কর্ণফুলির গল্প বলায় রবীন জাকারিয়া

ক্ষুধা

বাবা বিখ্যাত কেউ না থাকলেও একটা বিশেষ কাজের জন্য তাকে সবাই চেনে৷ বৃটিশ বেনিয়াদের কাছ থেকে যখন এদেশ স্বাধীন হলো৷ সেদিন নিজের দোকানের ছাদে বাবাই এ শহরে প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে৷ সেটা দেখতে কতো যে লোক এসেছিলো! স্যালুট দিয়েছিলো! এখনো অনেকে সে গল্প করে৷ ভালো লাগে৷

কোনো অসুখ-বিসুখ ছিলোনা৷ কিংবা খুব বয়স হয়েছে তা-ও নয়৷ হঠাৎ করে বাবা মারা গেলেন৷ পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি চলে যাওয়ায় আমরা অতল সাগরে পতিত হলাম৷

আমরা চার ভাই-বোন৷ দুই ভাই৷ দুই বোন৷ সবচেয়ে বড়বোনের বিয়ে হয়েছে৷ এখানেই থাকে৷ তবে ঘরজামাই বলা যায়না৷ শশুরের একখন্ড জমিতে নিজে বাড়ি বানিয়েছে৷ আয় রোজগার ভালো৷ উপরন্ত বাবার দোকানটা ভাড়ার নাম করে দখলে নিয়েছেন৷ এমন দুর্দিনে ভাড়াও দিচ্ছেন না আবার অন্যকে ভাড়া দিতেও দিচ্ছেননা৷ তাই আমাদের খোঁজ নেয় না৷ দূরত্ব রেখে চলে৷
আমাদের আত্মীয়-স্বজনরাও এখন এমুখো হয়না৷

বড় ভাই ইন্টারমিডিয়েটে পড়ে৷ সে এখন আমাদের এ “জীবন-সংসার” নামক জাহাজের একমাত্র সারেং৷ আমরা বুঝি সংসার চালাতে তার কী প্রাণান্তকর সংগ্রাম৷ কলেজপড়ুয়া এক মেধাবী ছাত্রকে আজ দিন হাজিরাসহ এমন কোন কাজ নেই করতে হচ্ছেনা৷ একদিকে নিজের লেখাপড়া৷ অন্যদিকে আমাদের পড়াশুনা ও সংসারের খরচ৷ পেরে উঠছেনা৷ তবুও অদ্ভুত প্রাণশক্তি তার৷ হার না মানার জেদ৷

প্রায়দিন আমাদেরকে দিনের বেলা উপোস করতে হয়৷ আমি এইটে আর আমার ছোটবোন সিক্সে পড়ে৷ সেই সকালে একমুঠো মুড়ি-চিড়া খেয়ে সারাদিন স্কুল শেষে খালি পেটে থাকা কী কষ্ট তা সবাই বুঝবেনা৷ আমার আর ছোটবোনের ক্ষুধা সহ্য হয়না৷ মাকে জ্বালাতন করি৷ খাবার দিতে বলি৷ এটা-ওটায় লাথি মেরে রাগ আর ক্ষুধার কষ্ট প্রকাশ করি৷ মা রাগ না করে বরং শুধু কাঁদে৷ বলতে থাকে তোরাতো শুধু নিজের কথা ভাবছিস অথচ তোদের বড়ভাই জাকির এই ঝড়-বৃষ্টি-রোদের ভেতর কী কষ্ট করে যাচ্ছে সংসারের জন্য! ও কি কিছু খেয়েছে কী-না সেটা কেন বলিসনারে তোরা৷ বলতে বলতেই কাঁদতে থাকে৷ জাকিররে কতো স্বপ্ন ছিলো তোর৷ পড়াশুনা শেষ করে মস্ত বড় চাকরি করবি তুই! আর এখন তুই লেবারি করছিস ব্যাটা! মা গীত গাওয়ার মতো সুর তুলে কাঁদে আর বলে আল্লাহ্ কেন আমাকে তুলে নিলোনা গো আল্লাহ্৷
মা’র কান্না শুনতে ভাল্লাগছেনা৷ ক্ষুধায় মেজাজ ঠিক নেই৷ এমন সময় আমাদের আদরের ছোট বোনটা এসে আমার হাত ধরে টানতে থাকে৷ ওকে সাথে নিয়ে গিয়ে বলি কী হয়েছে বলতো? ও নিজের পেটটাতে হাত দিয়ে ঘঁষতে ঘঁষতে বললো ছোটভাই খুব ক্ষুধা লেগেছে৷ আমাকে কিছু খেতে দাওনা! বলেই কান্না জুড়ে দিলো৷ ওর কান্না যেন আমার বুকের ভেতর তীরের মতো বিঁধছিলো৷ নিজেও কেঁদে ফেললাম অঝোরে৷ এটা কি শুধু বোনের ব্যথায় নাকি ক্ষুধার সেটা আজো রহস্যাবৃত৷ ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম চুপ কর৷ একটা ব্যবস্থা করছি৷ ওর হাত ধরে হাঁটছি আর ভাবছি কী করা যায়! এমন সময় মাথায় আইডিয়াটা এসে গেলো৷

