২০০৭ সালে তার সাথে শেষ দেখা। সেন্ট্রাল পার্কে পাশাপাশি বাড়িতে থাকতাম আমরা। সেই ক্লাস সিক্স থেকে পরিচয়, প্রথম দেখা সেদিন বিকেলে ক্লাবের মাঠে ক্রিকেট খেলছিলাম পাড়ার ছেলেরা মিলে। আমি বরাবর উইকেট-কিপিং করতে পছন্দ করতাম, সেদিনও আমার স্থান ছিল উইকেটের পেছনে। হঠাৎ একটি সাদা অ্যাম্বাসেডর গাড়ি এসে দাঁড়ালো রাস্তার গা-ঘেঁষে ঠিক আমাদের খেলার মাঠের ধারে। খেলা থামিয়ে কৌতূহলী দৃষ্টিতে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম গাড়ির ওপরে লাগানো লালবাতিটির দিকে। বাবার বয়সী একজন ভদ্রলোক নেমে এলেন সাথে এলো লিসা, একটি লাল টুকটুকে ফ্রক পরা আমার সমবয়সী মেয়ে হাতে একটি মিষ্টি বার্বি-ডল নিয়ে। অনিমেষ কাকুর বাড়িতে ভাড়া থাকতে লাগলো। ধীরে ধীরে পরিচয় হল। আমাদের স্কুলেও ভর্তি হল। দু-বছর বয়সে লিসার মা মারা গিয়েছিল, তাই মাঝে মধ্যে আমার মা তাকে ভালোবেসে রেঁধে খাওয়াতো। খুব রাগ হত, আমার ভাগের আদরটা যে লিসা পেতো।
যত দিন এগোলো তত আমাদের বন্ধুত্ব গভীর হল। একসাথে স্কুলে যাওয়া, আমার বাবার সাথে প্রতি রবিবার নিয়মিত আইসক্রিম খেতে যাওয়া, একসাথে টিভির সামনে বসে ক্রিকেট খেলাদেখা। আস্তে আস্তে বড় হলাম আমরা। স্কুলের বোর্ড পরীক্ষার আগে আমাকে একদিন হঠাৎ বললো ওর বাবার নাকি বদলি হয়েছে উত্তরপ্রদেশের কানপুর শহরে, ও নাকি পরীক্ষা দিয়েই ওখানে চলে যাবে। মনটা খারাপ হয়েছিল খুব। হঠাৎ করে একদিন চলে গেল, আমাকে কিছু না জানিয়ে পাছে যদি আমি মনখারাপ করি।
এখন আমি ডাক্তারি পাস করেছি, নিজের চেম্বার করেছি। বর্তমান পরিস্থিতিতে একটি বেসরকারি নার্সিংহোমের সাথে যুক্ত হয়েছি কোভিড-১৯ রোগের চিকিৎসা করার জন্য। খুবই মর্মান্তিক এই রোগটা, বিশ্বমহামারীর রূপ নিয়েছে। আমাদের দেশও এই কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত। প্রতিদিন শয়ে শয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে, এ যেন এক মৃত্যু মিছিল।
একদিন হঠাৎ লিসার সাথে দেখা হলো আমারই নার্সিংহোমের ভেন্টিলেশন ওয়ার্ডে অচেতন অবস্থায় শুয়ে আছে। কোনোদিন ভাবতে পারিনি লিসাকে আমি এই অবস্থায় দেখবো। অনেক চেষ্টা করেছিলাম লিসাকে খোঁজার, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি। আজ অপ্রত্যাশিত ভাবে আমার পেশেন্ট হিসেবে ভেন্টিলেশনে ওয়ার্ডের বেডে শুয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে লিসা। আমার হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা আজ কোভিড-19 এর কবলে। জানিনা ওর ভবিষ্যত কি???