গল্পেরা জোনাকি তে রীতা পাল (ছোট গল্প সিরিজ)

সেই চোখ

আষাঢ়ের শুরু। একটু বৃষ্টিতেই কলকাতা ভাসছে। সেই তালে তাল দিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গু। উত্তর ২৪ পরগনা জেলার দেগঙ্গায় এর প্রকোপ খুব বেড়েছে। খবরের কাগজ খুললেই ডেঙ্গুতে মৃত্যুর খবর চোখে পড়তো। একটা খবরে চোখ আটকে গেল,ব্লিচিং পাউডার খুঁটে খাচ্ছে মুরগি। আসল ঘটনা হলো,ও’টা আটা ছড়ানো হয়েছিল কোন ব্লিচিং নয়। আমি একটা এনজিওর সাথে যুক্ত। ঠিক করা হল ওই গ্রামগুলিতে ব্রিচিং ছড়াতে হবে। এছাড়াও মশারি ও মশার ধুপ ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে হবে।
একটা রবিবার আমি ও আমার সহকর্মীরা ছোটা হাতিতে মালবোঝাই করে দেগঙ্গার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। একটা জায়গায় এসে গাড়ি থেমে গেল। আলপথ দিয়ে গ্রামে ঢুকতে হবে। গ্রামে ঢোকার মুখেই একটা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ চোখে পরলো। রাস্তার ধারে ধারে বাঁশবাগান ও তার অভ্যন্তরে বৃষ্টির জমা জল।
অপরিষ্কার নয়ানজুলি,বেশকিছু মাটির বাড়ি। মাটির উঠোনে এখানে সেখানে মুরগি চড়ে বেড়াচ্ছে। রাস্তার ধারে পচা গোবর ঢাই করা। স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ। এখানে আগে থেকেই লোকজন ঠিক করা ছিল। আমরা যেতেই মশার তেল ও ব্লিচিং দেবার লোক ভ্যান নিয়ে চলে এল। ওরা তৈরি হতেই কুপন সিস্টেমে মশারিগুলো দিয়ে দিলাম। এরপর আসল কাজে নামলাম।
আমরা সবাই পুরো শরীর ঢাকা জামাকাপড় পড়েছি যাতে মশার কামড় না খাই। কিন্তু আমাদের সাথে যারা যোগ দিলো সবাই উদলা গা। বিশেষ করে বাচ্চারা,পাছা থেকে প্যান্ট গলে যাচ্ছে,নাক দিয়ে শিকনি গড়াচ্ছে, খালি গা,ওরাই আমাদের পথপ্রদর্শক। ওদের মধ্যে একটা বছর পাঁচেকের ছেলে খুব নজর কারছিল। হাসিখুশি চনমনে একটা বাচ্চা।মুখটা কেমন মায়া মাখান। ওর উৎসাহ চোখে পড়ার মতো। ওই আমাদের জলা-জংলা পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। ওর বন্ধুরা সবাই ওর পেছনে পেছনে যাচ্ছিল। হঠাৎই আকাশ কালো করে এলো। বর্ষার মেঘ যেখানে জমবে সেখানেই বৃষ্টি নামবে। আমরা তাড়াতাড়ি জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে একটা ভাঙ্গা মসজিদ এর পাশে দাঁড়ালাম। বেশ জোরে বৃষ্টি নামলো। খানিকটা দূরে কাঁচা বাঁশ দিয়ে ঘেরা একটা জায়গা চোখে পড়ল। তার পাশেই মাঠ দেখা যাচ্ছে,সেখানেও জল জমে আছে। আমরা সবাই বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় রইলাম। দেখলাম হাসিখুশি ছেলেটা একদৃষ্টে ঐ বাঁশে ঘেরা জায়গাটার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর ওই নিষ্পাপ দৃষ্টি আমি কখনো ভুলব না। ভালো করে খেয়াল করলাম জায়গাটা একটু মাটি দিয়ে উঁচু করা মতন। কাঁচা মাটি গলে গলে পড়ছে। খুব জোরে একটা বাজ পড়ল। অন্য আর একটা বাচ্চা আমার আঙুলটা ধরে বলল, “জানো দিদি,ওর মা তিন দিন আগে ডেঙ্গুতে মারা গেছে। ওইখানে গোড় দেওয়া হয়েছে।”
তখন বুঝলাম,ওর সরল চোখ দু’টো কাকে খুঁজছে!

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।