গারো পাহাড়ের গদ্যে রবীন জাকারিয়া

গ্যাদা এবং গণতন্ত্র-নিবন্ধ
আশির দশকে গোটা বিশ্বে বিশেষ করে বাংলাদেশের ন্যায় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রনের জন্য উঠে পড়ে লাগলো৷ যেভাবেই হোক জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রন করতে হবে৷ এ জন্য বড় বড় প্রকল্পের কাজ শুরু হলো৷ সকল মিডিয়ায় এমনকি সরকারী প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জনসচেতনতা তৈরির কাজ পুরোদমে চালু করা হলো৷ ফল পেতে খুব দেরী হলো না৷ জনগণ সাড়া দিতে থাকলো৷ মূলত দুই শ্রেণির লোকের একাত্বতা অভিভূত করবার মতো৷ একটি শ্রেণি হলো প্রান্তিক জনগোষ্ঠী৷ যারা দুইয়ের অধিক সন্তান নেয়ার পর কিছু আর্থিক মুনাফার লোভে স্থায়ী বন্ধ্যাত্বকরণ কার্যক্রমে নিজের অন্তর্ভূক্তি করলো৷ আর অন্যটি হলো সমাজের শিক্ষিত, বিচক্ষণ ও নাগরিক সমাজ৷ যারা নিজেরাই স্বতস্ফুর্তভাবে নিজেদের নাগরিক দায়িত্ব পালন করতে থাকলো৷
এদিকে আশির দশকে কৃষি ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা থেকে শিল্প নির্ভর সমাজে আমাদের যাত্রার ফলে ভৌত অবকাঠামো, নতুন নতুন পেশার সামাজিকিকরণ ও লাইফ স্টাইল পরিবর্তিত হতে থাকলো৷ পাশাপাশি আকাশ আগ্রাসন আর রাতারাতি ধনী হওয়ার নির্লজ্জ রেসের দৌড়৷ ফলে নাগরিক সমাজ তাদের সন্তানদের করে ফেললো “ব্রয়লার মুরগি”তে৷ যারা নিত্য বেড়ে উঠতে থাকলো ফ্ল্যাট নামক একটি আধুনিক কয়েদখানায়৷ বিজ্ঞানের জিনগত তথ্য অনুসারে নাগরিক সমাজের নিকট থেকে আরো মেধাবী প্রজন্ম পাওয়ার পথ হয়ে গেলো সংকুচিত৷ আবার তথাকথিত সীমাবদ্ধ গন্ডির ভেতর লালিত হতে থাকলো আগামীর ভবিষ্যৎ৷ পিতা-মাতার অধরা স্বপ্নকে বাস্তবায়নের জন্য এরা হয়ে গেল মানুষরুপী গিনিপিগ৷ নিজস্ব ইচ্ছে, স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবার সক্ষমতা আর শ্রেণি বিভাজনের শিক্ষায় এরা হয়ে উঠতে থাকলো এক পরনির্ভরশীল এক আজব প্রাণি৷ এরা এমন এক প্রজন্মে পরিণত হলো যে বাদল দিনের এক ফোঁটা বৃষ্টির পানি, গ্রীস্মের রৌদ্রাত্তাপ কিংবা শীতের হিমেল বাতাশ এদেরকে অসুস্থ্য করে ফেলে৷ এরা প্রতিবাদ নয় পলায়ন করতে শিখেছে৷
অন্যদিকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী তাদের বংশ বিস্তার রোধ না করে বরং বহু বিবাহ, বাল্য বিবাহ আর সন্তান জন্মদানের কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে নির্বিকার৷ এদেরকে দোষারোপ করে লাভ নেই৷ কেননা এরা সমাজের সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী৷ ব্যতিক্রম ছাড়া বলা যায় বিজ্ঞানের জিনগত তথ্য অনুসারে এ সমাজের নিকট থেকেও সে ধরণের প্রজন্ম পাওয়ার পথ হয়ে গেলো উম্মুক্ত৷ তাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই গ্যাদার সন্তানেরা আরো অসংখ্য গ্যাদা হয়ে ছড়িয়ে পড়লো সমাজে-দেশে৷ শ্রেণি বৈষম্য দৃশ্যমান হলো প্রকটভাবে৷ কিন্ত একটা জায়গায় তারা সুবিধাভোগী নাগরিক সমাজের সমতূল্য৷ সেটি হলো ভোট৷ নির্বাচন৷ সকলের ভোটের মূল্য সমান৷ যদিও ষোড়শ শতকে জে.এস মিল একটা থিউরি দিয়েছিলেন যে, “নাগরিকদের একাধিক ভোট দেয়ার ক্ষমতার কথা৷” কিন্ত তা ধোপে টেকেনি৷ ফলশ্রুতিতে নাগরিক সমাজ আর গ্যাদা একই ক্ষমতার অধিকারী রয়ে গেল৷ করবার কিছু না থাকলেও সমাজ বুঝতে পারলো জন্ম নিয়ন্ত্রনের কূফল৷ এদিকে দেশের সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা ও রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য নির্বাচনের বিকল্প নেই৷ তাই নির্বাচন এলে সবচেয়ে বেশি আন্দোলিত করে এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে৷ পচে যাওয়া, দলছুট নেতৃত্বের ছদ্মবেশি, সাম্প্রদায়িক চেতনাবোধ আর মুখরোচক গল্পে এরা আকৃষ্ট হয় সহজেই৷ নতুবা কিছুটা নতুন স্বপ্নের মোহে ও তাৎক্ষণিক আর্থিক মুনাফায় নিজেদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে ফেলে সহজেই৷ চাই সেটা প্রাচ্যে কিংবা পাশ্চাত্যে৷ দৃশ্যপট প্রায় একই৷ তবে দুঃখজনকভাবে “দক্ষিণ এশিয়ায়” এর প্রভাব সবচেয়ে মারাত্মক৷ আর এজন্য এসব দেশে সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা প্রকট৷ এবং এই বিভাজনকে খুব সহজেই কাজে লাগায় মিষ্টভাষী পচে যাওয়া নেতৃত্ব৷ ফলশ্রুতিতে দেখা যায় গ্যাদাদের দ্বারা নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসে কিছু গ্যাদা৷ নির্বাচিত গ্যাদারাই ক্ষমতায় আরোহণ করে মনে করেন তিনি ব্যতিত সমাজের সকলেই গ্যাদা৷ তখন আর বিভাজিত হয় না কে নাগরিক সমাজ আর কেইবা প্রান্তিক জনগোষ্ঠী৷ সকলে মিলে মিশে একাকার৷ যেন সাম্যবাদী গ্যাদা সমাজ! তখন সম্মিলিতভাবে একটি গান প্যারোডি হিসেবে মনে করে৷ “আমরা সবাই গ্যাদা৷ আমাদেরই গ্যাদার রাজত্বে৷” এটাই বোধ হয় Beautiness of democracy.