গল্পেরা জোনাকি তে ঋতশ্রী মান্না

মুক্তো

অনম্ত শেষবার দীঘা এসেছিল,তা অন্ততঃ বছরতিনেক আগে।বন্ধুদের সাথে। সেবার মৌলিকে আনেনি।
তাছাড়া,বউবাচ্চা আনলে খরচও বেশি,আলাদা রুম নিতে হয়। বন্ধুরা হলে সকলে মিলে একটা রুম নিলেই কাজ চলে যায়। তার সামান্য রোজগারে বউবাচ্চা নিয়ে বেড়াতে বেরোনোটা একপ্রকার বিলাসিতার পর্যায়েই পড়ে।

মৌলির অবশ্য সে নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই। মৌলি বরাবরই চুপচাপ,ঠান্ডা স্বভাবের।
এবছর গার্লস স্কুলের হোস্টেলের আর হসপিটালের নতুন বিল্ডিংয়ের ওয়্যারিংয়ের কাজটা পাইয়ে দিয়েছিল দাসবাবু।সেসব থেকে হাতে টাকাও এসেছে বেশ কিছুটা। তাই মৌলিকে নিয়ে কাছেপিঠে কোথাও ঘুরে আসার কথা মনে হয়েছিল।
বিকেলে সমুদ্রের দিকে যাবে বলে বেরিয়েছে,রাস্তায় অনিমেষের সাথে দেখা। অনিমেষ আর ওর বউ।ওরা আজ সকালেই এসেছে।
অনিমেষ আর অনন্ত ছোটবেলায় একই প্রাইমারি স্কুলে পড়েছিল। এই মিলটুকু বাদ দিলে আর কোনো মিলই নেই তাদের। কী বিত্তে,কী বিদ্যায়,কী জীবনযাত্রায় সবেতেই আকাশপাতাল তফাৎ দুজনের। তবু সেই প্রাইমারি স্কুলের চারবছরের সুবাদে অনিমেষ যে তার মত সামান্য ইলেকট্রিক মিস্ত্রিকে আজও বন্ধু বলে মানে,এতেই অনন্তর কৃতার্থ লাগে নিজেকে। কুণ্ঠিতও লাগে বইকি।
অনিমেষ বিশাল ব্যবসায়ী। শহরের বুকে বিরাট হার্ডওয়ারের দোকান। চারখানা বাড়ি,দুখানা দামী গাড়ি। তিনপুরুষের ব্যবসা ওদের। বনেদী বড়লোক।

রোডসাইডের একটা মুক্তোর দোকানে ঢুকেছে অনিমেষের বউ। অনন্ত চলে যেতেই চাইছিল। অনিমেষই আটকে দিল,”আরে দাঁড়ানা। কতদিন পর দেখা হল। গল্প করি একটু। তোর বৌদি কীসব কিনবে,কিনে নিক। তারপর একসাথেই নাহয় সমুদ্রের দিকে যাবো।”
অনন্ত না করতে পারেনা। অনিমেষের সাথে ঢুকে আসে দোকানে।
অনিমেষ গলা নামিয়ে বলে,”মেয়েদের ব্যাপার,বুঝছিসই তো। কতক্ষণ যে লাগাবে,ঠিক নেই। একা একা দাঁড়িয়ে বোর হব। তোরা থাকলে তবু গল্প করে সময়টা কেটে যাবে আর কী।”

অনিমেষের বউ একটা মুক্তোর হার পছন্দ করে গলায় ফেলে দেখছে। মৌলি আগ্রহীচোখে দেখছিল তাকে।
সেদিকে চোখ পড়তে অনন্ত চাপাগলায় বলে,”বলছি তুমি কিছু নেবে?”
মৌলি ঘাড় নাড়ে,মৌলির কানে সস্তার ঝুমকো দুলে ওঠে।
অনন্তর মনে হয়,মৌলির গলায় অনিমেষের বউয়ের মত মুক্তোর হার থাকলে কেমন লাগত?
অনিমেষের বউ তিনহাজার টাকা দিয়ে বড় লকেট বসানো মুক্তোর হার কেনে,গলায় ফেলে দোকানের আয়নায়
নিজেকে দ্যাখে,মুক্তো বসানো উজ্জ্বল লাল পাথরের লকেটটা তার সুগভীর ক্লিভেজের ওপর এসে পড়ে থাকে। অনন্তর হঠাৎ মনে পড়ে,চায়ের দোকানে সন্ধেবেলার আড্ডায় একদিন মনোজ বলেছিল, “অনিমেষের বউটাকে দেখেছিস?হেব্বি হট। ”

