প্রবাসী মেলবন্ধনে রূপসা মন্ডল দাশগুপ্ত (ট্যাম্পা, ফ্লোরিডা)

হিসেব


– পাঁচশো টাকা ভিজিট? আমাদের এ ডাক্তার দেখানো সম্ভব দিদি? -মিঠুকে হতাশ দেখায়।
– অন্য উপায়ও একটা আছে, আমার যদিও সেটা পছন্দ না -তুলি বলে।
– আহা শুনিই না।
– একটা ক্লাবের চ্যারিটিতেও দেখেন উনি, পঁচিশ টাকা দিলেই চলে। এখান থেকে অনেকটা দূরে আর খুব ভিড় হয়, তোর খুব কষ্ট হবে।
– ওখানেই যাব দিদি, কিচ্ছু হবে না।
– চট করে হিসেবটা সেরে নিই চল, তারপরে ভাববো। তোর হল তিনশো টাকা কলকাতা যাতায়াত খরচ, এটা তোর কাছেই রাখ্, বাবাকে ফেরত দিস্। তোর হস্টেলের খাওয়ার পয়সা লাগছে না, দুটো টিফিন পনেরোতে হবে কি?
সরু একটা খাটে অল্পবয়সী দুটো মেয়ে একগাদা খুচরো পয়সা ঢেলে ,একটা ছোট্ট ডায়রি ও পেন নিয়ে হিসেবে ব্যস্ত। রাতের ছায়াচ্ছন্ন পুরোনো হস্টেলের ঘর, মোট তিনটে সিঙ্গেল বেড, আলমারি , টেবিল, বইপত্র ইত্যাদি নিয়ে ঠাসাঠাসি অবস্থা।
– একবারই বাইরে খাব দিদি, খিদে পেলে ঘরে মুড়ি-চা দিয়ে চালিয়ে নেব। আমার হোস্টেলে খেতে পয়সা লাগবে না কেন?- মিঠু জানতে চায়।
-বুদ্ধি খাটাতে হয় রে, রুমমেট দুটো বাড়ি গেল বলেই না তোকে তড়িঘড়ি ডেকে পাঠালাম। ওদের বললাম মিল অফ না করতে, ওদেরটাতে তোর হয়ে যাবে। থাকা খাওয়াটা তাহলে একরকম ফ্রী হয়ে গেল তোর, কতদিন থেকে তোকে কলকাতায় বড় ডাক্তার দেখাব ইচ্ছে। -দিদি তুলি বেশ একটা আত্মপ্রসাদের হাসি হাসে।
-এমা কী ভাবল ওরা।
– ধুস, এখানে এটা চলে, রুমমেটরা শুধু দুটো মাছের পিস কী এক্সট্রা ডিমের জন্যেই বলে বাড়ি যাচ্ছিস ? মিলটা অন রাখিস। তাছাড়া দু চার পয়সা ওদের গায়ে লাগেনা রে, বড়লোকের বিটি সব। -বলে দুটো খাটের দিকে ইশারা করে তুলি।
– এভাবে কত বাঁচবে? একমাস পরে পুজো, আমাদের সবার ভদ্র গোছের জামা দরকার, মায়ের শাড়িও, যা দু একটা জোটে এত সস্তার হয়।– মিঠু বলে।
– তা তুই কি আশা করিস? কথাতেই আছে ‘তেলা মাথায় তেল’, আমাদের মা বাবার ক্ষমতা নেই কাউকে কিছু দেবার, তাই অন্যরাও আমাদের দেওয়াটা যত সস্তায় পারে সা্রে, সোজা হিসেব।
যাকগে, মোদ্দা কথা হল, পয়সা বাঁচানো বড় দরকার। সুতরাং, ঠান্ডা ঘরে ডাক্তার দেখানোর আশা ছেড়ে, ঘেমে নেয়ে ট্রাম বাস ঠেঙ্গিয়ে চল। কালকেই দিন আছে, ঠিক নটায় হস্টেলের রান্না নামে, না খেয়ে যেতে পারব না, বাইরে একবারই খাব, ফলে লাইনের শেষে পড়বি কিন্তু।
– এত করেও যদি অসুখ না সারে দিদি? বাবা তো হাল ছেড়েই দিয়েছে।তুই টিউশন করে এখন কত পাস রে? তোর মাস চলবে?
– চলবে না দৌড়বে, তোর অসুখ সারাবই, আমার ওপর সব চিন্তা ছেড়ে ঘুমোতে চল এবার ।