আমাদের বাড়ি থেকে আধাঘন্টা পথ দূরে বড়খালার বাড়ি৷ ওনারা অনেক বড়লোক৷ খালাতো ভাই-বোনেরা সকলে উচ্চশিক্ষিত এবং প্রতিষ্ঠিত৷ এজন্য অবশ্য বড়খালা কম অহংকার করেননা! যার ফলে ওনারা আমাদের সাথে তেমন সম্পর্ক রাখেননি৷
ছোটবোনটা বুড়ির মতো পাকা পাকা কথা বলে আর সবাই ভালোবাসি তাই আমরা ওকে বুড়ি বলে ডাকি৷ আমি বললাম বুড়ি চল বড়খালার বাড়িতে যাই৷ ওখানে খেলতেও পারবো আর দুপুরে ভাত খেয়ে চলে আসবো৷ কেউ টেরই পাবেনা৷
দুপুর অবধি আমরা ক্ষুধার্ত দুই ভাই বোন খালার বাড়িতে থাকলাম৷ আঙ্গিনার অনেক গাছ৷ সেখানে কত পাখি! দু’একটা গাছে পাখির বাসা৷ বুড়ি পাখির ছানা চাচ্ছে৷ এ গাছ থেকে ও গাছে চড়ছি-নামছি৷ গাছের কোঁটরে হাত ঢুকে দেই৷ কিন্ত নাহ্৷ কোন ছানা পেলাম না৷ ভেতরে ভেতরে আনন্দ৷ কিছুক্ষণ পরেতো খালা খেতে দেবে৷ পেট ভরে খেয়ে বাড়ি যাবো৷ একটা প্রত্যাশা আর দারুণ ভালোলাগা যেনো ক্ষুধার কথাটাকে ভুলিয়ে রাখলো৷
ঠিক খাবারের সময় বড়খালা আমাদের ডাকলেন৷ বাঁধভাঙ্গা আনন্দে ছুটলাম৷ যে ডাকটার অপেক্ষায় এতো কসরত, এতো আয়োজন৷ বললাম কী বলবেন বলেন খালা? তিনি যা বললেন তার জন্য মোটেও প্রস্তত ছিলামনা৷ এমনকি কল্পনাও করিনি৷ খালা বললেন এখন খাবার সময় হয়েছে৷ খেলাধুলা বন্ধ করে বাড়ি চলে যাও৷
অনেক ছোট হলেও খালার কথাগুলো মনে দাগ কাঁটলো৷ প্রচন্ড ব্যথা পেলাম৷ তবে এবার আর আবেগপ্রবন হলাম না৷ বুড়ির হাতটা ধরে অনেকটা জোর করে টেনে আনলাম ঐ “মৃত্যুপুরী” থেকে৷ যেখানে আর কখনোই যাইনি আমি৷
আজ রোদের তীব্রতা বেশ৷ এটাকেই কি সানি ডে বলে? আচ্ছা সানি ডে’র বিশেষত্ব কী!
ক্ষুধা নিবারণের ছলে বেশি ছোটাছুটির কসরত দু’ভাই-বোনের ক্ষুধার জ্বালাকে করেছে আরো তীব্র৷ বুড়ি কাঁদতে থাকে৷ ওকে আশ্বস্ত করি৷ এখান থেকে আমাদের বাড়ির পথে একটা বড় কবরস্থান আছে৷ সেখানে অনেক ফুল-ফলের গাছ৷ বিশাল ফলগাছগুলোতে প্রচুর ফল ধরে৷ ওখানেই পড়ে যায়৷ পাখি ছাড়া ফল খাওয়ার লোক নেই৷ কবরস্থানের গাছের ফল কেউ খায়না৷ কী জানি ভয়ে নাকি ধর্মে নিষেধ আছে জানিনা! বুড়িকে রাস্তার একপাশে ছায়ায় বসিয়ে রেখে আমি একটা আতা গাছে উঠে পরলাম৷ বড় আর পাকা দেখে বেশ কিছু আতা নিয়ে বুড়িকে বললাম৷ খেয়ে নে বুড়ি! পেটভরে খা৷ মনে মনে বলতে থাকি কবরে শায়িত লোকের নয় জীবিত মানুষের জন্য খাবার প্রয়োজন৷ কেননা তাদের ক্ষুধা আছে৷
খাওয়া শেষ করে যখন দু’জনে বাড়ি ফিরলাম তখনো হাতে ছিলো কিছু আতা৷ হয়তো আর কারো ক্ষুধা মেটাবে৷

