। রাগের বশে একি বলে ফেললেন! এই প্রথম দেখলেন কুমারীর চোখ দিয়ে এক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল। কিন্তু চোখের দৃষ্টি সেই বইয়ের তাকের দিকে। সুমিতা দেবীর বুকটা ছ্যাৎ করে উঠলো। ভালো করে বুকসেলফটার দিকে তাকালেন। ওখানে এক কোণে ওর ছোটবেলার পুতুলটা সাজানো আছে। যেটা নিয়েও ছোটবেলায় খেলত,স্নান করাতো,ঘুম পাড়াতো,কোলে নিয়ে ঘুরতো। সবিতা দেবী বুকসেলফের দিকে এগিয়ে গেলেন। রং চটা পুতুলটা কুমারীর কাছে আনতেই ছোটবেলার মতো দু’হাত বাড়িয়ে পুতুলটাকে নিয়ে নিল। সবিতা দেবী ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লেন। মনে মনে ভাবলেন- তবে কি নিজের শরীরের পরিবর্তন ও বুঝতে পারছে? ওকি সব বুঝতে পারছে?
আয়া দিদি সবিতার সামনে এসে বলে,“ দিদি চলো,চোখে-মুখে একটু জল দেবে। বনের পশুরাও মাতৃত্ব বোঝে। আর ও তো জলজ্যান্ত একটা মানুষ।” সবিতা দেবী ধীর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
কলিং বেলের আওয়াজ হতেই সবিতা দেবী দরজা খুলে দেখে সন্ধ্যা। “ আয়” বলেই পিছন ফেরে। সন্ধ্যা বুঝতেই পারছে সবিতার রাগ, ক্ষোভ,যন্ত্রণাটা কোথায়? পুরনো সই এর পিছন পিছন সন্ধ্যা ড্রইং রুমে যায়। সবিতা সন্ধ্যা কে বসতে বলে আয়া দিদিকে বলে,“ একটু চা করবে?” সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে বলে,“ বল কি বলতে চাইছিস? অলোক কিছু জানে না,কুমারীকে ও বন্ধুর মতন দেখতো, এই সব বলবি তো? আসলে তোর রক্ত তো, আর কত ভালো হবে! সেদিনও দাদাকে ঠকিয়ে পয়সাওয়ালা স্টাবলিশড ছেলেকে বিয়ে করে নিয়েছিলি। আজও তাই, সুযোগ বুঝে কেটে যাওয়াটাই তো তোর স্বভাব। আমারই ভুল হয়েছিল। সাপের স্বভাব যে কখনো বদলায় না। তোর যদি মনে হয় আমাকে সহানুভূতির কথা বলতে এসেছিস তাহলে দরজা খোলা আছে। আর যেন কোনদিন তোর সাথে আমার দেখা না হয়।
” সন্ধ্যা মৃদু হেসে,“ একাই বলে যাবি?” আমার কোন কথাই শুনবি না? ফাঁসির আসামিরও শেষ ইচ্ছা শোনা হয়। বলার সুযোগটুকু আমায় দে। তোর মনে অনেক ক্ষোভ। তাই প্রথম থেকে শুরু করি। কোনদিন নিলয়দা কে জিজ্ঞাসা করেছিলি সত্যিই কি আমি নিলয়দাকে ঠকিয়েছি? আমরা কেউ কাউকে ঠকাইনি রে। দু’জনেই পরিস্থিতির শিকার। ও ওড়িশার ভুবনেশ্বরে পোস্টিং হবার পর একদিন আমাদের বাড়িতে ফোন করেছিল। তখন আমার বিয়ের সব ঠিকঠাক। তুই হয়তো জানতিস না। তোর দাদা তোর জেঠিমাকে আমাদের সম্পর্কের কথা বলেছিল। তোর জেঠিমা কিছুতেই রাজি হয়নি। কারণ তোর দিদির বিয়ে না দিয়ে উনি ছেলের বিয়ে দেবেন না। সেদিন আমরা দু’জন দু’জনের ভালোবাসাকে সম্মান জানিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমাদের তো আর কোন উপায় ছিল না রে। এবার বল, আমি কি বিশ্বাসঘাতকতা করেছি? আমাদের সম্পর্কটা পরিণতি পাইনি। কিন্তু আজও আমরা সেই ভালোবাসা নিয়ে বেঁচে আছি।

ক্রমশঃ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *