কর্ণফুলির গল্প বলায় রবীন জাকারিয়া

আজমত খলিফা

বহু বছর পর আজকে আমি আমার জন্মস্থান, প্রিয় শহর রংপুরে এলাম৷ নিজের শহর৷ নিজেই চিনতে পারছি না৷ চারিদিকে বহুতল বাড়ি, শপিং মল, প্রশস্ত রাস্তা, আলোর ঝলকানি চোখে ধন্ধে ধরায়৷ প্রিয় স্কুল, খেলার মাঠ, গাছ-গাছালি কিছুই নেই আগের মতো৷ যে পুকুরগুলোতে সারাদিন মহিষের মত ডুবে থাকতাম৷ সেগুলোতে এখন দাঁড়িয়ে আছে বহুতল ভবন৷ সহপাঠি-বন্ধু এখন তারা যে কোথায় কিংবা কেমন আছে৷ জানিনা৷ নিজের শহরেই নিজেকে আগন্তক মনে হচ্ছে৷
আমি ঢাকায় থাকি৷ বিয়ে-শাদী করেছি৷ পরিবার নিয়ে সেখানেই থাকি৷ একটা বস্তিতে৷ সিএনজি চালাই৷ স্ত্রী গার্মেন্টসে চাকুরি করে৷ করোনার কারণে সারাদেশে লক ডাউন চলছে৷ ঢাকায় খুবই কড়াকড়ি৷ ভ্রাম্যমান আদালত, পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট গাড়ি আটকায়৷ জরিমানা করে৷ লাঠিপেটা করে৷ চাঁদা আদায় করে৷ এতকিছুর পরেও লজ্জাহীনভাবে আমাদের রাস্তায় নামতে হয়৷ কেননা লজ্জা আর ভয় দিয়েতো পেট ভরবে না৷ আর আমাদের জীবণ-জীবিকা নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো সময় রাষ্ট্রযন্ত্রের নেই৷ তাদেরকে অনেক বড় বড় বিষয় নিয়ে ভাবতে হয়৷ কীভাবে রিজার্ভ বাড়াতে হবে৷ দেশীয় অর্থে কীভাবে পদ্মা সেতু হবে৷ কেন রাতারাতি একটা হাসপাতাল গায়েব হয়ে গেল ইত্যাদি৷
রোজার মাস৷ সামনে ঈদ৷ বাচ্চাদের আবদার৷ কীভাবে সংসার চলবে? তাই ঝুকি নিয়েই রংপুরে এসেছি৷ এখানে যাহোক একটা কাজ জোটাতে হবে৷ আমার ইচ্ছা অটো চালানো৷
আমাদের বাড়িটা সাতগাড়া মিস্ত্রিপাড়ায়৷ আগের বাড়ি আর নেই৷ ভেঙ্গে নতুন করে বানানো হয়েছে৷ ভাড়া দেয়া হয়েছে৷ ওটা এখন বোনের দখলে৷ আমি ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে কারমাইকেল কলেজে বাংলায় অনার্স ১ম বর্ষ পর্যন্ত পড়াশুনা করেছি৷ ছাত্র হিসেবে ভালই ছিলাম৷ কিন্ত বাবার হঠাৎ মৃত্যু, দারিদ্র্য আর পরিবারের প্রতি কর্তব্যের কারণে লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে ফেলতে হয়৷ মনে পড়ে বহুদিন আগে এক কাক ডাকা ভোরে সবার অগোচরে এ শহর ছেড়ে পাড়ি জমাই ঢাকায়৷ যে কোন উপায়েই রোজগার করতে হবে৷ বাড়িতে মা-বোনের জন্য টাকা পাঠাতে হবে৷ নাহলে ওরা না খেয়ে মরবে৷ ঢাকায় গিয়ে প্রথমের দিকে রিক্সা চালালাম৷ শহরটা কিছুটা পরিচিত হলে অটো চালানো শুরু করি৷ যা রংপুরে করা সম্ভব ছিলনা৷ আমার লজ্জার কারণে নয় বরং পরিবারের মর্যাদার কারণে৷ বিশেষ করে ছোট বোনের জন্য৷ আমি রিক্সাচালক জানলে ও যত ভাল স্টুডেন্টই হোক না কেন সুপাত্রস্থ করতে অসুবিধা হবে৷ মাসে মাসে নিয়মিত টাকা পাঠাই৷ সবাই জানে আমি চাকরি করি৷ কিন্ত সম্ভবত মা কিছুটা আঁচ করেছিল৷ হাজারো হোক মায়ের মন৷ আমি এড়িয়ে গেছি৷ বুঝতে দেইনি৷