অনন্ত আয়নায় তাকায়,অনিমেষের বউয়ের মুক্তো বসানো রক্তলাল পাথরের লকেট দেখে,তারপর লকেট পেরিয়ে দেখে ওপরের দুটো বোতাম খোলা টকটকে লাল টপ,গভীর খাদের মত ক্লিভেজ…

“গরম চা,গরম চা–চা খাবেন নাকি দাদা?”
চাওয়ালা জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে–অনন্ত ঘাড় নাড়ে।

কেনাকাটা সেরে ওরা সমুদ্রের তীরে এসে বসে। ঢেউয়ের আওয়াজ,মানুষের কলরব,ভাজা মাছের গন্ধ,খুচরো বিকিকিনি এসবে ভরে থাকে সমুদ্রতীর। সমুদ্রর ঠান্ডা হাওয়ায় বিল্টুর ঠান্ডা লেগে যাবে বলে মৌলি একটু পরেই হোটেলে ফিরে যায়। অনন্ত বসে থাকে,অনিমেষ আর তার বউ সামান্য দূরেই বসে আছে। একটা ছোট বাচ্চা হাতে ঝোলানো মুক্তোর মালা নিয়ে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করছে। অনন্তর কাছেও এল।অনন্ত বলল,”কত দাম?”
-“কুড়ি টাকা বাবু।”
-“নকল মুক্তো তো।”
-“না বাবু,হাত দিয়ে দেখুন, আসল মুক্তো হাতে ধরলেই ঠান্ডা লাগবে। ঝুটো মুক্তোয় কোনোদিন তেমন হবেনা।”
অনন্ত হাত দিল মালাটায়,বেশ ঠান্ডা। কুড়ি টাকাই মাত্র তো। মৌলির জন্য নিল একটা।

হোটেলে ফেরার পথে রুটি আর তড়কা কেনার জন্য একটা ছোট দোকানে দাঁড়াল অনন্ত। বেশ ভিড় আছে দোকানটায়। অনিমেষরা পাশের বড় হোটেলটায় ঢুকল,ডাকল অনিমেষ,”চলে আয়,ডিনার করে নেব একসাথে। ”
অনন্ত হেসে ঘাড় নাড়ে,”নাহ্,তোরা খেয়ে নে।”
লাইনে দাঁড়িয়ে দেখল,ওরা ভাত অর্ডার করেছে। কাচের দরজার ওপাশের টেবিলেই ওরা। প্লেটে বড় সাইজের পমফ্রেট,ধোঁয়া ওঠা ভেটকি,গরম ভাত…

রুটি আর তড়কা খেতে খেতে অনন্তর মালাটার কথা মনে পড়ে। মৌলির খালি গলায় মুক্তোর মালাটা কেমন লাগবে ভাবতে চেষ্টা করে অনন্ত।কিন্তু চোখে ভেসে ওঠে আয়নায় দেখা মুক্তো বসানো রক্তলাল পাথরের লকেট আর…

বিল্টু ঘুমিয়ে পড়েছিল। মৌলি একটা পলিথিনে ভরে রাখছে বিল্টুর সারাদিনের সঞ্চয়,সমুদ্রতীরে খুঁজে পাওয়া নানা আকারের একরাশ ঝিনুক।
অনন্ত শার্টের পকেট হাতড়ে মালাটা বের করে আনে,মৌলিকে ডাকে,”শোনো এদিকে।”

মৌলি পলিথিনটা ব্যাগে ঢোকাতে ঢোকাতে তাকায়,”কী বলছ?”

