বইমাত্রিক রাহুল গাঙ্গুলি

বাংলাকবিতায় চেতনাধারার নতুন আন্দোলন পদ্যপত্র : শ্রুতি। ১টি চূড়ান্ত ডকুমেন্টেশন্)

পত্রিকা : পদ্যপত্র (বিশেষ সংখ্যা ‘শ্রুতি’, ২০১৪)
সম্পাদক : অর্পণ পাল
প্রচ্ছদ : অবনী জানা, গৌরব নাগ রায়
অলংকরণ : গৌরব নাগ রায়

রবীন্দ্রভাষ্য পরবর্তী জীবনানন্দ ও সমান্তরাল কল্লোলযুগ পার হয়ে, পঞ্চাশের বাংলাকবিতা’র বেশিরভাগটাই যখোন ইউরোপিয়ান রোমান্টিকতা’র ওমজ্বরে পুরোপুরি নিমজ্জিতো ~ ষাটের দশকে পরপর তিনটি সাহিত্য আন্দোলন ঘটে : হাংরি; শ্রুতি এবং ধ্বংসকালীন (আগে শুরু হওয়ার ক্রমানুসারে)।এই আন্দোলনগুলির ভিতর, বর্তমানে, অনেকেই নিজেকে স্বঘোষিত হাংরি বা ক্ষুধার্ত আন্দোলনের তৃতীয় প্রজন্ম না বললেও লেখালিখি’র পর্যায়ে থাকেন; সেখানে তখোন বাকি দুটি আন্দোলন বিস্মৃতপ্রায়।আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ হলো ~ এই তিনটি আন্দোলনই শুরু হয়েছিলো ম্যানিফেস্টো বা ইশতেহার্ প্রকাশের মধ্য দিয়ে।এমনকি হাংরি আন্দোলন নিয়েও গুগুল উইকিপিডিয়া’তে যতোটুকু তথ্য পাওয়া যায়; এর ১০% তথ্যও শ্রুতি নিয়ে নেই।ধ্বংসকালীন আন্দোলনকারীদের অবশ্য নামগুলি পাওয়া যায় সৌভাগ্যক্রমে।যেকোনো আন্দোলনের শুরুটাই হয় সময়ের দাবি’র নিরিখে; যার মূল উদ্দেশ্য থাকে পুরনো কাঠামোর পরিবর্তন।পুরনো কাঠামো ~ অর্থাৎ, পুরনো চিন্তাভাবনা / পুরনো লেখনভাষ্য / পুরনো মানসিকতা / পুরনো প্রকাশ / পুরনো যাপন / পুরনো লালনপালন / ইত্যাদি।যদিও, নতুন ধারার অভিমুখ সৃষ্টি হলে সময়ের দাবিটি সেভাবে থাকে না।তবে প্রবাহটি থাকা উচিৎ; দুর্ভাগ্যবশত বাংলা-কবিতায় এই প্রবাহটিকে পরবর্তী প্রজন্মের গড় মানসিকতা উপেক্ষা করে বা বলা ভালো অচর্চিতো হয়ে ভূল বিশ্লেষণে পতিতো হয়; যে কারনেই গুরুত্বপূর্ণ অতীত কখনোকখনো বিস্মৃতপ্রায় হয়ে যায়।আবার, নতুন চর্চায় নতুন কোনো নাম ও অভিমুখে’র উদ্দেশ্যে নতুন কোনো নাম নিয়ে কোনোকোনো আন্দোলন নতুন করে দানা বাঁধে।কিন্তু চর্চাটি যদি ধারাবাহিক থাকে, বাঁক বদলের অভিমুখটিও ধারাবাহিক থাকে এবং পাঠক বিচ্ছিন্নতা’র যে দূরত্ব-কথা শোনা যায় ~ সম্ভবতো সেই বিভেদটিও অনেকাংশে কমতে পারে।
যাইহোক, হাংরি ধারার আন্দোলনের মূল জায়গাটি যেখানে “যেকোনো জাগতিক ঘটনার প্রকাশকে, অস্তিত্বের নেপথ্যে থাকা পঞ্চইন্দ্রিয় দ্বারা চেতনার সংযোগরেখা দিয়ে উপলব্ধি” এভাবে করা হয়েছে (অর্থাৎ, আগে ইন্দ্রিয় তারপর চেতনা বা ইন্দ্রিয় ব্যতীত চেতনার জায়গা নেই); অপরপক্ষে শ্রুতি ছিলো “যেকোনো জাগতিক ঘটনাকে চেতনার কেন্দ্রাতিগো অঞ্চলের মধ্য দিয়ে উপলব্ধি করা এবং তার প্রকাশ; এখানে ইন্দ্রিয়ের নিজস্ব উপলব্ধি নেই, পঞ্চেন্দ্রিয় স্রেফ একটি মাধ্যম যা চেতনা দ্বারা নিয়ন্ত্রিতো” (অর্থাৎ, আগে চেতনা পরে ইন্দ্রিয়)।
যদিও ষাটের দশকে এই দুই আন্দোলন ছিলো পরস্পর বিরোধী, মূলতঃ যার কারন ছিলো হাংরিধারার যৌনতাকেন্দ্রিক শিল্প; তবুও আজ ২০২০তে দাঁড়িয়ে (যখোন যৌনতাভিত্তিক্ বিভিন্ন ট্যাবু বা সংষ্কার ধীরেধীরে ভেঙে যাচ্ছে), এই দুই ধারার বিরোধীতায় না গিয়ে : মনে হয় ~ ভিন্ন একটি তৃতীয় ধারার সন্ধান পাওয়া যেতে পারে প্রকৃত চর্চায়।(এটি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগতো মত, যা নিয়ে আলোচনা চলতেই পারে।) হাংরি’রা যেখানে যাপনপ্রসূতো শব্দ এবং যাপন তীব্রতা; এই দুই বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছিলেন || সেখানে শ্রুতি’র কবিরা অনেকটাই ছিলেন প্রশান্ত মহাসাগরের মতো শান্ত ও গভীর।শ্রুতি’র কবিরা চেয়েছিলেন শব্দের আবহমান কাঠামোকে ভাঙচুর করে, তার অভ্যন্তরীণ গতিশক্তি দ্বারা ধ্বনি এবং ধ্বনিকল্পনার ইমেজ্ বা দৃশ্য মাধ্যমে নতুনধারা গড়তে (চিত্রকল্প শুধু শব্দার্থ দিয়ে নয় ~ শব্দার্থ ভেঙে তার অভ্যন্তরীণ ধ্বনি ও অবয়ব : উভয়ের যৌথ মিথোষ্ক্রিয়া)।এই দুই ধারার কবিদের কাছেই, ‘সময়’ বিষয়টির যাপনলব্ধ আত্তীকরণ ছিলো ভিন্ন।হয়তো অনেকেই এতোক্ষন পড়ার পর, প্রশ্ন করবেন ~ একটি পত্রিকা নিয়ে লিখতে গিয়ে অর্ধেকের ওপর সাহিত্য-আন্দোলনের প্রসঙ্গ ক্যানো? উত্তর হিসেবে, এটাই রাখতে চাইবো : পত্রিকাটি পড়লে, আপনার / আপনাদের এই শুরুর লেখাগুলোই সবার আগে ভাবনায় আসবে।যে কারনে, বাংলা কবিতার শব্দার্থ কাঠামোর ভাঙচুর নিয়ে যাঁরা কাজ করতে চাইছেন ~ তাঁদের যতোটা কৌরব > নতুন কবিতা > সংহতো আন্দোলন নিয়ে পড়া উচিৎ, চর্যাপদ থেকে শ্রুতি বা পরবর্তী ‘ঈগল পত্রিকা’ : একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।আসুন এবার দ্যাখা যাক, পত্রিকাটির কিছু বিষয় : যাতে করে গুরুত্বপূর্ণ শ্রুতি আন্দোলন নিয়ে প্রয়োজনীয় গ্রহনযোগ্যতা তৈরি হতে পারে।

৩৪৪ পাতার পত্রিকাটি প্রধানতো দুটি ভাগে বিভক্ত।(১) শ্রুতি আন্দোলন নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী বিভিন্ন গবেষনাধর্মী গদ্য এবং ১৩টি শ্রুতি পত্রিকার উপস্থাপনা সহ বিভিন্ন ম্যানিফেস্টো বা ইস্তেহারগুলি এবং (২) শ্রুতি আন্দোলনের প্রধান চার কবি : পরেশ মন্ডল / পুষ্কর দাশগুপ্ত / সজল বন্দ্যোপাধ্যায় / মৃণাল বসুচৌধুরি ~ এনাদের বক্তব্য, কাজ এবং কবিতা ও কবিতাধারা নিয়ে, গুণীজনের লেখা বেশ কিছু বিশ্লেষণধর্মী গদ্য; চার কবির জন্য আলাদা আলাদাভাবে চারটি উপধারা।এছাড়া রয়েছে চার কবির সম্পূর্ণ জীবনীপঞ্জি এবং প্রকাশিতো কাব্যগ্রন্থের সম্পূর্ণ তালিকা।
গদ্যগুলি সম্পর্কিতো বলতে গিয়ে, এদের চারটি পর্যায়ে ভাগ করতে পারি : শ্রুতি আন্দোলন শুরুর প্রয়োজনীয়তা; এই কাব্যধারাকে অনুপ্রাণিতো করা বিদেশি কবি ও তাঁদের সাহিত্য বিষয়ক; অনুপ্রেরণার সাপেক্ষে এই চার কবির আত্মীয়করণ সম্বন্ধিতো বক্তব্য এবং শ্রুতি আন্দোলন থমকে যাওয়ার সম্ভাব্য কারন।যদিও পরবর্তী পর্যায়ে আন্দোলনের শেষের দিকে ~ অনন্ত দাশ, অশোক চট্টোপাধ্যায়, তপনলাল ধর, সুকুমার ঘোষ, রথীন ভৌমিক, রত্নেশ্বর হাজরা, এনাদের লেখা নিয়েও আলোচনা আছে।এছাড়া, কিছু কবিতা এবং সে কবিতায় চেতনাকেন্দ্রিক নতুন চিন্তাধারার কীভাবে প্রণয়ন ~ এ সম্পর্কিতো বিষয়টি নিয়েও গদ্য উল্লেখযোগ্য।গুরুত্বপূর্ণ : শ্রুতির কয়েকটি ভিন্নধারার কাজ; য্যামোন ~ যতিচিহ্ন সম্পূর্ণ রূপে বর্জন / টাইপোগ্রাফি এফেক্ট / শূন্যস্থান বা স্পেস ব্যবহার : বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা, এমনকি কিভাবে চিত্রশিল্প থেকে কবিতায় বিষয়গুলি এসেছে, সেসব নিয়ে গদ্য।যাঁরা ইউরোপীয় ঘরানার পাশাপাশি লাতিন আমেরিকার কংক্রিট পোয়েট্রি বা সাবয়ব / স্বাকৃত কবিতা নিয়ে খোঁজখবর রাখেন; বাংলা-কবিতায় সেইরকম একটা প্রবণতা অভিমুখী যাত্রার শুরু দেখে অতি অবশ্যই বিস্মিতো হবেন বলেই বিশ্বাস।ভারতীয় মূল্যে মাত্র ১০০ টাকায়, এই পত্রিকাটি নতুন কবিতাপর্বের চিন্তকদের কাছে, অবশ্যই বড়ো প্রাপ্তি।
এবার খুবই প্রাসঙ্গিকভাবেই, শ্রুতি আন্দোলনের কয়েকটি কথা তুলে ধরছি; যা এই পত্রিকাটিতে বিশদে রয়েছে :
” ১৯৬৫-১৯৭১ পর্যন্ত ছ-বছরের অস্তিত্বে মোট ১৪টি প্রকাশিত সংখ্যা এবং তিনটি ইস্তাহার পর্যালোচনা করলে কয়েকটি সাধারণ সূত্র চোখে আসে।
১.জৈব আর্তনাদ বা রাজনীতি প্রচারিত সমাজ চিন্তার স্থান যেখানেই হোক কবিতায় নয়।
২.কোনোরকম ব্যাখ্যা, বিধান বা তত্ত্ব প্রচারের দায়িত্ব কবিতার নয়।
৩.ব্যক্তির কল্পনাময় আন্তরিক অভিজ্ঞতা বা উপলব্ধিই কবিতা।তাই কবিতা হবে ব্যক্তিগত মগ্ন ও একান্তই অন্তর্মুখী।
৪.কবিতা একমুখী বিবৃতি বা বক্তব্য নয়, বরং বহু অনুভবের মিলনে জটিল উপলব্ধির আবহ।
৫.বিবৃতিধর্মী জীর্ণতা নয়, উপযুক্ত প্রকাশরীতি খুঁজে রচয়িতার ব্যক্তিত্বের রহস্যময় পরিমণ্ডল যাতে দৃশ্য-শব্দ-স্বাদ-স্পর্শের ব্যাখ্যাতীত সমন্বয়।
৬.চরিত্রের স্থবিরতার চেয়ে ব্যক্তিত্বের পরিবর্তনশীলতাই লক্ষ্য।
৭.প্রথার শাসন ও সংস্কার ভেঙে তৈরি করতে হবে প্রচলমুক্ত বাক‍রীতি।
৮.ইতিপূর্বের সমস্ত শিল্পতাত্ত্বিক মতবাদই মূল্যহীন।
৯. কবিতা চিৎকার নয়, নিবিষ্ট উচ্চারণ।কবিতা কারিগরি নির্মাণ নয়, শিল্পসৃষ্টি।কবিতা বক্তৃতা বা প্রচার নয়, নিবিড় অভিজ্ঞতা।কবিতা বুদ্ধির চমক নয়, ব্যাকুল সন্ন‍্যাস।
১০.কবিতা হয়ে ওঠা ছাড়া কবিতার আর কোনো চেষ্টা বা উদ্দেশ্য নেই।বাণী, বিধান বা নীতি প্রচারের দায়িত্ব কবিতার নয়।
১১.রচনা পদ্ধতি বা রচনার বিষয় আলাদা ব্যাপার নয়।ব্যক্তিগত জগৎ সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন ব্যক্তিগত উচ্চারণ রীতি।
১২.নতুন ধরনের মুদ্রণবিন্যাসের সাহায্যে কবিতার দৃষ্টিগ্ৰাহ্য অনুষঙ্গ সৃষ্টি।
১৩.ছেদচিহ্নের বিলোপ।প্রয়োজনমত স্পেস ও পংক্তিবিন্যাসের মাধ্যমে কোথায় থেমে পড়তে হবে তার নির্দেশ। কবিতার ভাষায় মুখের কথার স্বাভাবিক ব্যঞ্জনাসৃষ্টি।
১৪.শব্দের গুরুত্ব অনুসারে অন্য শব্দের সঙ্গে জুড়ে বা স্পেস বেশি দিয়ে আলাদা করে দেখানো, বিশেষ কোনো শব্দ থেকে আলাদা করে হরফকে দেখানো , কখনও শব্দের প্রতিটি বর্ণকে স্পেসের সাহায্যে বিচ্ছিন্ন করে গানের লয়ের মতো উচ্চারণবৈশিষ্ট্য তৈরি করা।
১৫.ব্যাকরণের বিরোধিতা।ব্যাকরণের যুক্তিনির্ভরতা বর্জন।শব্দকে পদ হিসেবে না ভেবে একক গুরুত্বে ব্যবহার।সংযোজক অব্যয়, ক্রিয়া বিশেষণ, বিশেষণ ইত্যাদি ভারসৃষ্টিকারী শব্দকে পরিহার করা।
১৬.প্রচলিত ছন্দকে বর্জন করে বা ভেঙে কবিতার ভাষায় ব্যক্তিগত উচ্চারণের স্বতন্ত্র ছন্দ-স্পন্দন সৃষ্টি।”
কিছু মুদ্রণ প্রমাদ এবং শুরুর দিকে কয়েকটি মুদ্রিতো পাতার বিন্যাসে সমস্যা থাকলেও; গোটা পত্রিকাটি বাংলা কবিতা পাঠচর্চার ক্ষেত্রে, নিঃসন্দেহে এক অপরিসীম ভূমিকা রাখে।এমনকি এটা বলাও ভূল হবে না ~ পদ্যপত্র পত্রিকার এই বিশেষ সংখ্যা ‘শ্রুতি’, বাংলা কবিতা গবেষণায় এক সুবিশাল গুপ্তধন।
(বর্তমানে শ্রুতি আন্দোলনের প্রধান চার কবির মধ্যে বেঁচে আছেন সুদূর গ্রীস নিবাসী পুষ্কর দাশগুপ্ত এবং পশ্চিমবঙ্গ নিবাসী পরেশ মন্ডল এবং মৃণাল বসু চৌধুরী)
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।