দিনে দিনে অনেক বছর পেড়িয়ে গেছে৷ বোনের বিয়ে হয়েছে৷ স্বামী-সংসার নিয়ে ভাল আছে৷ মা এখন শুধুই স্মৃতি৷ মুনসিপাড়া কবরস্থানে স্বামীর কবরের পাশেই শুয়ে আছে৷
কী আশ্চর্য! একদিন লজ্জার ভয়ে শুধুমাত্র রোজগারের কারণে যে আমি নিজের শহর থেকে ঢাকায় পালিয়ে গিয়েছিলাম৷ বহু বছর পর সেই আমি আবার নিজের শহরে ছুটে এসেছি রোজগারের আশায়৷ পার্থক্য শুধু প্রথমবার ছিল মা-বোনের জন্য৷ আর এবার এসেছি স্ত্রী-সন্তানদের জন্য৷ তবে একটা বিষয়ে নিশ্চিন্ত যে এখন কেউ আমাকে চিনবে না৷
গাবতলী থেকে অনেক সময় আর অনেক কষ্টে অবশেষে রংপুরে পৌঁছালাম৷ টার্মিনালে নেমে রিক্সা করে মিস্ত্রিপাড়ায় ঢুকলাম৷ রিক্সাটাকে দাঁড় করালাম৷ নিজের জন্মস্থান, বাড়িটাকে দেখলাম৷ আশে পাশের বরই, পেয়ারা, আম, জাম আর আতা ফলের গাছগুলোর চিহ্নই খুঁজে পেলাম না৷ কত স্মৃতি, কত আনন্দ বেদনার সাক্ষি এ জায়গা৷ চোখটা ঝাপসা হয়ে এলো৷ অনুভব করলাম দু’চোখে নোনা জলের অস্তিত্ব৷ বুকের ভেতর বাতাসের ঘাটতি অনুভব করছি৷ বড্ড বেশী ব্যাথা করছে৷ নাহ্! সরে পড়তে হবে৷ রিক্সায় আবারো চেপে বসলাম৷ কবরস্থানে গিয়ে মা-বাবার চিহ্নহীন কবর জিয়ারত করলাম৷
রাত জাগা৷ দীর্ঘ সময় ধরে জার্ণি৷ নাস্তা না খাওয়া শরীরটাকে মাতালের মত টেনে নিয়ে চলছি৷ আমি হেঁটে চলছি৷ গন্তব্য কাচারী বাজার৷ সেখানে অনেক হোটেল৷ নাস্তাটা সেখানেই সারবো৷ সেখানে ছিল আর এক বিশ্ময়! যেন এক যাদুবলে এখানকার ব্যাঙের ছাতার মতো অসংখ্য হোটেল উধাও হয়ে গেছে৷ কিছুই নেই৷ শুধু ইতিহাসের সাক্ষি হয়ে এখনো রয়ে গেছে শিশু নিকেতন স্কুলটি৷ এখানেই আমি প্রাইমারী শিক্ষা নিয়েছি৷ যদিও স্কুলটা থাকলেও পুরাতন আঙ্গিকে নয় বরং নতুন ভবন শোভা পাচ্ছে৷ স্কুলটার ঠিক বিপরীত দিকে কোর্ট ভবন৷ রেজিস্ট্রি অফিস৷ তখনো নতুন জেলাগুলো হয়নি৷ সকল মহকুমার মানুষকে এখানে আসতে হতো৷ মামলা-মোকাদ্দমা৷ জমি রেজিস্ট্রি৷ আরো কত কি৷ কাচারী থাকতো মানুষের সমুদ্রের মতো৷ কোর্টের চারিদিকে কোন প্রাচীর ছিল না৷ বরং অসংখ্য দোকান দিয়ে পরিবেষ্ঠিত ছিল৷ খাবার হোটেল৷ থাকার হোটেল৷ স্ট্যাম্প ভেন্ডার৷ সাইকেল গ্যারেজ৷ লন্ড্রি৷ দর্জ্জি৷ আরো কত যে দোকান৷ ল্যাম্প পোস্টের নীচে ছিল একটা লন্ড্রি৷ নাম উকিলের লন্ড্রি৷ উকিলের লন্ড্রি নাম শুনে অনেকে মনে করতো এটা বোধ হয় কোন উকিলের দোকান৷ আসলে তা নয়৷ এখানকার বেশীরভাগ কাস্টমার ছিল উকিল৷ তাই এর নাম হয়ে যায় উকিলের লন্ড্রি৷ তার পাশে ছিল একটা সাইকেল মেকানিকের দোকান৷ আর ঠিক তার পাশের দোকানটা ছিল একটা দর্জ্জির৷ খলিফার৷ নাম আজমত খলিফা৷ নাম করা খলিফা৷ বয়স্ক, ধার্মিক আর বিশ্বস্থ ব্যক্তি৷ উনি কাপড়ের টুকরো অংশগুলো একটা কার্টুনে রেখে দিতেন৷ নামাজি লোকেরা মুঠো মুঠো করে ওগুলো নিয়ে যেতেন৷ কুলুক হিসেবে ব্যবহার করতেন৷ তখনো টিস্যু পেপারের ব্যবহার শুরু হয়নি৷ সে সময় তৈরি পোষাকের প্রচলন ছিল না৷ তাই খলিফাদের আয় রোজগার দিয়ে জোড়াতালি দিয়ে সংসার চালানো যেত৷ আজমত খলিফার দু’টি সন্তান৷ বড়টি ছেলে ও ছোটটি মেয়ে৷ দু’জনেই পড়াশুনায় খুব ভাল৷ শুধুমাত্র এ পেশা দিয়েই সংসারের খরচসহ আজমত খলিফা সন্তানদের উচ্চ শিক্ষার খরচ চালাতে থাকেন৷
সেসময় লোকে ঈদ পরবেই পোষাক-আষাক বানাতেন৷ এত বাহুল্য পোষাক মানুষের ছিল না৷ আজমত খলিফা জানতেন৷ এই সামান্য আয়ে তিনি বাচ্চাদের নতুন পোষাক বানিয়ে দিতে পারবেন না৷ তাই তিনি পূর্ব থেকেই প্রস্ততি রাখতেন৷ অন্যের জামা বানানোর পর তুলনামূলক যে বড় ছাটগুলো বেচে যেত৷ সেগুলো তিনি জমা করে রেখে দিতেন৷ একটা সময় যখন অনেক টুকরো কাপড় জমে যেত৷ তখন তিনি সেগুলো জোড়া দিয়ে নিজের করা ডিজাইনে সন্তানদের ঈদের পোষাক বানিয়ে দিতেন৷ সেই নতুন জামা নিয়ে বাচ্চারা যে কতবার দেখে৷ আবার গুছিয়ে লুকিয়ে রাখে৷ যেন বন্ধুরা ঈদের আগে দেখতে না পারে৷ আগে দেখলেতো ঈদ মাটি হয়ে যাবে৷ আজমত খলিফা আর তার স্ত্রী দেখেন৷ ওদের হাসিমুখ দেখে আনন্দের অশ্রু মোছেন৷ এ প্রতারণা কেউ বুঝতেই পেত না৷ শুধু তিনি আর তার স্ত্রী ছাড়া৷ এছাড়া কী-ইবা করার আছে?
এরপর দেশে নতুন নতুন জেলা হলো৷ শহরে মানুষের আগমন কমতে লাগলো৷ তৈরি পোষাকের ব্যবহার বাড়তে লাগলো৷ কমতে থাকলো খলিফাদের আয়৷ নিদারুন অর্থ কষ্ট, সন্তানদের লেখাপড়া, পরিবারের ভবিষ্যৎ এসব চিন্তায় এক রাতে নিজের দোকানের সেলাই মেশিনের উপরেই মরে গেলেন তিনি৷
কাচারীতে একটি হোটেলে নাস্তা খেতে খেতে অনেককে আজমত খলিফার কথা জিজ্ঞেস করলাম৷ কেউ বলতে পারে না৷ শেষে বয়স্ক দেখে একজনকে প্রশ্ন করলাম চাচা এ বিষয়ে কিছু জানেন কী-না! তিনি বললেন৷ আর বলো না বাবা৷ খুব ভাল মানুষ ছিলেন৷ আর ভাল মানুষ ছিলেন বলেই দু’টি সন্তানকে মানুষের মত মানুষ বানাতে পেরেছেন৷ একটু থেমে তিনি আবার বলতে লাগলেন তুমি শুনে আশ্চর্য হবে যে এ ব্যবসা করেই সে তার মেয়েকে ডাক্তার বানিয়েছেন৷ আর ছেলেটি ঢাকায় মস্ত বড় চাকুরি করে৷ কী কপাল! তাই না?
চাচার কথাগুলো শুনে বুকটা কেঁপে উঠলো৷ বুক চাপা কান্না নিজেকে পরাভূত করে বেড়িয়ে আসতে চাচ্ছে৷ শক্ত হতে হবে৷ অন্যদিকে মুখটা ঘুরিয়ে নেই৷ গালে গরম কিছুর অস্তিত্ব অনুভব করি৷ হাত দিয়ে গোপনে অশ্রুজল মুছে ফেলি৷ হয়তো আমার আচরণে অস্বাভাবিকতা ছিল৷ তাই চাচা বললেন তুমি কি অসুস্থ বোধ করছো? আমি বললাম না চাচা৷ সারারাত জার্ণি করেছিতো তাই খারাপ লাগছে! কিন্ত একথা বলার সাহস হলো না যে আমিই আজমত খলিফার সেই ছেলে!

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।