গল্পেরা জোনাকি তে রীতা পাল (ছোট গল্প সিরিজ)

নাগরদোলা

রক্তিমের হাতে প্রদীপটা দিয়ে সুলেখা বলে,“ যা,এটা মা’র ঘরে রেখে আয়। আজকে তেরাত। একটা বাতি দিয়ে রাখতে হয়। আমি কমলাকে দিয়ে এক গ্লাস জল পাঠিয়ে দিচ্ছি।” একরাশ বিরক্তি নিয়ে রক্তিম বলল,“ প্রদীপটা কমলা মাসিকে দিয়ে পাঠিয়ে দাও। এটা আবার আমায় কেন?
“সারা জীবন মেয়েটা জ্বলতে জ্বলতে শেষ হয়ে গেল। আজ তো সে আর নেই। আজ না হয় একটু প্রদীপটা জ্বালিয়ে দিলি।ওর আত্মার শান্তির জন্য। রক্তিম রক্তিম করেই তো শেষ হয়ে গেল।”
“ চুপ করো না মাসি। উনি নিজের জন্যই শেষ হয়েছেন। না কারো বউ হতে পেরেছেন না কারোর মা।”
কথাটা শেষ হতে না হতেই বেদশ্রী রক্তিমের হাত থেকে প্রদীপটা নিয়ে বলল,“ বড় মাসি,সোনামাসির ঘরে আমি রেখে আসছি।” প্রদীপটা নিয়ে রক্তিমের মা’র ঘরের দিকে চলে গেল। রক্তিম বেদশ্রীর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। সুলেখার দিকে তাকিয়ে বললো,“ যত উৎপাত এই বাড়িতে। মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি।” বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। সুলেখা চেঁচিয়ে বলল,“ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরো। মা নেই যে জেগে বসে থাকবে। আমি অত রাত অবধি জেগে বসে থাকতে পারব না।”
“ তোমরা শুয়ে পড়ো। আমি আমার সময়ে ফিরব।”
বেদশ্রী ঘরে জল আর প্রদীপটা রেখে মাসির কাছে এলো। “ দেখেছ মাসি! সোনামাসি মারা গেল তিন রাতও কাটল না। ছেলের হাবভাব দেখো? অমন মায়ের এমন পাষণ্ড ছেলে!”
“ না রে,ও তো অমন ছিল না। সঙ্গদোষ বুঝলি? আমরাই তো ওকে মানুষ করতে পারিনি।”
” আমরা তো সবাই সোনামাসির শিক্ষা,
আদর্শেই বড় হয়েছি। শুধু নিজের ছেলেই এমন হলো।”
“ শত্রু তো পেটেই হয় রে। তার সাথে তো আর যুদ্ধ করা যায় না। তার খারাপও চাওয়া যায় না। নাড়ির টান বুঝলি? মা হ তারপর বুঝবি।
তোর সোনামাসি তো তোর কাঁধে অনেক দায়িত্ব দিয়ে গেছে।” “ হ্যাঁ গো। জানি না কতটা পারব। তবে আমি শেষ অব্দি চেষ্টা করে যাবো। চলো,তোমার হাতে-হাতে একটু গুছিয়ে দিই। দাদু,রাতের খাবার খেয়েছেন?”
“ না। তুই আয় আমার সাথে। আমি বাবাকে একটু দুধ আর খই দিয়ে আসি। তুই খাটের তলা থেকে ফল মিষ্টিগুলো গুছিয়ে ফ্রিজে রেখে দে। ”
বেদশ্রী,রক্তিমের থেকে চার বছরের ছোট। একই পাড়ায় থাকে। ছোট্ট থেকেই ওর এই বাড়িতে যাতায়াত।
সোনা মাসির গান খুব ভালোবাসতো। তাই মাসির কাছে গানের তালিম শুরু করেছিল। পড়াশোনার সাথে সাথে গানটাও চালিয়ে গেছে। তাইতো সোনামাসির খুব কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিল। বেদশ্রী যতটাই কাছের হচ্ছিল রক্তিমের সাথে ঠিক ততটাই দূরত্ব বাড়ছিল। সোনাই অনেক চেষ্টা করেও ছেলের পড়াশোনায় মন বসাতে পারছিল না। উচ্চ মাধ্যমিকের রেজাল্ট খারাপ হওয়ার পরেই মা ছেলের তিক্ততা আরো বাড়লো। কোনরকমে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করল। তার আগে থেকেই সারাক্ষণ পাড়ার ক্লাবে আড্ডা আর কেরাম পেটানো। বারণ করেও কোনো ফল হয়নি। উল্টে মায়ের দোষ ত্রুটি ধরতে শিখে গিয়েছিল। কেন বাবাকে ছেড়ে চলে এসেছে? মায়েরই দোষ। সারাক্ষণ গান আর স্টুডেন্টদের নিয়ে প্রোগ্রাম করা। তার ছেলে আর কি হবে? একসময় সোনাই থেমে গেছে। সত্যিই আজ সে সবার কাছে হেরে গেছে। রক্তিম এখন পাড়ায় মাথা উঁচু করে হাঁটে। সোনাই মাথা নিচু করে হাঁটতো। কারণ ছেলে সিন্ডিকেটের মেম্বার। গরিবের স্বপ্নের বাড়ি ভেঙে বড় লোকের বস্তি তৈরি করে প্রমোটিং কোরে। কাউন্সিলরের খুব নাকি কাছের লোক। একবার সোনাই এর কাছে ব্যবসার জন্য টাকা চেয়েছিল কিন্তু সোনাই পরিস্কার জানিয়ে দিয়েছিল ওই ধরনের ব্যবসার জন্য অত টাকা তার কাছে নেই। তারপর নিজেই সব করেছে। মা,ছেলের কথা বন্ধ হয়েছে। বাবা অসুস্থ তাই সোনাই বাবার দিকে চেয়ে চেঁচামেচি করতে পারে না। ছেলের প্রতি অভিমান করেই এত তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া।
বেদশ্রী সব গুছিয়ে বড় মাসির ঘরে গেল। ঠিক তখনই জেঠুর গলা, “ বেদশ্রীমা,কোথায় রে?”
“ এইতো জ্যেঠু। বড় মাসির ঘরে,আসো। ”
“ বাড়ি যাবি না? অনেক রাত হয়েছে তো।” বেদশ্রী তাড়াতাড়ি বড় মাসির ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। জ্যেঠু তখন সোনা মাসির ঘরের চৌকাঠের কাছে দাঁড়িয়ে। প্রদীপের শিখাটা সোনামাসির ছবির উপর পড়ে কেঁপে কেঁপে উঠছে। বেদশ্রী জেঠুর হাতটা ধরে বললো,“ চলো।”
“ হুম,চল। ”
“ রঞ্জনদা,বসবে না?” বড় মাসি বলে উঠলো। “ না,আজ থাক। সব মিটে গেলে রক্তিমকে একবার বলো আমার কাছে যেতে। ওর মা কিছু দায়িত্ব আমাকে দিয়েছিল সেগুলো ওকে বুঝিয়ে দেবো। রক্তিম এখনো ফেরেনি?”
“ না,আচ্ছা,রক্তিম ফিরলে আমি বলে দেবো।”
এই তল্লাটের নামকরা উকিল রঞ্জন বোস। তারই ভাইজি বেদশ্রী। আজ উকিলবাবুকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে ভাইজি। জ্যেঠুর জল দিতে এসে দাঁড়িয়ে আছে পায়ের কাছে। রঞ্জন বাবু দেখে জিজ্ঞাসা করলেন,“ কিরে? কিছু বলবি?”
“ তুমি সোনাই মাসিকে বিয়ে করলে না কেন? সমাজের ভয়ে?”
রঞ্জন বোস দুঁদে উকিল হয়েও ঘাবড়ে গেলেন। বেদশ্রী তো জ্যেঠুর মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে না। আজ চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করছে। “ এসব তুই কি বলছিস?”
“ আমি সব জানি। তোমার সাথে সোনাই মাসির একটা সম্পর্ক ছিল বিয়ের আগে। সোনাই মাসির জন্যই তুমি বিয়ে করোনি। কেন জ্যৈঠু সোনাই মাসিকে এত তাড়াতাড়ি চলে যেতে হল?” ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল বেদশ্রী – – – । রঞ্জনবাবু মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,“ সবই যখন জানিস অযথা আমাকে প্রশ্ন করছিস কেন? যার যখন যাবার সময় হবে সে ঠিক চলে যাবে। আর সইতে পারছিলো না। তাইতো ভগবান তাকে কাছে ডেকে নিয়েছেন। আমরা কায়স্ত আর ওরা ব্রাহ্মণ। ওর বাবা অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক করলো। সোনাইও বাবার কথা মত বিয়ে করে নিল। বরটা ছিল চরিত্রহীন,লম্পট। অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে রক্তিমকে নিয়ে ফিরে এলো। গানের স্কুল করল। আমি আবার দ্বন্দ্বে পড়ে গেলাম। সোনাইকে অনেকবার বলেছি। ও রাজি হয়নি? বলেছিল,‘ বিয়ে করলে রক্তিম মানুষ হবে না।’ তবে আমার দোষটা কোথায়? ক্যান্সারের চিকিৎসা করালো না। বলতো, আমার দোষ কোথায়?”
