সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে রীতা পাল (পর্ব – ৮)

যাও পাখি দূরে

রাতে সবিতা আর সন্ধ্যা এক খাটে শুয়ে গল্প করতে লাগল। সন্ধ্যা খুব সুন্দর রবীন্দ্র সংগীত গান করে। সবিতা খোলা জানলা দিয়ে রুপালি চাঁদ দেখছিল। হঠাৎ সন্ধ্যা কে বলল,“ এই,একটা গান শোনাবি? তোর গলাটা যা সুন্দর না! একেবারে কোকিলকণ্ঠী।”
“ আহা তোর গলা! আবৃত্তির দারুণ গলা তো!” দু’জনেই একসাথে হেসে উঠলো। সন্ধ্যা গান ধরল,“ আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে।” গান শেষ হতেই সবিতা সন্ধ্যা কে জিজ্ঞাসা করল,“ তোর বাড়িতে কে কে আছেন রে?” সন্ধ্যা পাশ ফিরে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললো,“ সবাই ছিলো,আজ আর কেউ নেই।”
“ সে কি কথা?”
“ আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি,একটা অ্যাক্সিডেন্টে বাবা মারা যান। বাবার চাকরিটা দাদা পেতে পেতে আরো দু’বছর লেগে যায়। দাদা আমার থেকে আট বছরের বড়। দাদা চাকরিটা পেতে আমাদের সংসারের স্বচ্ছলতা আবার ফিরে আসে। বৌদির সাথে আগেই দাদার প্রেম ছিল। চাকরি পাবার পর দাদাকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকে। মাও আপত্তি করেননি। দাঁড়িয়ে থেকেই বিয়ে দেন। ছয় মাস যেতে না যেতেই শুরু হয় অশান্তি। দাদার মাইনের টাকায় সংসার চলে। আমি,মা বসে বসে খাই। তার উপর আমার পড়াশোনার খরচ। সামান্য সামান্য ব্যাপার নিয়ে শুরু হয় অশান্তি। মা এটা সহ্য করতে পারেননি। দু’বছর আগে হার্টঅ্যাটাকে মাও চলে যান চির শান্তির দেশ। আমারই মরণ নেই। দাদা বৌদি সংসারে ভাঙ্গা কুলোর মতন পড়ে আছি। দাদাও কেমন পাল্টে গেছে! বৌদির ওপর কোনো কথা বলে না। বৌদি যা বলে সেটাই ঠিক। আমি আমার মতন থাকি। কষ্ট করে পড়াশোনাটা চালিয়ে যাচ্ছি। মা খুব গান ভালোবাসতেন। বারবার বলতেন,‘গানটা কোনদিন ছাড়িস না।’ আর কতদিন এভাবে চালাতে পারবো জানি না।” এক খন্ড মেঘ এসে ঝকঝকে নাগরিক চাঁদটাকে ঢেকে দিল।
সকালে উঠেই শুরু হয়ে গেল রিহার্সাল। মাঝে আর একদিন বাকি। সবিতাদের শরিকি বাড়ি। জ্যাঠা,কাকা সব একসাথে থাকে। ঠাকুরমা যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন এক হাঁড়ি ছিল। এখন হাঁড়ি আর রান্নাঘর আলাদা হয়েছে। কিন্তু ভাই বোনেদের সাথে খুব মিল। সবিতা বলল,“ দাঁড়া,নিলয়দাকে ডেকে আনি,একটু তবলা বাজিয়ে দেবে। নিলয়,সবিতার জ্যাঠতুতো দাদা,ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। খুব ভালো তবলা বাজায়। সবিতা দাদার হাত ধরে নিয়ে এলো। ঘরে ঢুকেই সন্ধ্যার সাথে আলাপ করিয়ে দিল,“ এই আমার দাদা নিলয়। দাদা,এ সন্ধ্যা। দারুণ গান গায়। একটু তবলায় সঙ্গতটা করে দে না।”
“ বনু,তুই এমন করিস না। কলেজ যেতে হবে। তোদের সাথে এখন বসলে আমার দেরি হয়ে যাবে।”
“ দাদাভাই! তাহলে সবাইকে বলে দেব কাল মোড়ের মাথায় কালুর দোকানের সামনে তুই সিগারেট খাচ্ছিলি। জেম্মা জেম্মা_ _ _”
“ এ্যাই,মাকে ডাকছিস কেন? চুপ কর। আমি কিন্তু ঠিক আধঘন্টা থাকবো। তারপর আর বায়না করবি না।” সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে বলল,“ আপনি শুরু করুণ।” সবিতা হেসে গড়িয়ে গেল। “ দাদাভাই! তুই ওকে কি বললি? আপনি শুরু করুন! ও আর আমি এক বয়সী। ”
“ তুই থাম দেখি! কথা বলবি না শুরু করবি?” সন্ধ্যা তো লজ্জা পেয়ে গেল। এইভাবে একজনকে টেনে এনে তবলা বাজানো। সন্ধ্যা সবিতার দিকে চেয়ে গান শুরু করল। সেদিন আধঘন্টার বদলে প্রায় একঘন্টা রিহার্সাল চলেছিল। নিলয় ওঠার আগে বলল,“ সত্যিই, আপনার গানের গলাটা খুব সুন্দর।”
ওদের বেশ দিন কাটছিল। সন্ধ্যা সবিতাকে পেয়ে নিজের দুঃখটা ভাগ করে নিতে পেরেছিল। মাঝেমাঝেই ভাই-বোন সবাইকে মিলে গান,কবিতা,গিটারের আড্ডা বসতো। এইভাবে সন্ধ্যা ওতপ্রোতভাবে ওদের পরিবারের সঙ্গে মিশে গেছিল।

ক্রমশঃ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।