সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে রীতা পাল (পর্ব – ১)
যাও পাখি দূরে
সবিতা রায় বারবার ডাক্তার বাবুকে ফোন করছে কিন্তু ডাক্তারবাবু ফোন তুলছেন না। সবে দু’দিন হল মেয়ে হাসপাতাল থেকে এসেছে। উনি তো সাবধানেই রেখেছেন কিন্তু আজ দুপুরে খাওয়ার পর থেকেই বমি করছে। পরপর ওষুধ আছে খাওয়াতে হবে। কি করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। তাই বারবার ফোন করছেন। এমন সময় ডাক্তারবাবুর ফোন এলো। সবিতা রায় তাড়াতাড়ি ফোনটা ধরেই বলতে শুরু করলেন,“ স্যার,মেয়েটা সকাল থেকে তেমন কিছুই খাচ্ছে না। দুপুরে একটু ভাত আর হাল্কা মাছের ঝোল মেখে আয়া দিদি খাওয়াতে গেছে আর বমি করে একাকার। কি করব স্যার?” “ দেখুন তিনমাস টানা হসপিটালে থাকার পর বাড়ি গেছে,ওকে একটু সাবধানে রাখুন। ওর মাথার চোটটা সাধারণ নয়,ইন্ট্রাসেরিব্রাল হেমারেজ। তার ওপর মানসিক ক্ষতটা আরো সাংঘাতিক। সবটাই আমাদের অতি সাবধানে সারাতে হবে। আশাকরি পা টাও আস্তে আস্তে সেরে যাবে। কিন্তু সমস্যা ওযে কোনো কথা বলছে না। স্মৃতি ভ্রমও হতে পারে। এতদিন ওকে বাঁচানোর লড়াই চালিয়ে গিয়েছি। এবার চিকিৎসা ও সহানুভূতি দুটোই দরকার। আমি বমির ওষুধটা বলে দিচ্ছি খাইয়ে দেবেন। কাল আমাকে ফোন করে জানাবেন ও কেমন আছে। ওর সুস্থ হয়ে ওঠাটা আমাদের কাছে একটা চ্যালেঞ্জ। “
সবিতা রায় ফোনটা রেখে মেয়ে কুমারীর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন। ইউনিভার্সিটিতে পড়া মেয়ে,কত সুন্দর নাচ করত। কত জায়গায় প্রোগ্রাম করেছে। ওর ওড়িশি ডান্স দেখলে চোখ ফেরানো যায় না। পড়াশোনায় ভালো। একটা অ্যাক্সিডেন্টে কেমন সব ওলট-পালট করে দিল। অমন ফুটফুটে মেয়ে কোন কথা বলে না। মা বলে ডাকে না! শুধু ফ্যালফ্যাল করে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তিন মাস ধরে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে বাড়ি ফিরেছে। এখনও বেশ কিছুদিন হুইল চেয়ারে থাকতে হবে। পা না হয় ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু মেয়ে তো কারো সাথে কথা বলছে না। ওকি সব ভুলে গেছে? আবার বমি করছে। কি হবে মেয়ের! এইসব ভেবে দিনরাত এক করে ফেলছেন।
সন্ধ্যায় ডোরবেলটা বাজতেই সবিতা দেবী দরজা খুলে দেখলন অলোক এসেছে। অলোক,সবিতা দেবীর বান্ধবীর ছেলে। একটা এড্ এজেন্সিতে ভালো চাকরি করে। মাঝে মাঝেই বাইরে যায়। কুমারীর সাথে বেশ ভালোই বন্ধুত্ব আবার খুনসুটিও কম নয়। ওকে দেখে সবিতা দেবী একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলেন। অলোকের সাথে কুমারীর বিয়ের একটা কথা হয়েছিল। খুব ভালো ছেলে। কুমারীর মাস্টার্স কমপ্লিট হলে ওদের পাকা কথা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরীক্ষার শেষে এ কি ঘটে গেল! সবিতা দেবী কুমারীর ঘরটা দেখিয়ে দিলেন। বললেন,“ তুমি ওঘরে যাও অলোক। আমি চা করে নিয়ে আসছি।” অলক কুমারীর ঘরে ঢুকতেই কুমারী চোখ বুজিয়ে মুখটা ঘুরিয়ে নিল। অলোক কুমারীর মাথার কাছে গিয়ে বসল। আস্তে আস্তে কুমারীর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,“ তুমি খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠো। সেদিন খুব বড় ভুল হয়ে গেছে। আমি আর এমন কখনও করব না। আমরা আবার প্রথম থেকে শুরু করব। দেখো,সব ঠিক হয়ে যাবে।” কুমারী মাথা থেকে অলোকের হাতটা সরিয়ে দিয়ে পাশ ফিরে শুলো। সবিতা দেবী চা করে নিয়ে এলেন। অলোককে চা দিয়ে মেয়েকে জিজ্ঞাসা করলেন,“ কি রে,একটু চা খাবি?” মেয়ের নীরবতা ভাঙল না। সবিতা দেবী অলকের দিকে একটু তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। ঘরটায় অদ্ভুত এক নিস্তবদ্ধতা। দেয়ালে কুমারীর নাচের ফটোগুলো টাঙানো আছে। ঐ ফটোগুলোর সাথে বিছানায় লেপ্টে থাকা মেয়েটার যেন কনো মিল নেই। অল্প কিছুক্ষণ পর অলোকও ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। অলোককে দেখেই সবিতা দেবী প্রশ্ন করলেন,“ অলোক তোমার সাথে কুমারী কথা বলেছে?” “ না,মাসি। ও এখন একটা ঘোরের মধ্যে আছে। সবে তো দু’দিন হল বাড়ি এসেছে। দেখবেন আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। ওকে ঠিক হতেই হবে। মা বলেছেন কাল কুমারীকে দেখতে আসবে। আজ আমি চলি মাসি। সময় পেলে আবার আসব।” “আচ্ছা, আবার এসো বাবা। দুগ্গা দুগ্গা।” সদর দরজা বন্ধ করতে করতেই শুনলেন মেয়ের বমি করার শব্দ।
দিনে একটা আয়া আছে। রাতে সবিতা দেবী মেয়ের কাছেই থাকেন। স্কুল মাস্টার বাবা। যা জমানো ছিল সবটুকু দিয়ে মেয়েকে সুস্থ করার চেষ্টা করছেন। এখন ভগবানই ভরসা। এই তিনমাস যে কি ভাবে কেটেছে তা একমাত্র অন্তর্যামী জানেন। দিনরাত ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেছেন যেন মেয়েটা সুস্থ হয়ে যায়। একটাই সন্তান,বুকের মধ্যে সব সময় ভয় ছিল এই বুঝি হাসপাতাল থেকে খারাপ কোনো খবর এলো। এক একটা মুহূর্ত যেন পাহাড় সমান অপেক্ষা।
কুমারীর বাবা বাড়ি ফিরেই ডাক্তার বাবুর সাথে ওনার কি কথা হয়েছে সবিতা দেবীকে জানালেন- কাল হাসপাতালে যাবার আগে ডাক্তারবাবু একবার কুমারীকে দেখে যাবেন। সবিতা দেবী আস্তে আস্তে মেয়েকে রাতের ওষুধগুলো খাওয়ালেন। কিছুক্ষণ পর কুমারী ঘুমিয়ে পরল। সবিতা দেবীর কিছুতেই ঘুম আসছে না। মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। বারবার চোখের সামনে একটা নদী ভেসে উঠছে। যে নদীতে কতগুলো মুখ ভেসে যাচ্ছে….,.
ক্রমশ