Moods, Moments আর প্রেম – বিন্দু By ঋতুপর্ণা খাঁ

পত্রলেখা

১৫ বছর আগের একটি গাঁথা |

পশ্চিমবঙ্গের সুন্দর একটি শৈল শহরে আমার বাস। সেন্ট মেরিস কালিম্পং স্কুল এর ইংরেজি বিভাগের ২৫ ঊর্ধ্ব সুন্দরি অবিবাহিত এক শিক্ষিকা আমি। নাম নয়নতারা দত্ত। স্কুল এর সহকর্মি, পাড়া, প্রতিবেশী, অনেকেরই ভাললাগা বা কাছে আসার কারন ছিলো আমার রূপ। সেটা বুঝেই সবসময়ে নিজেকে বাঁচিয়ে চলতে হত। অনেকের অনেক রকম অনুভূতি থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখতে হত। এই দীর্ঘ অনুগতদের মধ্যে অন্যতম ছিল নীলাঞ্জন সেন। সে তখন আমারই স্কুলের ক্লাস ১০ এর ছাত্র। আমার রুপ, গুন, স্বভাবে মন্ত্র মুগ্ধ এক উপাসক। খুব মেধাবী ছাত্র। ইংরেজি ভাষার জ্ঞান অনবদ্য। খুব সুন্দর কবিতা লিখত। স্কুলে অনুপস্থিতির চিঠি গুলোতেও তার ভরা থাকতো কাব্যিক ছন্দে এবং সেটাতে স্বাক্ষর করা থাকতো তার অভিভাবক এর।
আমার পরম অনুরক্ত ছিল নীলাঞ্জন। আমার প্রতি তার অনুভূতির গভীরতা বুঁঝতে পারলেও, তার টানে কখনও সারা দেইনি কারণ আমাদের দু জনার সমাজিক পরিস্থিতি বা বয়সের ব্যবধান বাঁধা সৃষ্টি করত হয়ত।
সেটা ছিল ২০০৪ সালের ২৪সে ডিসেম্বর। বড়দিনের আগের সন্ধ্যা। ক্যাথেড্রাল এ যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে বেরোব, এমন সময় কলিং বেলটা একটা অন্য সুরে গেয়ে উঠলো। দ্বার খুলতেই দেখি সহাস্য মুখে আমার দুয়ারে মুর্তিমান স্বয়ং নীলাঞ্জন।
“মেরি ক্রিসমাস তারা! না, মানে, নয়নতারা ম্যাডাম।” একগুচ্ছ গোলাপ আমার সামনে মেলে ধরল।
“মেরি ক্রিসমাস নীলাঞ্জন”, নিজের গাম্ভির্য্য বজায় রেখে স্মিত মুখে প্রত্যুত্তর করলাম আমি।
ওর খুব ইচ্ছে ছিলো আমি যেন ঘরে ডেকে একটু অ্যাপায়ান করি। কিন্তু সে সময় আমার ছিলনা কারণ ক্যাথেড্রালে প্রার্থনার সময় হয়ে গেছিল এবং তাকে ঘরে ডেকে দু-কথা বলার কোনো মনবাসনা ও আমি জ্ঞাপন করিনি। নীলাঞ্জন ছায়ার মতন আমার সাথে সাথে গেছিল। প্রার্থনার সময় চুপ করে আমার পাশে দাড়িয়ে ছিল। যখন ঘন পাইনের বনানীর ভিতর দিয়ে ফিরে আসছি,হঠাৎ আমার হাতে একগুচ্ছ কাগজ ধরিয়ে দিয়ে কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেল। ওর আঙ্গুল আমার আঙ্গুল কে স্পর্শ করেছিল। সেই মাত্র একটিবার,আমরা একে অপরকে স্পর্শ করেছিলাম।
কিছু সময় সম্মোহিত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। তারপর ঘড়ে ফিরে কাগজ গুলো খুলে পড়তে পড়তে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। হ্যাঁ, কি সুন্দর সেই প্রেমপত্র। সহজ সরল ভালবাসার অঙ্গীকার। এই আরতি তে সারা না দিয়ে থাকা সত্যিই কি সম্ভব!