এই যে মামনীরা টিকিটটা দেখি…………
হুঁ, দেখেছ গজেন ঠিক ধরেছি, লোকালের টিকিট। সঙ্গে ছোট্ট সাইড ব্যাগ নামছে এক্সপ্রেস ট্রেন থেকে। কোথা থেকে ওঠা হয়েছে?
– উলটোডাঙা, মাত্র একটা স্টেশন, কেন কী হয়েছে?
– আর কী হবে মা? ফাইন দাও, লোকালের টিকিটে দূরপাল্লায় চেপেছ।
তুলি শুকনো স্বরে বলে “বুঝতে পারিনি কাকু, আমার বোন অসুস্থ, ডাক্তার দেখিয়ে ফিরছি, এই ট্রেনটা ফাঁকা দেখে…. “
– এইবার ফাইন দিলে এজীবনে আর ভুল হবে না। গজেন হাঁ করে দেখছ কী? রসিদ কাটো, চারশো টাকা”।
তুলির মনে হল পায়ের নীচে মাটি নেই – আমার কাছে টাকা নেই, তাছাড়া আমরা স্টুডেন্ট, এত টাকা ফাইন হয় কিভাবে?।
ভয়ের মুখভঙ্গি করে চেকার বললেন- ওরে বাবা, কলকাতা ইউনিভার্সিটি? এখুনি বন্ধুদের ডাকবে? দুবছর আগে কতজন নিরীহ মানুষ এখানে মরেছিল, জানো? বিনটিকিটের পড়ুয়াদের বজ্জাতিতে। পারবে সামলাতে?
তুলি বলে – বিনাটিকিট কিসের? টিকিট দেখিয়েছি, আর ছোট্ট ব্যাগ নিয়ে কেউ দূরপাল্লায় চাপে না, তা বেশ বুঝতেই পারছেন, পুজোর আগে তোলা তুলছেন?
চেকার বলে- আহা! কী কথার ছিরি, দেখে তো দিব্যি ভদ্রঘরের মনে হয়। গজেন লকআপে নেবার ব্যবস্থা কর তো দুটোকে, তারপর কাকে ডাকে দেখব।

আশপাশে কৌতুহলি চোখ উঁকি মারছে, দাঁত বের করে গায়ে পড়ে জিগ্যেস করছে “কী হয়েছে দাদা?” টিকিট চেকারের এসিস্টেন্ট গজেন মাছি তাড়ানোর ভঙ্গীতে তাড়াচ্ছে তাদের।

মিঠু দিদির পিঠের সাথে সিঁটিয়ে গিয়ে বলল-
– যা আছে দিয়ে দে দিদি,শরীর খারাপ করছে।
– আমার বোন অসুস্থ,বিশ্বাস না হলে প্রেসক্রিপশন্ দেখুন ।
– শোন, একটাই হেল্প করতে পারি, স্টুডেন্ট বলে তিনশো, ব্যস্।
– দেব না। যেখানে নিতে হয় নিন।
দিদির কথা শুনে মিঠু মাথায় হাত দিয়ে প্ল্যাটফর্মেই বসে পড়ে ।
তুলি দাঁত চিপে বলে, – আমার বোনের কিছু হলে আমি আপনাকে ছাড়ব না ।
-আহা কী অভিনয়, গজেন মেয়ে পুলিশ ডাক তো।
শূন্য পেট, সকাল থেকে রোদ গরমে অপেক্ষা, তার ওপরে এই অপমান, মিঠু আর যুঝতে পারে না, পার্স খুলে তিনশো টাকা এগিয়ে দেয় চেকারকে।

পুজো প্যান্ডেলের সাজ সরঞ্জাম স্তুপ করে রাখা ফুটপাথে, তার পাশের রংচটা বেঞ্চে বসে দুটো চা বলে তুলি ।
– আমাদের সাথেই কেন এমন হয় রে?
– সব গরীবের সাথেই হয়, হিসেব ভুন্ডুল।
তুলি হেসে ওঠে, মিঠু অবাক হয়ে বলে –“হাসছিস”!
– বোকামির খেসারৎ।
– মোটেই না, এটা বুড়োটার বজ্জাতি, আমদের টিকিট ছিল।
– হুঁ, তবে আমাদেরও বেহিসেবী হওয়ার দিন আসবে, কী বলিস? সেদিন তিনশোর শোকে চা তেতো হবে না।
হাসিটা সংক্রমিত হয়, দুই বোন চায়ে চুমুক দেয়। ছিরিছাঁদহীন ফুটপাতের দোকানের ছিদ্রাল ত্রিপলের ফাঁক গলে অস্তসূর্য আশার রং ছড়ায় ওদের ক্লান্ত মুখে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।