কর্ণফুলির গল্প বলায় রবীন জাকারিয়া

বন্ধু তুমি শত্রু তুমি

(মুখবন্ধ: এখনকার জেনারেশন শুধু চিঠির নামটি শুনেছে৷ কিন্ত এর গুরুত্ব, আবেগ কিংবা প্রয়োজনীয়তা জানে না৷ জানবার কথাও নয়৷ কেননা তারা আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর সাথে অভ্যস্থ৷ যার রেসপন্সও তাৎক্ষণিক৷ এই গল্পের ফরম্যাটটা তাই “চিঠি”র আদলে লেখা৷ যাতে হারিয়ে যাওয়া চিঠির Flavourটা কিছুটা হলেও উপলদ্ধি করে৷)

জয়া,
শুভেচ্ছা নিও৷
একদা আমরা কেউ পূর্বপরিচিত ছিলাম না৷ তাই স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মাঝে শত্রুতা থাকার প্রশ্নই আসে না৷ কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় অন্যদের চেয়ে ভাল করেছি বলেই তুমি আমাকে অন্য চোখে দেখা শুরু করলে৷ তোমার চোখের ভাষা বুঝবার মত মেধাবী বোধ হয় ছিলাম না৷ তাই সহপাঠী -বন্ধুর মতো মিশতাম৷ হঠাৎ তুমি যখন স্বপ্নের ফেরিওয়ালা হয়ে আসলে৷ আমি প্রত্যাখান করেছিলাম নিজের সীমাবদ্ধতা, দারিদ্র্য আর পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধের যুক্তিতে৷ কেননা সাধারণ এক দরিদ্র বর্গাচাষির ছেলে যে কিনা টিউশনি করে সংসার চালায়৷ সে তোমার মত বিত্তবানের মেয়ের জীবনসঙ্গী হতে পারে না৷ বড় জোর বন্ধু হতে পারে৷ বরাবরের মত জেদী তুমি৷ মানতে পারলে না কিছুতেই৷ তখন কি আর জানতাম এর জন্য আমাকে একদিন চড়া মাশুল গুনতে হবে?

নদীর স্রোতের মত সময় বহমান৷ শিক্ষার পাঠ চুকিয়ে কে যে কোথায় চলে গেলাম৷ এর হদিশ কারোই জানা থাকলো না৷

মামা-চাচা আর ঘুষ না দিলে এখানে কোন চাকরিই পাওয়া যায় না৷ আমার এগুলোর কোনটাই ছিল না৷ তাই চাকরিও হলো না৷ ব্যবসা করার মত যথেষ্ট মূলধনও ছিল না৷