কিন্তু আমি তো নয়নতারা দত্ত, নীলাঞ্জন সেনের ইংরেজির দিদিমনি। আমার যা করা উচিত ছিল তাই করেছিলাম।
বড়দিন এর ছুটি শেষ হওয়ার পর ২ রা জানুয়ারী, ২০০৫ সালেই আমি নীলাঞ্জন কে আমার বাড়িতে ডেকে পাঠিয়ে ঐ চিঠিগুলো লেখার পিছনের কারণ জানতে চেয়েছিলাম এবং সে অকপটে তার ভালোবাসার কথা স্বীকার করেছিল।
তার ভালোবাসা প্রত্যাখ্যান করেছিলাম এবং তাকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম যে এইরকম অলীক সম্পর্ক সমাজের চোখে মূল্যহীন। আমাদের বয়েসের ব্যবধান প্রায় এক যুগ। কিন্তু তার সবুজ মন কিছু বুঝতে চায়নি।
“তাতে কি হয়েছে ম্যাডাম? ১০ বছর পর আমি ২৫ বছরের হয়ে যাব!” অবুঝের মত আবদার করেছিল সে।
“উফ নীলাঞ্জন, তখন আমার বয়স ৩৫ হয়ে যাবে!” এ ছাড়া আর কি উত্তর ই বা ছিল আমার কাছে?
সেদিনের পর থেকে অভিমানি ছেলেটি আমার ক্লাসেই আর কোনদিন এসে বসে নি। আই সি এস ই- র পরিক্ষার পর তার বাবা মুম্বই তে বদলি হয়ে গেছিল বলে, উচ্চ মাধ্যমিক এর পড়াশোনা সে কালিম্পং এ করতে পারেনি। এবং ২ রা জানুয়ারী সন্ধ্যার পর তার সাথে আমার আর কোনোদিন দেখা ও হয়নি।
ডিসেম্বর ২০১৮।
আমি নীলাঞ্জন সেন। আজ অফিসে কাজের চাপটা বড্ড বেশি ছিল। ঘরে ফিরেই অনুরাধা ঘাঁড়ে আলতো করে হাঁত রাখতেই সব ক্লান্তি যেন কোথায় দূর হয়ে গেল। অনুরাধা আমার গলা জড়িয়ে আদর করে সুন্দর একটা খাম আমার হাতে ধরিয়ে দিল।
আদরের স্ত্রীর কাছেই আবদার করলাম, “অনু, তুমি ই খুলে দেখ না , কি আছে ওতে?”
নীলাঞ্জন সেন,এই পত্রের দ্বারা আপনাকে নিমন্ত্রণ জানানো যাইতেছে যে আপনি অনুগ্রহ করে ২ রা জানুয়ারী ২০১৯ স্কুলের আলাম্নি মিট এ উপস্থিত থাকিবেন। আপনার উপস্থিতি একান্ত ভাবে কাম্য।”প্রিন্সিপাল, সেন্ট মেরিজ কালিম্পং”। অনুরাধা এক নি:শ্বাসে চিঠিটা পড়ে শোনাল তার আদরের নীল কে। “ও:হো অনু! কি যে আনন্দ হচ্ছে তোমায় বলে বোঝাতে পারবনা। এই প্রথম এই সময় আমি দেশে আছি।আমি আলুম্নি মিটে অংশ নিতে পারবো। “নীলাঞ্জন এর সম্মুখে সজিব হয়ে উঠলো পুরনো স্মৃতি। সেই স্কুলের মাঠ,ক্যান্টিন,কবে কার সেই বন্ধু বান্ধব,ক্লাসরুমের- হ্যাঁ ইংরেজির দিদিমনি, নয়নতারা ম্যাডাম,মনে মনে যাকে তারা বলে ডাকতো সে। ১৫ বছরের কিশোরের সেই ছেলে মানুষীর কথা ভাবতে ভাবতে নিজের মনেই হেসে ফেলল। “আচ্ছা আচ্ছা, হয়েছে,এবার বলতো, কবে যাবে,কবে ফিরবে? ট্রাভেল এজেন্ট কে ফোন করে তোমার টিকিট এর ব্যবস্থা করি আমি। আর হ্যাঁ,আমি কিন্তু যেতে পারব না, মা এর চোখের অপারেশনের জন্য আমায় দিল্লি যেতে হবে, মনে আছে তো?” অনুরাধা তোড়জোড় শুরু করে দিলো। “ঠিক আছে সোনা,৩১ তারিখের সকালের ফ্লাইটের টিকিট লাগবে মুম্বাই থেকে বাগডোগরার আর ফেরার টিকিট ৪ তারিখ সকালের। কিন্তু এবার তোমার সাথে নতুন বছরের পার্টিটা খুব মিস করব।ওখানে গিয়েও তোমার কথাই বার বার মনে পড়বে।” নীলাঞ্জন এর মনটা একটুর জন্য খারাপ হয়ে গেল।”। ১লা জানুয়ারি,২০১৯ আমি,নীলাঞ্জন সেন, ফিরে এলাম আমার সেই ছেলেবেলার দেশে।