গল্পেরা জোনাকি তে রীতা পাল (ছোট গল্প সিরিজ)

এক পশলা বৃষ্টি

আষাঢ়ের প্রথম দিবস,মেঘের মুখ গুরুগম্ভীর। মুঠোফোনে মেসেজের রিংটোনটা বাজতেই রিমঝিম তাড়াতাড়ি মেসেজটা দেখতে এলো।
সমরেশের ছোট্ট এসএমএস,কাল কলকাতায় আসছি। এগারোটার সময় এয়ারপোর্ট হোটেলে চলে এসো।
একটা অন্যরকম ভালোলাগায় মনটা খুশিতে ভরে উঠল। দৌড়ে গেল ড্রেসিং টেবিলের কাছে। ভালো করে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। মনে হলো কতদিন পর নিজেকে এইভাবে দেখছে। ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই নিজেকে গুছিয়ে নিল। তিন্নির প্রায় ফেরার সময় হয়ে গেছে। গলির মুখ থেকে ওকে আনতে হবে। রিমঝিম ফ্লাটে তালা দিয়ে বেরিয়ে গেল।
রাতে তিন্নিকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিল। সমরেশ সেই যে মেসেজ পাঠিয়েছে তারপর আর একবারও অনলাইন হয়নি। রিমঝিমও এখনো কোনো উত্তর লিখে পাঠায়নি। ফোনটা অফ করে শুতে গেল। এটা রিমঝিমের অভ্যাস কখনো রাতে ফোন নিয়ে ঘাটাঘাটি করে না। এই নিয়ে আবিরের সাথে অনেকবার অশান্তি হয়েছে।আবির অনেক রাত অবধি অনলাইনে ব্যাস্ত থাকে। রিমঝিম বলে বলে ক্লান্ত হয়ে গেছে। এখন রিমঝিম আর কিছু বলে না। রিমঝিম বললেই বলে,’ সারাদিন কাজের চাপে বন্ধু-বান্ধবের সাথে কথা বলা হয় না তাই রাতে সবাই আড্ডা মারে।’ রিমঝিম বোঝে কথাটার সবটুকু মিথ্যা নয় কিন্তু বিশেষ কিছু বন্ধুর সাথে রাতের আড্ডাটা জমে ওঠে। এটা বুঝতে আজকাল অসুবিধা হয় না। আগে রিমঝিম ভাবত এটা নিছকই টাইমপাস। যত দিন যেতে লাগল প্রভাব পড়ল সম্পর্কে। উষ্ণতা হারাতে হারাতে বরফে পরিণত হলো। দু’টো মানুষ এক ছাদের নিচে দিনযাপন করে বুঝতেই পারেনি কবে সম্পর্কের মাঝেএকটা ফাটল তৈরি হয়েছে। দিনদিন গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে ফাটলের দৈর্ঘ্য। একই বিছানায় স্বামী-স্ত্রী অথচ অন্তর্জালে জড়ানো দু’চোখ। কাছের মানুষটা পর হয়ে যাচ্ছে আর কিছু অলীক স্বপ্ন নিয়ে মন খুঁজে বেড়াচ্ছে নীলকন্ঠ পাখি। রিমঝিম ওদের ছোট্ট মেয়ে তিন্নিকে নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত থাকে। তারপর সংসার,আবিরের সবকিছু ঠিকঠাক গুছিয়ে রাখা। দিন কেটে যায়,রাতটা যেন একটা না পাওয়ার যন্ত্রনাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। অথচ দু’বছর আগে আবির এমন ছিল না। অফিস থেকে ফিরে এসেই তিন্নিকে নিয়ে খেলা করত,আজ এটা রান্না করো কাল সেটা রান্না করো,ছুটির দিনগুলোতে কোথাও না কোথাও যাবার একটা প্ল্যান করে ফেলত, বেশ কাটছিল স্বামী-সংসার,বন্ধু-বান্ধব। হঠাৎ করে আবির এই অন্তর জলে জড়িয়ে পড়ল। বন্ধু-বান্ধবদের সাথে তেমন সম্পর্ক নেই। সবাইকে বলে কাজের চাপ সময় পায় না। অফিস থেকে ফিরেই ফোন নিয়ে বসে পড়ে। কত রাত রিমঝিম পাস ফিরে জেগে কাটিয়েছে আবিরের ভ্রুক্ষেপ নেই অথচ রিমঝিম কখনো ফোন নিয়ে রাতের বেলা বেডরুমে ঢোকে না। কাছের মানুষের সম্পর্ক অনেক দামি। এই ভাবেই কাটছিল।
হঠাৎই মাস তিনেক আগে রিমঝিমের সাথে ফেসবুকে আলাপ হয় সমরেশের। প্রবাসী বাঙালি। বয়স,ছবি দেখলে মনে হয় চল্লিশের কোঠায়। দিল্লিতে থাকে। এক্সপোর্ট ইমপোর্ট এর বিজনেস আছে। মাঝেমধ্যে কলকাতায় আসে। সমরেশই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিল। রিমঝিম অচেনা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করে না কিন্তু প্রোফাইলে সব বিখ্যাত শায়েরের পোস্ট থাকতো সেই দেখেই একসেপ্ট করেছিল। খুব ভালো লাগতো লেখাগুলো পড়তে। সমরেশই ইনবক্সে পিন করে। তারপর থেকেই শুরু হয় কথা। সমরেশ খুব কম অনলাইন থাকে। মাঝে মাঝে দু-তিনদিন অনলাইনে দেখা যায় না। দু’জনেই দু’জনের ফোন নাম্বার শেয়ার করে কিন্তু কোনদিন ভিডিও কল করে দু’জন দু’জনকে দেখেনি। সমরেশের কথায় এক অদ্ভুত জাদু আছে যা রিমঝিমকে খুব আকর্ষণ করে। এই ভাবেই একটা সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। রিমঝিম হয়তো কিছুটা শূন্যস্থান পূরণের চেষ্টা করছিল।
