কর্ণফুলির গল্প বলা সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে রবীন জাকারিয়া (পর্ব – ৩)

(এই ধারাবাহিক গল্পের প্রত্যেকটি পর্বই স্বতন্ত্র৷ বলা যায় একেকটি গল্প৷ তাই একটি পর্বের পর অন্য পর্ব না পড়লেও পাঠকদের অসুবিধা হবেনা৷ তবে প্রত্যেকটি পর্ব পাঠ করলে একটা উপন্যাসের স্বাদ পাবেন বলে আশা করি৷)

ভাই

আমাদের পরিবারের উপর দিয়ে একটা বড় ঝড় বয়ে গেল৷ আলহামদুলিল্লাহ্ এর পরেও মার সুচিকিৎসা হলো৷ আমরাতো মার বেঁচে ফেরার আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম৷ কিন্ত স্বপ্নের মত সব কিছু ঠিক ঠাক মিলে গেল৷ আমার আশ্চর্য লাগে আল্লাহ্ কোথা থেকে কিডনীর ব্যবস্থা করে দিলেন৷ বড়দা পারেও ম্যানেজ করতে সবকিছু৷ ওকে বলবো মাকে কিডনী দানকারী ঐ ব্যক্তির বাড়িতে নিয়ে যেতে৷ ওনার জন্য দোয়া করবো সারা জীবন৷
হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পর মা ধীরে ধীরে সুস্থ্য হয়ে উঠছে৷ তবে শক্ত কাজ করা বারণ৷ আর ক’দিন পর বড়দা চলে যাবে৷ ইউনিভার্সিটি ফাঁকি দিয়ে ইতিমধ্যে অনেকদিন কাটালো৷ সামনে মাস্টার্স পরীক্ষা৷ যদিও পরীক্ষা হয় হয় করে আর হয় না৷ সেশন জট বেড়ে যাচ্ছে৷ আমাদের মত পরিবারের সন্তানদের জন্য এটা জুলুম ছাড়া কিছু নয়৷ অবশ্য শুধু সরকার নয়৷ নোংরা ছাত্র রাজনীতি করে যারা ফায়দা লুটতে চায়৷ তারাও কম দায়ি নয়!
কিছুদিন ধরে বড়দাকে খুব মলিন আর নিস্তেজ মনে হয়৷ জিজ্ঞেস করলে বলে পরীক্ষায় চিন্তা করছিরে ছোট৷ তাছাড়া চাকরি বাকরি না করলে তোর আর মা”র কী হবে? মা’র স্বপ্ন পূরণ করতে হবে না? বলে কাঁদতে কাঁদতে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো, “শোন ছোট আমি যদি না-ও পারি৷ কথা দে তুই মা’র স্বপ্ন পূরণ করবি!” বললাম করবো৷ তবে তুই আগে বড় হ বড়দা৷ তুই যে আমার প্রেরণা৷

বড়দা চলে যাবার পর বাড়িটা একেবারে ফাঁকা ফাঁকা লাগছে৷ মা সারাদিন কান্নাকাটি করে৷ মাকে বোঝাই এ শরীরে বেশি টেনশন না করতে৷ শোনে না৷ বোঝে না৷ যতই দিন মা যেন অবুঝ হচ্ছে৷ মায়া হয়৷ রাগ লাগে৷ কিন্ত রাগ হইনা৷ বরং সংসারের টুকিটাকি কাজ করি৷ মাকে সাহায্য করি৷ এ বাড়িতে কোন মেয়ে নেই৷ ইদানিং মা বৌমার মুখ দেখতে চায়৷ বড়দার বিয়ের পাত্রিও ঠিক করে রেখেছে৷ আমাদের গ্রামের জোতদারের মেয়ে৷ বড়দা হ্যা-না কিছুই বলেনি৷ বলেছে মা যা চাবে, তাই হবে৷ কনে পক্ষকে বড়দার চাকরি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে৷ ওরা খুশি৷ মাঝে মাঝে এটা ওটা পাঠায় হবু বেয়াইনির বাড়িতে৷ আমার হবু ভাবি সুযোগ খুঁজে প্রায়ই মা’র সাথে দেখা করে৷
বড়দা অনেকদিন ধরে আসে না৷ বলেছে সামনে পরীক্ষা৷ পড়ার চাপ৷ পরীক্ষা শেষ হলে একেবারে আসবে৷ আর যাবে না৷
নব্বই এর দশক৷ চারিদিকে আন্দোলন৷ ঢাকা ইউনিভার্সিটির অবস্থাও দিন দিন খারাপ হতে থাকলো৷ ছাত্রদের আন্দোলন চলমান৷ সংঘাত প্রকট আকার ধারণ করলো৷ হত্যা, খুন, হল দখল আর পুলিশের গুলির সংবাদ প্রতিদিন আসতে থাকলো৷ কর্তৃপক্ষকে পুনরায় পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিতে চাপ দিতে থাকলো ছাত্র সংগঠণগুলো৷ এমন অবস্থায় বড়দার মতো সাধারণ ছাত্র-ছাত্রিরা পরীক্ষা আয়োজনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে আহ্বান করলো৷ এটা ছাত্র সংগঠণগুলো ভাল ভাবে গ্রহণ করলো না৷ হুশিয়ার করলো৷ এদের উপযুক্ত শাস্তি দিবে৷ কিন্ত বড়দার মত সত্যিকারের শিক্ষার্থিরা ক্ষেপে উঠলো৷ সংগঠিত হলো৷ প্রতিবাদ করতে থাকলো৷ এমনিতেই বড়দার উপর ছাত্র নেতাদের একটা পূর্ব আক্রোশ আছে৷ কেননা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় থেকেই বিভিন্ন সংগঠণ তাকে দলে ঢুকানোর চেষ্টা করেছে৷ বিশেষ করে ভাল ছাত্রদের সব দল দলে টানতে চায়৷ কিন্ত বড়দা বিনয়ের সাথে এসব প্রস্তাব প্রত্যাখান করে৷ তার একটাই কথা৷ পড়তে এসেছি৷ পড়বো৷ লেখাপড়া শেষ করে যদি রাজনীতি পছন্দ হয়৷ রাজনীতি করবো৷ না হলে অন্য পেশায় যাবো৷ এখন স্বপ্ন একটাই লেখাপড়া শেষ করে দেশের কাজে লাগাবো৷
প্রতিদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে৷ মা, আমি, আমরা টেনশন করি৷ ভয়ে মা খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে৷
প্রতিদিন বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রতিবেদন দেখায়৷ বাজারের চায়ের দোকানগুলো নতুন কৌশল চালু করেছে৷ সব সময় টেলিভিশন চালু থাকে৷ এতে বেচা বিক্রি বাড়ে৷ শুধু শুধু বসে টিভি দেখা যাবে না৷ কিছু খেতে হবে৷ আমি ক’দিন ধরে নিয়মিত টিভি দেখি৷ চা খাই৷ শেষ হলে আরো চা খাই৷ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি বিভিন্ন ছাত্রের সাক্ষাৎ নিচ্ছে৷ পরীক্ষা নিয়ে ভাবনার কথা বলছে৷ এমন সময় হঠাৎ দেখলাম বড়দা তার নিজস্ব বক্তব্য তুলে ধরলো৷ তার মতে “পরীক্ষাটা যথা সময়ে হওয়া দরকার৷ না হলে আমাদের মত দরীদ্র ছাত্ররা ঝরে পরবে৷ তারা শিক্ষাজীবন শেষ করতে পারবেনা৷ আমরা শিক্ষা লাভের জন্য বিশ্ব বিদ্যালয়ে এসেছি৷ রাজনীতি করতে নয়৷” টেলিভিশনে বড়দাকে দেখাচ্ছে শুনে দোকানে লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল৷ সকলে গর্ব করলো৷ আমিতো বেজায় খুশি৷ আমার গুরু৷ আমার অহংকার বড়দাকে টিভিতে দেখা গেছে৷ ছুটে এসে মাকে বললাম৷ সব শুনে মা কেমন ভীত হয়ে গেল৷ তাকে আতঙ্কিত মনে হলো৷ মা ওকে চিঠি লিখতে বললো৷ যেন তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে আসে৷ তাই করলাম৷
চিঠিটা পেয়েছে কি-না জানিনা৷ কেননা দু’দিন পর এক মহা দুঃসংবাদ পেলাম৷ ছাত্র সংগঠণের নেতা দাবী করা গুন্ডা-সন্ত্রাসীরা বড়দাকে পিটিয়ে হত্যা করেছে৷ তার অপরাধ ছিল সে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত করার পক্ষে মিডিয়ায় বক্তব্য দিয়েছে৷ ছাত্র আন্দোলনের বিপক্ষে এবং সরকারের পক্ষে দালালি করেছে৷ কিন্ত সাধারণ ছাত্ররা জানে কেন তাকে প্রাণ দিতে হলো৷
বড়দাকে তারা ক্যাম্পাস থেকে উঠিয়ে নিয়ে যায় একটি হলে৷ সেখানে ছাত্রবেশী সন্ত্রাসীরা আটকিয়ে রাখে৷ ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে দফায় দফায় মারতে থাকে৷ বড়দা প্রাণ চেয়েছে৷ ওরা শোনেনি৷ পালাক্রমে নির্যাতন চালায়৷ ব্যথায় কাতরাতে থাকে৷ প্যারাসিটামল ট্যাবলেট খাওয়ায়৷ কিছুটা সুস্থ্য হলে আবার পেটাতে থাকে৷ শেষে রাতের বেলা মৃত্যু নিশ্চিত জেনে লাশটা গায়েব করার চেষ্টা করে৷ কিন্ত অন্যদের হাতে ধরা পরে৷ লাশ ফেলে তারা পালিয়ে যায়৷ এরমধ্যে সারাদেশে জঘণ্য হত্যার খবর ছড়িয়ে পরে৷
কী করে এতো নির্মম আর বিভৎস হয় মানুষ৷ বিশেষ করে দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থি৷ যারা আগামীতে এক বৈষম্যহীন, উন্নত আর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালনা করবে৷
আমাদেরকে পরেরদিন খবরটা নিশ্চিত করে স্থানীয় প্রশাসন৷

বাড়িতে শোকের ছায়া৷ মা বার বার “সাজুরে, আমার সাজু” বলে চিৎকার করে মূর্ছা যাচ্ছে৷ আমার বুকের ভেতর কেন জানি কোন আবেগ দেখতে পাচ্ছি৷ কাঁন্না বেরুচ্ছে না৷ আমার সবচেয়ে প্রিয়জন৷ গুরু৷ নিরাপত্তার আশ্রয়স্থল৷ স্বপ্নের বাতিঘর৷ বড়দা আর নেই৷ বিশ্বাস হচ্ছে না৷ শুধু মা’র কথা ভাবছি৷ এবার বোধ হয় মাকে আর বাঁচানো যাবে না৷ বুকের ভেতর হাহাকার৷ তীব্র ক্ষোভ৷ প্রকাশ করতে পারছি না৷ তবে কি আমিও বেঁচে নেই? নাকি এ কষ্ট আর যন্ত্রনার জন্য একটা যন্ত্র হয়ে গেলাম!
বিকেলের দিকে ভার্সিটির কয়েকটি গাড়ি আসলো৷ ছাত্র-শিক্ষক ভরা গাড়ি৷ সাথে লাশবাহী ফ্রিজিং গাড়ি৷ যে গাড়িতে শুয়ে আছে আমার প্রিয় বড়দা৷ দৌড়ে গেলাম গাড়িটার কাছে৷ চিৎকার ডাকলাম বড়দা উঠনা বড়দা৷ চল গাছে কত ফল ধরেছে৷ পেড়ে আনি৷ দু”ভাই পেট ভরে খাব৷ আমরা যে অনেক গরীব৷ দ্যাখ আজকে যে পেটে কোন ক্ষিদে নেই৷ বুকে ক্ষিদে৷ বড্ড ক্ষিদেরে বড়দা৷ আর কান্না আটকাতে পারলাম না৷ কখন মা এসে জড়িয়ে ধরেছে জানিনা৷ মাকে পেয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলাম৷ বুকের ভেতর যেন মস্ত পাথর চাপা দিয়েছে৷