মাঝখানে ১৫ বছরের ব্যবধান। স্মৃতিগুলি মনের ভিতরে উঁকি দিচ্ছিল। সব চেয়ে সুন্দর,সজিব,মিষ্টি স্মৃতি মনিকোঠা থেকে বেরিয়ে এল, হ্যাঁ তারা, নয়নতারা দত্ত। আমার সেই কিশোর বয়েসের ভাললাগা। স্কুলের বর্তমান কর্তৃপক্ষ এবং এলাকার কিছু মানুষজনের সাথে আলাপচারিতা সারতে সারতে আমার মাথায় বজ্রাঘাত হল যখন জানতে পারলাম, নয়নতারা দত্ত আর নেই। ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে উনি সেই সুদূরে চলে গেছেন যেখান থেকে চাইলেও আর ফেরত আসা যায় না। ২০০৬ সালের ২রা জানুয়ারি রাত ১১.৩০ নাগাদ প্রাণঘাতী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। বয়েস হয়েছিল ২৫ কি ২৬। স্কুল কর্তৃপক্ষ ঐ দিনটিকে নির্বাচন করে নেন আলাম্নী মিট এর দিন হিসেবে। তার সাথে সাথে নয়নতারা ম্যাডামকে স্মরণ ও করা হয়। কিছুদিন তাঁর বাসস্থানটি খালি পড়েছিল। কিন্তু তাঁর তো কোনো আত্মীয়স্বজন ছিলনা। তাই স্কুল কর্তৃপক্ষ সুন্দর বাড়িটিকে একটি গ্রন্থাগারে পরিণত করে এবং সেটি রক্ষনাবেক্ষনের সব দায় গ্রহন এবং বহন করে। সেই ২০০৮ সাল থেকে এভাবেই চলে আসছে। এক সমুদ্রভাঙ্গা হৃদয় নিয়ে,স্কুলের দারোয়ানের সাথে হাজির হলাম তারার সুন্দর গৃহকোনটির সম্মুখে। না, কিছুই তো বদলায়নি। সেই একই রকম শান্ত সৌম্য, নিরাসক্ত। তারার অনুপস্থিতি তাঁর উপস্থিতিকে আর গাঢ় করে তুলছিল। দারোয়ান ঘর খুলে দিয়ে নিজের কাজে চলে গেল। ঘরে ঢুকে সর্বত্র তাঁর ঘ্রাণ মনকে জুড়িয়ে দিচ্ছিল। হঠাৎ চোখে পড়লো ফায়ার প্লেস এর উপর খুব সুন্দর একটি রুপোর বাক্স। ছোট্ট একটি তালা দিয়ে তাকে শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রাখা হয়ছে। বাক্সের উপর যে অক্ষর টি জ্বলে উঠছিল, সেটা হলো “ন”। এই শৃঙ্খল ভাঙ্গার দায়ে এবং অধিকার একমাত্র কার সেটা বুঝতে আর বাকি রইল না আমার। চোখের পলকে তালা ভেঙ্গে বাক্সের রহস্য উন্মোচন করলাম,আমি,নীলাঞ্জন সেন। আমার প্রতিটি আঙ্গুল আমার সিক্ত চোখের পাতার মতন কাঁপছিল। সেই পুরোন হলদে গন্ধে মাখা কাগজগুলো হাতে নিয়ে মনে হলো, কি সুন্দর হাতের লেখা ছিল আমার,কই এখন তো আর এত সুন্দর লিখতে পারিনা! এত সেই ১৫ বছর আগে বড়দিনের আগের সন্ধ্যায় তারা কে লেখা চিঠি আর তারা। সেই কৈশোরে মাখা প্রেমপত্র। তারপর বেরিয়ে এলো সুন্দর একটি গোলাপী রঙের কাগজ। কম্পিত হস্তে কাগজটি নিজের সামনে মেলে ধরলাম এবং তার সাথে চিরন্তন প্রেমের গভীর এক অনুভূতি আর বেদনা অনুভব করলাম হৃদয়ের কোন গহন বনে: “নীল, আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয় নীল, আজ তোমার কাছে একটি স্বীকারোক্তি রেখে যেতে চাই। তোমার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য চিরকাঙ্গালিনী আমি। আমার সারা মনে, মননে,শরীরে, সত্ত্বায় শুধু তুমি। আমাদের দুজনের নাম চিরকাল গাঁথা হয়ে থাকুক আমার প্রেমের জয়গাঁথায়। তোমার, শুধুই তোমার, নয়নতারা (তারা)।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।