বেদশ্রী নিঃশব্দে জ্যেঠুর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
মাসখানেক পর একদিন রক্তিম মদ খেয়ে বাড়ির দরজা খটখট করতে লাগল। কমলামাসি গজগজ করতে করতে সদর দরজা খুলে দিল,“ অনেক রাত হয়েছে দাদাবাবু,ঘরে যাও।” রক্তিম তো ঘরে যাবার অবস্থাতেই নেই। কোনরকমে উঠান পেরিয়ে ভুল করে মায়ের ঘরের দরজাটা খুলে শুয়ে পড়ল। কমলামাসি সদর দরজা বন্ধ করে শুতে গেল।
বেশ বেলায় রক্তিমের ঘুম ভাঙলো। জানলা দিয়ে আলো এসে পড়েছে ঘরের প্রতিটা ছবিতে। রক্তিম ভালো করে ছবিগুলো দেখছিল। মায়ের সাথে ওর ছোটবেলার ছবি। কতদিন পর এই ঘরটায় ঢুকেছে। ওর চোখ আটকে গেল একটা বড় নাগরদোলার ছবিতে। মায়ের তোলা ছবি একটা মেলাতে। মা বলত,‘ জীবনটা একটা নাগরদোলা রে রক্তিম। ওঠা আর নামা,হাসি আর কান্নার খেলা বুঝলি?’ কথাটা মনে পরতেই উঠে বসলো। মনে পরল গত রাতের কথা। ভুল করে মায়ের ঘরে শুয়ে পড়েছিল। বসে বালিশটা কোলে নিতেই, বালিশের তলায় একটা ফাইল চোখে পড়ল। হাসপাতালের ফাইল— গত পাঁচ বছর ধরে ক্যান্সারের সাথে লড়াই করছিল। আস্তে আস্তে দিন ফুরিয়ে আসছিল। যখন আর পারত না তখন হাসপাতালে যেত। ঠিকমতো ট্রিটমেন্টও করায় নি। বুকের কোনটা তে একটা চিনচিনে ব্যথা করে উঠল। ও তো কিছুই জানত না। আজ মনে হলো জীবন যন্ত্রনার কাছে ক্যানসারের যন্ত্রনা কিচ্ছু না।
ফাইলটা তাড়াতাড়ি বন্ধ করে উঠতে যাবে ঠিক তখনই রঞ্জন উকিলের গলা শোনা গেল,“ রক্তিম বাড়িতে আছো?”
কমলামাসি সোনাই এর ঘরটা দেখিয়ে দিল। “ আসুন—-,বসুন, কি বলবেন?”
“ তোমার মা। আমাকে কিছু দায়িত্ব দিয়ে গেছেন। তোমারটা তুমি বুঝে নাও।” রক্তিম মাথা নিচু করে বসে রইল। ঘরের নিস্তব্ধতা উকিলবাবুই ভাঙল,“ এই বাড়ির অর্ধেক তোমার মা’র। সেই সূত্রে এটি এখন তোমার। কিন্তু নীচে যে গানের স্কুলটি আছে সেটি তার এক প্রিয় ছাত্রীকে দান করে গেছেন। বর্তমানে সে এই স্কুলটি চালাবে। তোমার আপত্তি থাকলে অবশ্যই কোর্টে যেতে পারো। তোমরা সবাই যেটা জান,ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজে তোমার মা জানতে পেরেছেন তা কিন্তু নয় অনেকদিন ধরেই উনি জানতেন। চিকিৎসায় টাকা খরচ করেননি। তার সামর্থ্য অনুযায়ী ক্যাশ টাকা তোমার ব্যবসার জন্য রেখে গেছেন। ” উইলটা দিয়ে রঞ্জন বোস দায়মুক্ত হলেন।
সবাই চলে গেলে রক্তিম মা’র ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দিল। সারাদিন আর বেরোলো না।
সন্ধ্যায় বেদশ্রী প্রদীপ ধরিয়ে সোনামাসির ঘরের দিকে যেতেই, রক্তিম ওর হাত থেকে প্রদীপটা নিয়ে মায়ের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল – – –

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।