রাতে কিছুতেই রিমঝিমের ঘুম আসছে না। এপাশ ওপাশ করছে। হঠাৎ করে সমরেশ এমন মেসেজ করল কেন? খুব সুন্দর শায়েরি বলে,কবিতা বলে কিন্তু নিজের সম্বন্ধে তেমন কিছু বলেনি। তাছাড়া সম্পূর্ণ এক অপরিচিত মানুষের সাথে এইভাবে দেখা করতে যাওয়া কি ঠিক? চলছে ছায়াযুদ্ধ। কিছুতেই সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না। আবিরের দিকে তাকিয়ে দেখে চ্যাটিং-এ ব্যস্ত। রিমঝিম পাশ ফিরে ঘুমানোর চেষ্টা করে।
সকালে রিমঝিমের খুব কাজের চাপ থাকে। কাজের মাসি,তিন্নির স্কুল,আবীরের অফিস,সব সামলাতে এগারোটা বেজে যায়। আজ একটু তাড়াতাড়ি সব সেরে নিল। কপালে টিপ পরে ঘড়ির দিকে তাকালো পৌনে এগারোটা বাজে। ফ্ল্যাট থেকে এয়ারপোর্টে হোটেলে পৌঁছাতে আধঘন্টার উপর লেগে যায় তারপর জ্যামে পড়লে তো আর কথাই নেই। বের হতে যাবে এমন সময় সমরেশের ফোন,“এসে গেছি। তুমি চলে এস। রুম নং২০৫। ” ট্যাক্সি থেকে নেমে বুকটা কেমন দুরদুর করতে লাগল।
কিন্তু অমোগ এক টানে ২৫০ নম্বর ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। ডোরবেল এ হাত দিতে গিয়ে হাতটা কেঁপে উঠল। ততক্ষনে যা হবার হয়ে গেছে। ডোর বেলে চাপ পড়ে গেছে। দরজা খুলল সমরেশ। কিছুক্ষণ দু’জনেই দু’জনের দিকে তাকিয়ে রইল। সমরেশ শুরু করলো,“ আসুন ম্যাডাম। ” রিমঝিম চৌকাঠটা পা তুলে পেরোলো। ঝাঁ-চকচকে রুমে প্রথমেই চোখ পড়ল বেডের দিকে। তিন্নির থেকে একটু বড় একটা বাচ্চা খাটে বসে আছে। রিমঝিম একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মেয়েটার হাতে একটা অ্যালবাম গোছের কিছু। সমরেশ দরজাটা বন্ধ করে বাচ্চাটার দিকে এগিয়ে গেল। রিমঝিমি সমরেশ কে অনুসরণ করল। বাচ্চা মেয়েটা মিটমিট করে হাসছে। আলাপ করিয়ে দিল,“ আমার মেয়ে জেসমিন। ” রিমঝিমের বুকে একটা কুলকুল করে নদী বইতে শুরু করল। দুই হাত বাড়িয়ে জেসমিনকে জড়িয়ে ধরল। জেসমিন হা করে মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। রিমঝিমের চোখ পড়ে গেল অ্যালবামের দিকে। তাড়াতাড়ি জেসমিনকে ছেড়ে অ্যালবামটা হাতে তুলে নিল। সঙ্গে সঙ্গে সমরেশ বলল,“ এই ছবিগুলো তোমার নয়,জেসমিনের মায়ের। ও এই পৃথিবীতে নেই। তোমাকে দেখতে অনেকটা ওর মতন। আমার ফোনটা নিয়ে জেসমিন গেম খেলে। একদিন ওই তোমাকে আবিষ্কার করে রিকোয়েস্ট পাঠায়। আমিও প্রথমে হতবাক হয়ে যাই। কথা বলার লোভ সামলাতে পারিনি । কাল জেসমিন ওর দাদু ঠাকুমার কাছে চলে যাবে। ওটাই ওর মায়ের শেষ ইচ্ছা ছিল। তাই ও ইংল্যান্ডে চলে যাবে। ওকে রেখে আমি ফিরে আসবো। ওখানেই ও পড়াশোনাটা করবে। যাবার আগে ও একবার তোমাকে দেখতে চেয়েছিল তাই তোমায় কষ্ট দিলাম। কিছু মনে করো না। ” রুমে লাঞ্চ এসে গেল। থরে থরে সাজানো খাবার। রিমঝিম নিজে হাতে পরিবেশন করলো। মাঝে মাঝে সমরেশের সাথে চোখাচুখি হয়ে যাচ্ছিল। জেসমিনের চোখেমুখে উপচে পড়ছে আনন্দ। দেখতে দেখতে সময় কেটে গেল। তিন্নির বাস এসে যাবে। ওকে আনতে হবে। জেসমিনের সাথে কতগুলো সেলফি তুলে নিল রিমঝিম। সমরেশ সরে গেল। জেসমিন বাবার ফোনে তিনজনের একসাথে ছবি তুলল। রিমঝিম যাবার কথা বলতেই বাবা-মেয়ের মুখে কালো মেঘ জমে উঠলো। বাবার দিকে তাকিয়ে রইল জেসমিন। রিমঝিমের হাত ধরে বলল,“ আবার দেখা হবে আন্টি।”
দ্রুতপায়ে বেরিয়ে এল রিমঝিম। বাইরে তখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।