সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে রীতা পাল (অন্তিম পর্ব)
যাও পাখি দূরে
ললিতের মা’র চোখ থেকে জল গড়াতে লাগল।
“ ওটা একটা অ্যাকসিডেন্ট। ওই ঘাতক গাড়িটাই আমার ছেলেটার গাড়িকে ধাক্কা মেরে ছিল। যার ফলে এই দুর্ঘটনা।”
“ স্যার,এর সবটা সঠিক নয়।” প্রলয় বলে উঠলো।
“ তাহলে ঠিকটা কি আপনিই বলুন মিস্টার প্রলয়!” ললিতের বাবা স্ত্রীকে কান্না থামাতে বলল।
“ রঞ্জনা তুমি বলো,সেদিন উদয়পুর বীচে ঠিক কী ঘটেছিল?”
নয়ন মাথা নিচু করে বসে আছে।
সমরেশবাবু কড়া সুরে বললেন, “ রঞ্জনা আলাদা কি বলবে! ওখান থেকে ওরা কলকাতায় রওনা হয়েছিল আবার কি!” ধমকের সুরে প্রলয় বলল,“আপনি চুপ করুন।
আপনি তো সেখানে ছিলেন না? তবে সেখানে কি হয়েছে,কি করে জানলেন? রঞ্জনাকে বলতে দিন।”
রঞ্জনা অস্থির হয়ে চেয়ার থেকে উঠে কুমারীর দিকে তাকিয়ে বলল,“কে এনেছে ওকে এই বাড়িতে? ও’কে বেরিয়ে যেতে বলো। ও’কে আমি সহ্য করতে পারছি না। ওর জন্য ললিতকে হারিয়েছি?”
বলেই সামনে রাখা কাপ-প্লেট গুলো ছুঁড়ে ফেলে দিল। সমরেশবাবু এক ধমক দিতেই রঞ্জনা আবার চুপ করে নিজের জায়গায় বসল। ললিতের বাবা-মা দু’জনেই কুমারীর দিকে তাকালো। ললিতের মা চোখ মুছতে মুছতে বলল,“ ও,ওই কুমারী! ললিত ওর কথাই আমাকে বলেছিল।” প্রলয় একটা আইফোন বার করে বললো,“ এই ফোনটা গাড়িতে ছিল। গতকাল এটা ওপেন হয়েছে। ওতে কতগুলো ফোন কল এসেছিল অ্যাক্সিডেন্টের আগে! বারবার যে কলগুলো আসছিল সেটা রঞ্জনার ফোন দিয়ে। রঞ্জনা, তুমিতো জানতে ললিত গাড়ি চালাচ্ছে,তা সত্বেও বারবার ফোন করছিলে কেন?”
রঞ্জনা কিছুক্ষণ থেমে শুরু করল,“ ললিত মুম্বাই থেকে আমাকে দেখতে আসে। কিন্তু দুর্ভাগ্য সেদিন কলেজে আমার সাথে কুমারী ছিল। ইনফ্যাক্ট আমি ওকে বলেছিলাম মুম্বাই থেকে বয়-ফ্রেন্ড আসছে। পছন্দ হলে বিয়ে করবো না হলে এখান থেকে ভাগিয়ে দেব। প্রথম দেখাতেই ওকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম । কিন্তু ও কুমারীকে বেশি পছন্দ করত। ওকে নিয়ে ওর ফ্ল্যাটে যেত,আমি যাব বললেই সব বন্ধুদের ডাকত। সবাই মিলে আড্ডা চলত। দিনদিন আমার রাগটা বারছিল। তারপর সেদিন উদয়পুর বীচে গাড়ির মধ্যে ওদের দু’জনকে ওই অবস্থায় দেখে — এখানে কেউ আসবে না বলেই কুমারীর ঠোঁটের সবটুকু উষ্ণতা চুষে নিচ্ছিল ললিত।
তখনই ওদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের একটা ভিডিও করে ঠিক করে নিই নেট দুনিয়ায় ছেড়ে দেবো। যাতে কুমারী কোনোদিন মুখ দেখাতে না পারে। বাধ্য হয়ে ললিতের জীবন থেকে সরে যায়।”
“ তুমি এই ভিডিও দিয়েই ললিতকে ব্ল্যাকমেল করতে চেয়েছিলে?” প্রলয় বলে উঠলো। চিৎকার করে উঠলেন সমরেশবাবু,“ আমার মেয়ে ব্ল্যাকমেল করতে যাবে কেন?”
“ কথাটা আপনার মেয়েকে জিজ্ঞাসা করুন! আজ একটা ভুলের জন্য দু-দুটো তাজা প্রাণ শেষ হয়ে গেছে। আরেকজন পেটে বাচ্চা নিয়ে নিঃশব্দে লড়াই করে চলেছে।”
ঘরের মধ্যে নিস্তব্ধতা ছেয়ে গেল।
প্রলয় আরও বলল,“ সেদিন ললিতকে দোতালায় ডেকে আপনার মেয়ে ভিডিওর কথা বলে। ললিত কুমারীকেই ভালোবাসে এটা জানিয়ে সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে আসে। আপনার মেয়ে ওদের এই ভিডিও ইন্টারনেটে ছেড়ে দেবার হুমকি দিতে থাকে। ললিত বারণ করা সত্বেও নয়নকে সেই ভিডিও পাঠায়। ললিত সেটা বুঝতে পেরেই মাইন্ড ডিস্টার্ব হয়ে যায়। আর তখনই অ্যাক্সিডেন্টটা করে ফেলে। সেই ভিডিওটি পাওয়া গেছে যার প্রেরক আপনার মেয়ে। তাইতো নয়ন?”
নয়ন মাথা নীচু করে বসে থাকে।
প্রলয়,“ আপনি খুব ভালোভাবেই জানেন মেয়ের কীর্তিকলাপ। তাই সেদিন কুমারীর বাবা-মাকে মিথ্যে বলেছিলেন,যে রঞ্জনা এখানে নেই। কিন্তু সত্য,ছাই চাপা থাকে না। মেয়েকে ভালো করে ট্রিটমেন্ট করান। বোঝান,ভালোবাসা জোর করে পাবার জিনিস নয়। ললিত হাবেভাবে বোঝাতে চেয়েছিল,যে সে কুমারীকেই ভালোবাসে। কিন্তু আপনার মেয়ে বুঝতে চায়নি। আমি জানি না ওর শাস্তি কি হবে। এটা বিচার বিভাগের উপর ছেড়ে দিলাম।”
কুমারী সেই একই রকম গাড়ির পেছনের সিটে উঠতে যাবে অলোক হাতটা ধরে বলল,“ তুমি সামনের সিটে বসো। আমি গাড়ি চালাচ্ছি।” প্রলয় পেছনের সিটে বসল। দ্রুত গতিতে গাড়ি চলছে। একটা বাঁকে এসে ট্রাকের একেবারে মুখোমুখি হয়ে গেল। এক চুলের জন্য ওদের গাড়িটা বেঁচে গেল। সঙ্গেসঙ্গে কুমারী চিৎকার করে বলে উঠলো,“ ললিত সামনে গাড়ি।” গাড়ি ব্রেক কষে দাঁড়ালো। প্রলয় কুমারীর মাথায় হাত রেখে বলল,“ ভয় নেই। এটা তো মেনে নিতে হবে ললিত আর নেই। ”
কুমারী পেটে হাত দিয়ে,“ ললিত আছে আমার শরীরে মিশে। আমার ছোট্ট ললিত!”
গাড়ি ছুটছে কলকাতার দিকে – – – –
সমাপ্ত