গল্পেরা জোনাকি তে ঋতশ্রী মান্না

লংকাকাণ্ড

আমি,বাবা,ছোটমাসি,আর ছোটমাসির মেয়ে শর্মি–আমাদের গন্তব্য বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি। সেখানে M.Sc র অ্যাডমিশন টেস্টে উৎরে যাওয়া ক্যান্ডিডেটদের লিস্টে আমিও একজনা,সেদিন কাউন্সেলিং। স্টেশনে নেমে অটো ধরলেই সোজা ক্যাম্পাস।

কষ্ট করে অটো ধরতে হয়না,বরং অটোরাই আমাদের ধরে ফেলে।
ডজনখানেক অটোওয়ালা আমাদের চারপাশে সুরে বেসুরে ‘আইয়ে’ ‘,আইয়ে’ করে গাইতে থাকে।

যাইহোক ভিড় কাটিয়ে কোনোক্রমে একটি অটোতে উঠে বসি। বলি,”ইউনিভার্সিটি যাব।”

সে বিজ্ঞস্বরে বলে,”ওহ্,চলিয়ে,লংকা বেচু।”

আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করি। বাবা বোঝাতে থাকেন,”নেহি,লংকা কেন বেচু? হাম তো ইউনিভার্সিটি যায়েঙ্গে।”

সে অটোর স্পিড বাড়ায়,পুনরায় বলে,”লংকা বেচু।”

চলন্ত অটোতে আমরা ভ্যবাচাকা তখন,বাবা প্রাণপ্রণ বোঝাতে থাকেন,”আরে,আমাদের লংকা বেচনেকা কোই অভিপ্রায় নেহি হ্যয়।”

ছোটমাসি সংগত করেন,”হাম তো কোনোকালে লংকা নেহি বেচা,ভাইসাব। লংকা কিঁউ বেচু?”

অটোওয়ালা কেমন যেন সন্দেহজনক ভাবে তাকায়,তারপর আবারও খসখসে,নিষ্প্রাণ গলায় বলে, “লংকা বেচু।”

ছোটমাসি আপ্রাণ বোঝাতে থাকে,”আরে,যদি লংকা বেচনাই হোতা তো কলকাত্তা তে বেচতা। বেনারস কিঁউ আতা শুধুশুধু সামান্য লংকে কে লিয়ে?”

অটোওয়ালা নিরুত্তর। অটো অটোর মতন চলতে থাকে।

শর্মি আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে আসে,”ভাব,আমরা বেনারসের গলিতে গলিতে লংকা বেচছি,বেশ থ্রিলিং,না?”

বাবা শেষ চেষ্টা করেন,”আরে,হামারে পাশ লংকাই নেহি হ্যায়,তো হাম কেমন করকে বেচেঙ্গে?”

এবার অটোওয়ালা পেছন ফিরে তাকায়। একটি শীতল,নির্বাক এবং নিরুত্তাপ দৃষ্টি –দেখলেই শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে যায়। সে দৃষ্টির অনুবাদ করলে এটাই দাঁড়ায়,এত কথা নিষ্প্রয়োজন।

ছোটমাসি ফিসফিস করে বলে,”ওরা আমাদের কিডন্যাপ করে নিয়ে যাচ্ছে…

শর্মি বলে,”লংকা বেচাবে বলে?”

ছোটমাসি রীতিমত বিরক্ত হয়,”সবতাতে ইয়ার্কি ভালো লাগেনা। চারিদিকে স্পাই,এখন কি ইয়ার্কির সময়?”

অটো তখন একটা সরু গলিতে,আমি এদিকওদিক তাকাই,কয়েকটি বিশালবপু ষাঁড় ছাড়া আর কিছুই নজরে পড়েনা।

ছোটমাসি ফিসফিস করে,”হাইলি সাসপিশাস। ষাঁড়ের ছদ্মবেশে স্পাই।”

শর্মি হাসল,”মা,একটু বেশীই বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না? শেষে ষাঁড়ের ছদ্মবেশে স্পাই!!”

ছোটমাসি রেগে উঠল,”এই গলিতে একটাও খাবার দোকান,ফলের দোকান কিচ্ছু নেই–বাড়িও নেই,শুধু সার সার শাড়ির দোকান–ষাঁড় কি শাড়ি খায়,খায়না তো।তাহলে এখানে এত ষাঁড়ের প্রাচুর্য কেন? বোঝাই তো যাচ্ছে, এগুলো ছদ্মবেশী ষাঁড়।”

ব্যাপারটা ভাববার বটে। শর্মি আর আমি মুখ চাওয়াচাওয়ি করি,কিন্তু স্পাই আমাদের পেছনে কেন?

শর্মি বলে,”হয়ত অটোওয়ালার পেছনে। মে বি ও কোনো ইন্টারন্যাশনাল গ্যাংয়ের সদস্য। ওকে ছদ্মবেশে ফলো করছে।”

কিন্তু ইন্টারন্যাশনাল লংকা বেচাকেনা চক্র!! বেশ ঘোরালো ব্যাপারস্যাপার!