মেঘে মেঘে অনেক বেলা৷ কিংবা বলা যায় মিনিট, ঘন্টা, দিন, বছর পেড়িয়ে যায়৷ সময়ের সাথে সাথে মানুষ সার্ভাইভ করে৷ নতুন করে গড়ে তোলে জীবন৷ আর জীবনও থেমে থাকে না কখনো৷

বড়ভাই সরকারী চাকুরে থেকে অবসরে গেছেন৷ আর বুড়ি এবং ওর স্বামী দুজনে সরকারি চাকুরি করে৷ বাহিরে থাকে৷ আমরা হয়তো কেউই বড়খালার সন্তানদের মতো মস্ত বড় মানুষ হতে পারিনি৷ তবে এখন আর আমাদের ক্ষুধা নেই৷

এখন আমি প্রতিষ্ঠিত৷ রং শিল্পি৷ সকলে আর্টিস্ট বলে৷ শিল্পচর্চার জন্য কত যে পুরুষ্কার আর সম্মাননা পেয়েছি তার হিসেব নেই৷ এছাড়া বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মানী ভাতা পাই৷

কী অদ্ভুত জেনারেশন গ্যাপ৷ বাবা প্রচন্ড ভালোবাসায় পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করে খ্যাতি পেয়েছিল৷ অথচ ঠিক চব্বিশ বছর পরে তার সন্তানরা সেই পতাকা ছুড়ে ফেলে স্বাধীন বাংলার পতাকার জন্য জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেছে৷ এনেছে এক নতুন পতাকা৷ নতুন দেশ৷ আর সীমাহীন স্বপ্ন৷

আমি, আমার স্ত্রী আর আমাদের দুই সন্তান ও নাতি-নাতনী ছাড়াও আমার বাড়িতে এখন আরো একজন থাকে৷ মা মারা যাবার পর তাকে মায়ের মতো যত্ন করি৷ যেখানে শ্রদ্ধার চেয়ে করুণা কাজ করে বেশি৷

আমার বড়খালার তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত সন্তানরা সম্পদের মালিকানার পর কেউই তাকে নিজের কাছে না রেখে অবহেলা করতে থাকে৷ তখনতো বৃদ্ধাশ্রম বলে কিছু ছিলো না৷ খালার থাকার জায়গা নেই৷ খাবার নেই৷ বেশ কিছুদিন আশেপাশের বাড়িতে ভিক্ষুকের মতো খাবার চেয়ে খেয়েছে৷ এসব মানিয়ে নিতে না পারায় অসুস্থ্য হয়ে পড়েন৷ একদিন আটপৌঢ়ে কাপড় পরিহিত অসহায় আর মলীন চেহারার এক বৃদ্ধাকে বাড়ির গেটে দেখে জিজ্ঞেস করলাম কী চাই? তাঁর পরিচয় পেয়ে একবার মনে করেছিলাম দূর করে দেই৷ কিন্ত পরে ভাবলাম একজন অধম হবে বলে আমি উত্তম হবোনা কেন? সেই থেকে আজো তিনি এখানে আছেন৷ হয়তো থাকবেন আমৃত্যু!
একজন ক্ষুধার্তের মুখমন্ডল দেখতে কেমন হয়? আচ্ছা বহুদিন আগে ক্ষুধার্ত দুই ভাই-বোনের মুখচ্ছবি কেমন ছিল? জানতে ইচ্ছে করে৷
এখন ক্ষুধার জ্বালা নেই৷ তবে খাবার সময় বড়খালা যেভাবে চোখ বড় বড় করে এক মুঠো ভাত মুখে ঢুকিয়ে পরবর্তি মুঠোর জন্য তাকিয়ে থাকেন৷ সেই দৃশ্য দেখার ক্ষুধাটা হয়তো থেকে যাবে অনন্তকাল৷

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।