অবশেষে জীবন শুরু করলাম NGOর চাকরি দিয়ে৷ ২০ বছর ধরে বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থায় সুনাম ও দক্ষতার সাথে কাজ করেছি৷ কিন্ত এ পেশার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো প্রজেক্টের চাকরি৷ চাকরির মেয়াদ আর কর্মস্থলের কোন ঠিক ঠিকানা নেই৷ প্রতিনিয়ত চাকরির ভয় আর নতুন চাকরির প্রস্ততি৷ ঠিক এমনি একদিন একটি প্রতিষ্ঠানের আমন্ত্রণে নিয়োগ পরীক্ষা দিলাম এবং নির্বাচিত হলাম৷ অফিস থেকে জানানো হলো৷ প্রতিষ্ঠানের প্রধান দেশের বাহিরে আছেন৷ উনি দেশে ফিরলেই নিয়োগ পত্র পাঠিয়ে দেবেন৷ দিন কয়েক পর নিয়োগ পত্র পেলাম৷ চাকরির খবরটা যখন নিশ্চিত করলো৷ তখন শুধু আমি নই আমার মা, স্ত্রী এমনকি আমাদের কচি দুটি সন্তানও নফল নামাজ পড়েছে৷ অনেক স্বপ্নের জাল বুনলাম৷ চাকরিহীন মানুষের কাছে প্রতিটি টাকা অত্যন্ত মূল্যবান৷ তারপরেও রোজায় বাড়িতে থাকবোনা বলে মাসের সমস্ত বাজার করে দিলাম৷ কুড়ি হাজার টাকা সাথে নিয়ে এখানে জয়েন করলাম৷ আসার সময় আমার সন্তানরা বলেছিল বাবা ঈদে তুমি ঢাকা থেকে আমাদের জন্য কেনাকাটা করবে৷ আর ঈদের পর আমাদেরকে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে চিড়িয়াখানা, স্মৃতিসৌধ, শিশুপার্কসহ সব কিছু দেখাবে৷ আমি বললাম ঠিক আছে৷ কিন্ত এ কী! জয়েন করার দিনে HR Officer বললেন “এখন আমাদের ম্যাডামের সাথে দেখা করুন৷ উনি আপনাকে সব বিষয়ে Orient করবেন”, বলে একটি চেম্বারে ঢুকিয়ে দিলেন৷ ভেতরে এত বড় বিশ্ময় অপেক্ষা করছিল৷ তার জন্য মোটেও প্রস্তত ছিলাম না৷ কেননা সে-ই ম্যাডামই হচ্ছো তুমি৷ আমার প্রিয় বন্ধু৷ সহপাঠি৷ প্রথমে বিশ্মিত হলেও পরে অবশ্য খুশিই হয়েছিলাম৷ কিন্ত কে জানতো তোমার ভেতরে তুমি পুষে রেখেছ বহুকাল আগের ক্রোধ৷ তাই প্রথম দিনেই তুমি বুঝিয়েছিলে তুমি আমার বস৷ মেনে নিলাম কেননা এটাই পেশাদারিত্ব৷ প্রতিদিন ইচ্ছে করেই অপমান আর আমি অযোগ্য এটা প্রমাণ করতে থাকলে৷ কুড়িদিনের মাথায় তুমি জানিয়ে দিলে “আপনার এখানে চাকরি করার দরকার নেই৷ যে ক’দিন কাজ করেছেন তার বেতন-ভাতা তুলে নেন৷ আমি একাউন্টসকে বলে দিচ্ছি৷” লজ্জা আর অপমানে মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করলো৷ তাড়াতাড়ি এখান থেকে পালাতে হবে৷ বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে৷ দরজার কাছে আসতেই তুমি টাকা তোলার তাগাদা দিলে৷ কিন্ত আমি ভিক্ষুক নই৷ আমি সংগ্রামী মানুষ৷ কেউ না জানুক৷ তুমি ভাল করে জান৷

তোমরা সমস্ত স্বপ্ন চূড়মার করলে৷ নিজেদের স্বার্থে৷ কার জন্য এত স্বার্থপরতা কিংবা টাকা কামাচ্ছো অন্যের ক্ষতি করে? আল্লাহ্ না করুন একদিন দেখবে তুমি মৃত্যুশয্যায়৷ আর বেশি খরচের আশংকায় তোমার প্রিয়জনরাই কাছে থাকবেনা৷ তখন প্রতিটা মূহুর্ত একাকীত্বের সাথে হিসাব মেলাবে ফেলে আসা সময়ে কত স্বপ্নের হত্যাকারী ছিলে নিজে৷ বহু উপমা আছে৷ অতি সম্স্রতি বেশ কিছু বিত্তশালী ব্যক্তি করোনায় মৃত্যুর আগের অনুভূতি ভাল করে পড়ে দেখো৷

যতই পশ্চিমা পোষাক পড় না কেন৷ অবশেষে তুমি একজন বাঙ্গালী, মুসলমান এবং একজন মা৷ দিনশেষে প্রিয় অবসরে নিজের কাজগুলোকে দয়া করে বিবেকের আয়নায় দেখার চেষ্টা কোরো৷ আমি নিশ্চিত সেখানে অপমানিত এক ব্যক্তির অশ্রুমন্ডিত মুখখানা দেখবেই দেখবে৷
ভাল থেকো৷

ইতি
তোমার সেই লেখক
প্রকৃতই এক বোকা লোক

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।