গদ্যের পোডিয়ামে রাহুল ঘোষ

ফেরার পথ এখনও অনেক বাকি
ফেরার পথটা অসম্ভব কঠিন ছিল। প্রায় অগম্য বলা যায়। তবুও গন্তব্য নিয়ে কোনো সংশয় ছিল না। যাত্রা জারি ছিল তাই। যদিও অন্ধকারের আসলে কোনো বানান হয় না; তবু অন্ধকারের কথা লিখতে-লিখতেই কেটেছে অসহনীয় সব প্রহর। এমনকি আলোর দরজা খুলে গেল যখন, তখনও চারপাশে অন্ধকার! সময়ের কাঁটাঝোপ থেকে উপহার পাওয়া অজস্র ক্ষত নিয়ে, আমি ওই আলোতে ফিরলাম। যদিও আমার আলো মাঝেমাঝে নিজেকে আমার অন্ধকার বলে থাকে! কোনো এক আগমনী-সন্ধ্যা থেকে আমি তার হাতে তুলে দেওয়ার জন্য নিয়ে এসেছি ভালোলাগা গানের মুখরা। গলে-পড়া হলুদ আলোর ঝলকে দেখে নিয়েছি বহুদিন সরে-থাকা নদীটিকে। দেবীবরণের কোনো এক দুপুর থেকে, আমি তাকে মৃন্ময়ী বলে জানি। আমার মধ্যে তখন প্রবল হচ্ছে দীর্ঘদিন জমে থাকা একটা ডাক। কে জানে, কী করে ভুলে গেলাম, একদিন ওই নামে ডেকে-ডেকে নিজের অজান্তেই টেনে এনেছি যাবতীয় বিরহগাথা!
এই ফেরা আমাকে সবটুকু উপশম দিতে পারে। তবুও এই ফেরা শুধুই উপশম পাবো বলে নয়। আমাকে অনেক ক্ষতের নিরাময় এনে দিতে হবে, একথা একবারও ভুলিনি। মৃন্ময়ীর চোখে আমি তার যতটা আকণ্ঠ প্রেমিক, ততটাই নির্মম আততায়ী! হয়তো যে-কোনো সময়ে তাকে রক্তাক্ত করতে পারি অক্ষরনির্মিত নতুন আঘাতে! তবুও কেন আমার জন্য আবার আলোর দরজা খুলে দিল সে? একে শুধু নদীটির আকুলতা ভাবিনি। অথবা এ-প্রান্তে জেগে ছিল বিশুদ্ধ যে-অপেক্ষা, শুধু তার পরিণতিও নয়! কেন-না, আমি তো কবেই জেনেছি, এই ফেরা নিয়তির তাড়নায়; অথবা প্রকৃতির নির্দেশে। অথবা যা-কিছু ভাষার উর্ধ্বে। যা-কিছু রয়ে গেছে এই চরাচরে, চিরকালীন অনুভবের দলিলে। যা-কিছু প্রত্যক্ষ করেছি ঘুমঘোরে; অথবা অচিন রাস্তার মোড়ে, ফিরে দেখা দেবীর দেউলে। হয়তো তাই খুব সহজেই আবার উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে নদী। প্লাবনের মতো ঢেউ আসে নিভৃত বিকেল ও মোহময়ী রাতের গভীরে। খুব চেনা শ্বাস নিয়ে নদী আসে, অস্তিত্বের খুব কাছে। মুহূর্তে মুছে যায় ব্যবধানের একুশ যোজন। বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া সময়ের কারুকাজ ভুলে যেতে ভালো লাগে তখন।
এরপরেও কিছু-কিছু প্রমাদকে আজীবন জবাবদিহি করে যেতে হয়। যতই অনিচ্ছাকৃত হোক, তার কালো যেন আর কিছুতেই যাবার নয়! যেহেতু তার গায়ে লেগে আছে চিরস্থায়ী প্রণয়কথন; তাই তার দায় থাকে সর্বাধিক। এখন আমি তাই সরিয়ে রাখতে চাইছি নিজস্ব ব্যথার চাদর। ভুলে যেতে চাইছি, কাছাকাছি হলে আমারও তো উজাড় করে দেওয়ার ছিল নিবিড়তম দুঃখশোক! মুছে ফেলতে চাইছি, বিরহপ্রসূত অক্ষরমালার নীল। তবুও কি কোনোদিন উড়িয়ে দেওয়া যাবে, ইতিউতি জমে থাকা এত অবিশ্বাসের মেঘ? সে-কথা এখনও অজানা! প্রাথমিক উচ্ছ্বাস কেটে যাওয়ার পরে, নদী এখন কিছুটা শান্ত। এখন নিজস্ব নিয়মে তার কলধ্বনি আসে। কথারা গাঢ়তর হয়। সবকিছু আগের মতোই। তবুও যেন কোথায় একটা ফারাক! কোথাও যেন কিছু একটা বদলে গেছে বেমালুম! এভাবেই জেনে ফেলি, শারীরিক ঘোলাজলে বিপর্যস্ত না-হলে, নদী আমার জন্য এখনও খুলে দিত না আলোর দরজা। নিজেকে স্তম্ভিত করে আরও জেনে ফেলি, এখন আমি তার দুঃস্বপ্নে আসি!
ভোরের সকল সুখস্বপ্নের মধ্যে কয়েকটি আমাদের এখনও সত্যি হয়নি। সেই নিয়মে ভোরের কিছু-কিছু দুঃস্বপ্নেরও তো সত্যি না-হওয়ার কথা! তবু এক অজানা বিষাদে গুম হয়ে থাকে দিন। এও একরকমের অসহনীয় সময়! ভূগোলকে অতিক্রম করে আবার পৌঁছে যেতে চাই নদীটির শারীরিক বর্ণমালার কাছাকাছি। সেকথা শুনেই, কোনো এক নতুন অঘটনের আশঙ্কায় কেঁপে ওঠে নদী। আবার যদি গতিপথ রুদ্ধ করতে বাধ্য হয় সে! কী করে বোঝানো যাবে তাকে, অঘটন বারবার ঘটে না! দেবীবরণের দুপুরে তো কোনো অঘটন ছিল না। পরবর্তী সব নিবিড় প্রহরেও না। বালুকাবেলার দিনগুলোও তো কত মসৃণ ছিল! এই ফেরা আসলেই নিয়তি-নির্ধারিত। আমার ইচ্ছেরা আমাকে নদীর সঙ্গে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায় বনদুর্গার সেই দেউলে। সেখানে দেবী সারাবছর পূজিতা হয়ে থাকেন। সেখানে তাঁর মৃন্ময়ীমূর্তির সামনে নদীটিকে আবার মৃন্ময়ী বলে ডাকবো। কাঙ্ক্ষিতা মানবী তো এভাবেই ঈশ্বরী হয়ে উঠেছিল একদিন! তার দুঃস্বপ্ন থেকে নিজের উত্তরণের আর কোনো উপায় এখনও আমার জানা নেই। যতদিন সেই উত্তরণ বাকি, ততদিন হয়তো আমার প্রকৃত ফেরার পথও অনেক বাকি!