বাড়ির চারিদিকে লোকারণ্য৷ দূর দূরান্ত থেকে মানুষ এসেছে৷ চিনি না৷ বড়দার কারণে এমন দৃশ্য অনেকবার হয়েছে৷ বৃর্ত্তি পাওয়ার সময়৷ এসএসসি ও এইচএসসি-তে স্ট্যান্ড করার সময়ও অনেক লোক এসেছিল৷ সাংবাদিক এসেছিল৷ আজ বড়দার লাশ এসেছে৷ আজও অনেক লোক৷ শুধু পার্থক্য হলো৷ অন্যদিনগুলোতে আনন্দ করেছি আর মায়ের মুখে ছিল বিজয়ের হাসি৷ আজ অত্যন্ত বেদনার দিন এবং মাকে দেখে মনে হচ্ছে পরাজিত এক সৈনিক৷

ফুলে ভরা লাশের গাড়ি থেকে বড়দাকে বের করে আনলো৷ চারিদিকে প্ল্যাকার্ড আর ব্যানারে লেখা “শহীদ সাজু আহমেদ” হাতে নিয়ে ভার্সিটির বন্ধু, সহপাঠি, শিক্ষকরা সম্মান জানালো৷ বিশাল জানাজা শেষে বাড়ির পাশের একটা আতা গাছের নীচে সমাধিস্থ করা হলো৷
মা কবরের উপর মাথা রেখে কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে গেল৷ তাকে বাড়িতে নেয়া হলো৷
ভার্সিটি থেকে আগত সকলেই বিদায় নিয়ে নিজ নিজ গাড়িতে বসলো৷ কান্নামাখা কন্ঠে বিদায় জানিয়ে মা’র কাছে চলে আসবো৷ এমন সময় একজন শিক্ষক আমাকে ডাকলেন৷ কাছে গেলাম৷ তিনি আমার হাতে একটা ফাইল ধরিয়ে বললেন এটা পোস্ট মর্টেম রিপোর্টের কাগজ পত্র৷ যত্ন করে রেখে দিয়ো৷ এসব কোন কাজে লাগবে না৷ তাছাড়া বুঝিও না৷ তবুও হাতে নিলাম৷ চলে আসবো এমন সময় উনি বিশ্মিত করার মতো একটা তথ্য দিলেন৷ তোমার বড়দার শরীরে দুটি নয়৷ একটি কিডনীর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে৷ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলাম দূর দিগন্তের দিকে৷ কতক্ষণ জানিনা৷ সম্বিত ফিরে পেয়ে দেখলাম কেউ নেই৷ আমি দাঁড়িয়ে আছি একা৷ এই প্রথম নিজেকে একলা একা মনে হলো৷ ভয় পেলাম৷ প্রচন্ড ভয়! বড়দা ছাড়া একা আমি পারবোতো টিকে থাকতে? বাবা-মা আর বড়দা অধরা স্বপ্নকে পূরণ করতে? অজান্তেই চোয়াল শক্ত হয়ে খেল৷ ভর করলো জেদ আর অভিমান৷ তাই বিড়বিড় করে ভীষণ অভিমান মাখা কন্ঠে শুধু বললাম বড়দা তুই মিথ্যুক৷ আমাদের জন্য তুই নিজের জীবনের সবটাই যে বিলিয়ে দিলি বড়দা৷ তুই সারা জীবন বেঁচে থাকবি৷ হয়তো শারীরিকভাবে নয়৷ আত্মিকভাবে৷ বিমূর্তরুপে৷

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।