ছোটমাসি গলার স্বর খাদে নামিয়ে আনে,”গবেটগুলো,বুঝতে পারলিনা,লংকা হয়ত কিছুর কোডনেম। আসলে হয়ত অন্য কিছু নিষিদ্ধ জিনিসপত্তর বেচাকেনা করাবে আমাদের দিয়ে।”

কী সব্বোনাশ!!

ছোটমাসি শেষ চেষ্টা করতে থাকে,”হাম বোলতা কেয়া হ্যায়,লংকা বেচনা তেমন কুছু লাভজনক বিজনেস নেহি হ্যায়। হাম তো অন্য কুছ ভি বেচ সাকতে হ্যায়। “

অটোওয়ালা কোনো সাড়াশব্দ করলনা। শেষ সময় এগিয়ে আসছে। বুঝতে পারছি , আজ লংকা বেচতেই হবে। কিছুই করার নেই আর।

ছোটমাসি বলল,”এক কাজ কর,একটা চিঠি লেখ তো ঝটপট,
–মহাশয়,
আমরা জ্ঞানতঃ নির্দোষ। আমরা বেনারসের আন্তর্জাতিক লংকা বেচাকেনা চক্রের দ্বারা অপহৃত হইয়াছি। অপহরণকারীর চলন্ত অটোয় বসিয়াই কোনোক্রমে এই পত্র লিখিতেছি। আমাদিগকে উদ্ধার করুন।”

কিন্তু কাকে লিখব?

ছোটমাসি রেগে ওঠে,”যেকোনো একটা ষাঁড়ের পায়ের কাছে টুপ করে ফেলে দিবি। ওরা তো ছদ্মবেশী গোয়েন্দা, বললামই। ঠিক পড়ে নেবে আর আমাদের উদ্ধার করবে।”

আমি জিজ্ঞেস করি,”বাংলা বুঝবে,ষাঁড়?”

ছোটমাসি তাচ্ছিল্যের সুরে হাসে,”ওরে গোয়েন্দাদের অগাধ পাণ্ডিত্য থাকে,পনেরো ষোলোটা ভাষার ওপর দখল থাকে ওদের।”

…ছোটমাসির কথামতই কাজ হল। স্পষ্ট দেখলাম,ষাঁড়টা চিঠিটা দেখল,শুঁকল তারপর গিলে খেয়ে ফেলল।

আমি করুণ সুরে “ও ছোটমাসি” বলে ডাকতেই,ছোটমাসি ঠোঁটে স্মিতহাসি আর হাতে বরাভয়মুদ্রা ঝুলিয়ে রেখে বলল,”আরে অপরাধীরা এদিকওদিক ছড়িয়ে আছে, তাদের কারুর হাতে যাতে না পড়ে,তাই পড়েই সঙ্গেসঙ্গে খেয়ে ফেলল। এটাও বুঝলিনা!”

ষাঁড়ের ইনটেলিজেন্সে মুগ্ধ না হয়ে পারিনা আমরা।

ইতিমধ্যে আরও কিছু গলি,তস্য গলি পেরিয়ে অটোওয়ালা একটি জায়গায় এসে খ্যাঁচ্ করে ব্রেক কষে। আমরা আশু বিপদের গন্ধ পেয়ে সচকিত হয়ে উঠি,তাকাই। দেখি ইউনিভার্সিটির গেট। বিশ্বাস হয়না। চোখ কচলে নিয়ে আবার দেখি…সত্যিই তো।

কোথাও লংকা বেচাকেনার লেশমাত্র ছাপ নেই। সেই বহু প্রতীক্ষিত BHU,বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি …
তবে!!!!!

আমাদের জিজ্ঞাসু এবং হতবাক মুখমণ্ডলের ওপর কৃপাদৃষ্টি বুলিয়ে অটোওয়ালা হাসে,আকর্ণবিস্তারী সে হাসি।
তারপর পরিশুদ্ধ বাংলায় বলে,”এই জায়গাটার নাম-ই লংকা। আর BHU লোকমুখে কালে কালে বেচু হয়ে গেছে।”

ছোটমাসি আর বাবা সমস্বরে বলে ওঠে,”তুমি বাঙালি!!!!”

অটোওয়ালা হেসে ওঠে আর যাওয়ার আগে,আমাদের সওয়ারি হিসেবে পেয়ে সে যে কী পরিমাণ নির্ভেজাল আমোদ পেয়েছে,তা শতমুখ করে বলে যায়।

ছোটমাসি আর বাবাকে কিঞ্চিৎ বিপর্যস্ত দেখাচ্ছিল। তাদের এমন সুললিত হিন্দিকথন জলে গেল,বোধকরি সে দুঃখেই।

তবে,শেষপর্যন্ত যে আমাদের লংকা বেচতে হয়নি,সে-ই স্বস্তির,নাকি?
কী বলেন আপনারা ?

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *