বইমাত্রিক রাহুল গাঙ্গুলি

দেহগুচ্ছ : পরিতোষ হালদার
(আত্মমগ্নতায় নিমজ্জিত চূড়ান্ত রতিক্রিয়া)

 

শুরু থেকেই, মানুষ এবং প্রকৃতির মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক।আর এরই ভিতস্বরূপ, মানুষ বারবার চেয়েছে প্রকৃতিসত্ত্বার ব্রহ্মাণ্ডকে জানতে / বুঝতে / শিখতে।স্থাপন করতে চেয়েছে যোগাযোগব্যবস্থা।প্রকাশ করতে চেয়েছে, ব্রহ্মাণ্ডে ঘটে চলা প্রতিনিয়ত দৃশ্য / অদৃশ্য, তাঁর অনুভূতি সাপেক্ষে।বিষয়টি য্যানো তাঁর, আত্মোপলব্ধির চূড়ান্ত চেতনাকে জানার সাধন-চর্চার স্তর।আসলে, এই অন্তর্বর্তী যোগাযোগের কথাবার্তা বলার আগে, যদি একটু আদিতে ফিরে যাই : তাহলে যা পাওয়া যায়, তা হলো প্রাণস্পন্দন সৃষ্টিরহস্যের পেছনে রয়েছে ~ ৫টি মৌলিক উপাদান : মাটি, জল, বায়ু, আগুন এবং অন্তরীক্ষ (পঞ্চভূত, যা বিভিন্ন নামে বিভিন্ন সংষ্কৃতিতে পাওয়া যায়।পরবর্তীকালে, একে একটু আধূনীকভাবে বলা হলো : কঠিন, তরল, গ্যাসীয়, প্লাজমা (পদার্থের ৪টি দশা)।অবশ্য, এর বিরোধীতা ফলিত বিজ্ঞান করে এসেছে বারবার (ফলিত বিজ্ঞান কথাটি একারণেই বললাম : বিজ্ঞানের চোখে যা দেখতে পাওয়া যায়, সরাসরি যুক্তিতে ব্যাখ্যা করা যায়)।যদিও, ভবিষ্যৎ আসন্নকে ফলিতবিজ্ঞান দেখতে পাওয়ার আগেই, বিজ্ঞানের যুক্তিউৎস দর্শনের ভিতরে ~ তার ভাবী বীজ নিহিতো।আবার, শরীরকে যদি আমরা ১টি স্বতন্ত্র ব্রহ্মাণ্ড ধরে নিই : চেতনাউৎস রূপে ধরে নেওয়াই যায়, ৫টি ইন্দ্রিয়ের তত্ত্ব।আবার ফলস্বরূপ, চেতনার কোনো ১টি সার্বিক স্তরে ষড়রিপু পেরিয়ে, ভিন্ন কোনো অঞ্চল।অর্থাৎ, অতি সহজ ভাষায় : ৫টি ইন্দ্রিয়ের ১ বা একাধিক ইন্দ্রিয়কে মাধ্যম করেই, স্নায়ু-সিগনাল্ সিস্টেম কাজ করছে / তার কিছুটা প্রতিফলন, প্রকাশিত হচ্ছে অনুভূতিরূপে।এর কিছুটা সংশ্লেষ : সৃষ্টি করছে উপলব্ধির অনুনাদ।

:
প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক ~ এতোগুলো কথা বলার প্রয়োজনীয়তা কি সত্যিই ছিলো।উত্তরে বলবো, অবশ্যই ছিলো।কেনো ছিলো না।যখোন, পাঠের ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা একথাই জানায় যে : যেকোনো পাঠের মৌলিক সংশ্লেষ, দশা / অবস্থান / শর্ত নির্ভর।অর্থাৎ, একেকবারের পাঠে যেহেতু একেকরকম উৎস-অভিমুখ উঠে আসে, সেহেতু লেখাটির আত্মানুসন্ধানের মুখোমুখি দাঁড়াতেই হয়।অর্থাৎ, তার অন্তর্বর্তী আত্মিক স্তর অতিক্রম না করতে পারলে, তা একরকম সীমাবদ্ধতাই।এছাড়াও, এটি তো আর ১ম-বারেই সম্ভব হয় না।বিকশিত হওয়াটা তো যথেষ্ট ধীরগতির।
:
ঘোড়াউত্রা প্রকাশনীর তরুণ সম্পাদক (দেশলাই পত্রিকা) এবং প্রচ্ছদশিল্পী ও চিত্রশিল্পী সুমন দীপ, বাংলাদেশ অমর ২১শে বইমেলা, ২০২০তে যে দেড়ফর্মা বইগুলোর সিরিজ বার করেছিলো, যার প্রতিটিই ভিন্নরকম আবহাওয়ার স্বতন্ত্রতায় স্ব-বিস্তৃত।তেমনই সেই সিরিজের অন্তর্গত একটি বই “দেহগুচ্ছ”।বইটির প্রচ্ছদদৃশ্য-সজ্জা করেছেন সুমন দীপ নিজেই।যেখানে, অক্ষরচরিত্রের সঙ্গে সমান্তরালভাবে প্রচ্ছদটি নিয়ে ২/৪-লাইন লেখাটা জরুরী।আপাত পর্যবেক্ষণে, প্রচ্ছদটি দ্বিমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখলে : দেখা যাবে, ১টি শরীর হাঁটু মুড়ে বসার ভঙ্গিমায়, যার কাঁধে ১টি ওজনভর্তি ব্যাগ্।আবার, এই প্রচ্ছদটিকেই যদি ত্রিমাত্রিক ভাবে দেখা যায় : দেখা যাবে, ১টি শুয়ে থাকা অনুভূমিক শরীরের ওপর বসে আছে, আরেকটি উলম্ব শরীর।শুয়ে থাকা শরীরটি উভমুখী এবং সে ধরে আছে উলম্ব শরীরটি।এখোন, এই ধারন্ মনস্কতা থেকে পাঠক পৌঁছাতে চাইবেন সেই বিমূর্তকে ছুঁয়ে ফেলতে, তাঁর স্ব-শরীরকে মাধ্যম করে।আর এই বিমূর্ততাকে, মূর্ততায় রূপান্তরকরণে পরিণত হবার ইঙ্গিত মেলে, কবির চর্চিত উৎসর্গ-কথনে।সেখানে তিনি লিখেছেন “দেহের সমান হয়ে গেছে প্রাণ”।এই কথাটির বিশ্লেষণ পর্বে, পাঠককে কয়েক মুহূর্ত ভাবতেই হবে : বিমূর্ত ও মূর্তের ধারনাটির নতুন চর্চায়।কারন, তার প্রয়োজন পড়ে মোট ২১টি কবিতার সংশ্লেষণে গড়ে ওঠা বইটির প্রাক-কথনে, যা চূড়ান্ত আত্ম-বিশ্লেষনের অনুলিপি।যেখানে কবি তাঁর চিন্তাকে প্রকাশ করেছেন এইভাবে “যেদিন নিজেকে আমি বলতে শিখি; সেদিন থেকে বুঝি, দেহই আমি।তারপর কতভাবে ডেকে, কত দ্বন্দ্ব ও সন্দেহে হয়ে গেছি মিত।অথচ, অমিত সম্ভাবনা তার-ভেতরে সংখ্যার শূন্যতা, রূপের পাতায় পাতায় ইন্দ্রমিতি।” এখানে, পাঠক য্যানো ভ্রাম্যমাণ পথিক এবং প্রয়োজনানুসারে কবির লিপিকৃতো চিন্তা তাঁর পথপ্রদর্শক
:
শুরু করলেই ‘সঙ্কর্ষণ’ কবিতাটি ~ তরল / অপ্সরা / শরীর / ঋতুবিষয়ক অঙ্কসমগ্র / বুকে কৌমুদী / বিবাহও একজন ঈভ : ১টি শরীরধাঁচের মাধ্যমকে অবলম্বন করে “জিহ্বার তলে যেকোনো স্বাদই ব্রহ্মাণ্ড।” এরকমই এগিয়ে যেতেযেতে, বহুকেন্দ্রিক্ ভর বৈচিত্র্যের দ্যোতনাময় ‘অস্মি’ কবিতায় : “চারিদিকে উড়াল-অঙ্গিরা; তোমার দশ আঙুলে বিরামহীন মুদ্রা নাচে।” বা “একটা পাতালঘরে একজোড়া দুজন; তারা শরীর শরীর, একে অপরের জেব্রাপাখি।” বা ‘ত্রাসপাখি’ কবিতায় “রোদ্দুরলজেন্স” শব্দটি নির্মিত হয় “অবশেষে কোনো এক চিত্রকরের কাছে থমকে দাঁড়ায় কিছু মুন্ডুমান নৃ।” এভাবেই ‘অঙ্গারপাতা’ কবিতাটিতে “মনে করো-দেহ থেকে আসি, আবার আমিই দেহ হয়ে যাই।আরও কিছু প্রাণের ভেতর-শিশিরে-সঙ্কটে জেগে ওঠে শীত।” বা ‘গ্রাফিতি’ কবিতাটিতে “রুরুচরিত” প্রয়োগ।শুধু শব্দার্থ কেন্দ্রিক্ নয়, প্রচলিত বাক্যগঠন রীতি পেরিয়ে, নতুনত্বকে নির্দেশ : পাঠক ভাববেন নিশ্চিত।
আরো একটু এগোলে, আরেকটি ভিন্ন পর্যায় শুরু হয় কবিতা : ‘শমকোণ’ / ‘সংখ্যা’ / ‘ঘোড়া’ / ‘তীর’ : এই ৪টি কবিতায়।কারন, এগুলিতে ~ কখনোও বিমূর্ত থেকে মূর্ত, কখনোবা মূর্ত থেকে বিমূর্ত রূপান্তরকরণের নির্মিত কোনো জ্যামিতিতত্ত্বের সন্ধান পাবেন পাঠক।য্যামোন ‘ঘোড়া’ কবিতায় : “১৮০ ডিগ্রী এঙ্গেলে দৌড়াতে গিয়ে যদি সে বেঁকে যায়, তাহলে শতাব্দীর তিন রেখার সমষ্টি দুই সমরেখায় চলে আসে।” এভাবেই বহু-অভিমুখিনী কবির এই চেতনা-নির্দেশিত পথ, যা স্তরের পর স্তর পেরিয়ে ~ একসময় স্নায়ুতন্ত্রকে রতিক্রিয়ার আত্মমগ্নতায় প্রবলতরো করে তোলে।যখোন, বইটির শেষ কবিতাটির সংশ্লেষ ঘটে নিউরোনের প্রতিটা কোষে।’তৈজস’ শিরোনামাঙ্কিতো শেষ কবিতা প্রকাশিত হচ্ছে এইভাবে : “কী করে যাবে, দেহভর্তি তুমি… হেমন্তে ওত পাতা একটি পাথর।” বা “পাখির সংখ্যা আঁকো, প্রতিডানা থেকে ফুটুক আহ্নিক । সাদারা বেড়াতে এলে পেন্সিলস্কেচ হবে তোমার ভণিতা ।” এই পর্যায়ে কিছুটা থেমে , পাঠকের পাঠ-সাধনচর্চা খানিক হলেও ~ গোচরের আড়ালে থাকা ব্রহ্মাণ্ডের বিমূর্তগুলোকে ছোঁবার প্রচেষ্টা করতেই পারে।তবে, তা সত্ত্বেও কিছু অপ্রাপ্তি থেকেই যায় : যাকে, দুর্বলতা শব্দটিতে আখ্যায়িত না করে, প্রত্যাশা শব্দটির প্রতি মননিবেশ করতে অতি উৎসাহ বোধ করবো।আর তা এই জন্যেই যে, যাঁর চিন্তাশক্তি, অনুভূতি-বোধকে এরকমফের লিপিকথনে প্রকাশিত করতে পারেন ~ তাঁর কাছে শব্দার্থ নির্ভর মাধ্যম ছাড়াও, অন্য কোনো মাধ্যমের সাথে আমাদের পরিচিতো করার দাবি জানানোই যেতে পারে।যখোন, এই ২০২০ পর্বে দাঁড়িয়ে সাংঘাতিকভাবে নতুনভাষার খোঁজ চালাচ্ছে প্রযুক্তি, যা তাকে প্রকৃতির আরো নিকটস্থ করতে পারে ~ সেরকমই পর্বে দাঁড়িয়ে, অভ্যস্ত মাধ্যমের সাহায্যে তুলনায় সহজতরো যোগাযোগব্যবস্থা কি কবিতার আভ্যন্তরীণ ব্যাপ্তিকে কিছুটা হলেও সীমাবদ্ধ করে রাখছে না? এই প্রশ্ন কোনো অহেতুক বিতর্ক তোলার উদ্দেশ্যে নয়, বরং পাঠকের চিন্তাভ্যাসের অনুশীলনকে মাথায় রেখেই, রাখা যাক।শেষ করার আগে, আরো ১টি কথা বলা প্রয়োজনীয় : সাধারনতঃ, শরীরভিত্তিক কোনো আবেদন পর্ব চোখে পড়লেই, ট্যাগলাইন ঝোলানো হয় ~ তা হাংরি বা স্যাড্ জেনারেশন্ গোত্রের।বর্তমান বইটিতে লিপিবদ্ধ কবিতাগুলোকে কিন্তু এরকম কোনো দ্যর্থকের সামনে রাখা যাবে না।কারন, পাঠ এখানে সাধনচর্চার সাথে মিলেমিশে ব্রহ্মাণ্ডের অসীমতাকে অনুভব করার পথ নির্দেশিকা।যদিও, এই প্রক্রিয়াটিতে কেউকেউ উত্তীর্ণ নাও হতে পারেন।পরিশেষ করবো এভাবেই যে, পাঠক ভিন্নতার স্বাদে আস্বাদিতো হউন।আর, পাঠ করার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে, মাত্র ৩টি রচিতো লাইন ~ কবির চিন্তাবোধকে, ভালোবাসা সহো
:
:
(চো_) >< (_খ)
বি।প।রী।ত
আকাশ {জা|ন|লা|হী|ন} মহাকাশ ধূ//ধূ
আলোচনা-রূপ : রাহুল গাঙ্গুলী
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।