অনন্ত ডাকে,”এসো না।”

মৌলি আসে,তার চোখে কিছুটা বিস্ময়। অনন্ত সামান্য হেসে মৌলির গলায় পরিয়ে দেয় মালাটা। মৌলির চোখে একটা আনন্দের ঢেউ দেখে অনন্ত,অনেকদিন পর। মৌলির সস্তা লাল নাইটির বুকের প্রথম বোতাম পেরিয়ে থেমে থাকে কুড়ি টাকার মুক্তোর মালার ছোট্ট লকেটটা।

সেদিন রাত্রে ঘুমন্ত মৌলির বুকে হাত দিতে দিতে অনন্তর হঠাৎই মনোজের কথাটা মনে পড়ে,অনিমেষের বউটাকে দেখেছিস? হেব্বি হট।
সংসারের জোয়াল ঠেলতে ঠেলতে নিজের দিকে না তাকানো মৌলির খসখসে চামড়া, উঁচু হয়ে থাকা কণ্ঠার হাড় দেখে অনন্ত। দেখে চুলে কোনোরকমে বেঁধে নেওয়া অযত্নের খোঁপা। মৌলির দুই বুকের মাঝে থেমে থাকা মুক্তোর লকেটে হাত লাগে অনন্তর। ঘুমের মত ঠান্ডা।
সরিয়ে দেয় লকেটটা অনন্ত।তারপর সমস্ত আক্ষেপ,লিপ্সা জড়ো করে মুখ নামিয়ে আনে। দাঁতে জিভে কেটে ফেলতে চায় সমস্ত শৈত্য। একটু পরেই অনন্ত অনুভব করে,তার শক্ত শরীরের নিচে জেগে উঠে মৌলির ঘুমভাঙা হাত আঁকড়ে ধরেছে তাকে। পরম আদরে তার মুখ ডুবিয়ে নিচ্ছে দুই উত্তুঙ্গ পাহাড়ের মাঝের সমুদ্রে। শনশন হাওয়া, দুলে উঠছে ঝাউবন। ঝাউবন পেরিয়ে অনন্ত ডুবে যায় অতল সমুদ্রে।
তারপর,বহুক্ষণ তাদের ছোট্ট হোটেলরুমের মধ্যে উত্তাল সমুদ্র খেলা করে।

মৌলি ক্লান্তগলায় বলে,এবার ঘুমিয়ে পড়তে হবে। ফেরার ট্রেন কাল সকালেই তো।
অনন্ত একদৃষ্টে মৌলির দিকে তাকিয়েছিল।নাইটবাল্বের মৃদু আলোয় মৌলিকে ভারি সুন্দর লাগছে। ক্লান্ত,তৃপ্ত অথচ পরিপূর্ণ। চোখেমুখে কী অদ্ভুত আলো, শেষ বিকেলের মত নরম। উষ্ণ নয়,উজ্জ্বলও নয়। শীতল, অনুজ্জ্বল অথচ কী গভীর মায়া তাতে! নিরাবরণ বুকের মাঝে থমকে আছে মুক্তোর ছোট্ট লকেটটা।

মৌলি হাসে,মালার লকেটটা হাতে নিয়ে ঘোরায়।তারপর বলে,”মালাটা কিন্তু খুব সুন্দর।”

বেশ ঠাণ্ডা লাগছে। অনন্ত ওঠে,ফ্যানের স্পিডটা কমায়। তারপর শুয়ে বেডকভারটা নিজের আর মৌলির বুক অব্দি টেনে নেয়। মুক্তোর লকেটটায় হাত লাগে অনন্তর। ঠান্ডা। কী বলছিল যেন ছেলেটা? আসল মুক্তো হাতে ধরলেই ঠান্ডা লাগবে।
আচ্ছা,তৃপ্তিও তো শীতল। নয়? নিখাদ,শীতল–আসল মুক্তোর মত।
মৌলিকে কাছে টেনে কপালে একটা দীর্ঘ চুমু খায় অনন্ত,তারপর আস্তে আস্তে বলে,”হ্যাঁ। আর,তুমিও…ওরই মত,খুব সুন্দর…”

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।