বইমাত্রিক রাহুল গাঙ্গুলি

প্রোজেক্ট থার্ড জেন্ডার :
অনভ্যস্ত ১ফর্মা’য় সমান্তরাল বাংলাভাষ’র কবিতা

বই : প্রোজেক্ট থার্ড জেন্ডার
কবি : অমন দাস
প্রকাশনা : কচিপাতা, ২০২০ কলকাতা বইমেলা
প্রচ্ছদ : অর্পণ
বর্ণ সংস্থাপন : সৌমেন চট্টোপাধ্যায়

যেকোনো সভ্যতায়, দুটি সমচরিত্র বা একাধিক চরিত্র বিশিষ্ট স্তরের ভিতর যোগাযোগের প্রাথমিক এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটি হলো ভাষা-প্রযুক্তি।মানবসভ্যতা’ও এর বাইরে নয়।বিশ্বকবিতা’র ইতিহাস এবং ভাষা-প্রযুক্তি বিষয়টি নিয়ে কোনো একটি গদ্যপর্বে লিখেছিলাম “প্রযুক্তি এমন একটি ব্যবস্থা, যা দুটি বস্তুর ভিতরে নূন্যতমো উপলব্ধ সহজ উপায়ে ও দ্রুততমো যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম”।একটু কি কঠিন লাগলো? তবে আসুন, কথাটিকে একটু সহজ করে বোঝা যাক।উদাঃ-১ : ধরা যাক গুহামানুষের কথা।সে জানতো না ছবি আঁকার কথা / অক্ষর কল্পনা থেকে ভাষার লিখিতো রূপ।সে কেবল অপরের সাথে যোগাযোগব্যবস্থা স্থাপনের উদ্দেশ্যে, দৃশ্যকে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজনীয়তা থেকে শিখে নিয়েছিলো স্বরধ্বনির ব্যবহার।ব্যবহৃত হয়েছিলো ধ্বনিভিত্তিক সংকেত।কারন, সংকেত হলো স্বল্পকায় এবং দ্রুতগতির যোগাযোগ বা অবস্থান নিশ্চিত করার প্রামাণ্য ডকুমেন্টেশন।আবার বিভিন্ন ছন্দভিত্তিক ভাবে, সেই স্বরধ্বনির পুনরাবৃত্তি থেকে জন্ম নিলো সুর এবং শ্রুতি।কিন্তু শুধুমাত্র ধ্বনিভিত্তিক যোগাযোগব্যবস্থার সবচেয়ে বড়ো সীমাবদ্ধতা সম্ভবতো, যোগাযোগ করতে চাওয়া চরিত্রগুলির একই সময়কালে অবস্থান এবং নিগর্ত ধ্বনির শ্রুতিসীমানায় চরিত্রগুলির শর্তসাপেক্ষ থাকা।এখোন, এই সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে গিয়েই হোক / নিজ অস্তিত্বকে বহু ভীড়ে খুঁজে নেবার তাগিদ থেকেই হোক : প্রয়োজন হলো, দৃশ্যকে কিছু চিহ্ন আঁকার মাধ্যমে প্রকাশিত করার প্রয়োজনীয়তা।গভীর পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে খোঁজা হলো, কঠিন মাধ্যমের আধার বা চিত্রধারক (আধূনিকতায় যা ক্যানভাস্)।খুঁজে নেওয়া হলো, উপযোগী ও উপযুক্ত লেখনী ধারকশৈলী অনুযায়ী।তারপর বর্ণ / রঙ।পরবর্তী পর্যায়ে : অদৃশ্যকে দৃশ্যমান করে তোলার ইচ্ছে নিয়ে কাল্পনিকতার মিশেল সহযোগে ব্রহ্মাণ্ডের বিমূর্ত প্রকৃতির সাথে যোগাযোগ করার প্রথম সার্থক প্রচেষ্টা।”
এখানে ভাষা-প্রযুক্তি য্যামোন দুই বা ততোধিক ধারনকে সংযোজিতো করতে সক্ষম; ত্যামোনই ব্যবহারিক দিক্ থেকে আমরা দেখেছি : এই ভাষা-প্রযুক্তি হলো বিপরীত অংশগুলির প্রতি দখলদারি দেখানোর গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার।অর্থাৎ, মানবসভ্যতায় অন্য একটি সংষ্কৃতি / জমি / ব্যবহারিক জীবনকে দখল করা বা তার ওপর ক্ষমতাসীনের প্রভুত্ব খাটানো বা অপর অংশটিকে প্রভাবিতো হতে বাধ্য করা ~ এসবকিছুরই প্রাথমিক শর্ত হিসেবে আক্রমণের বিষয়বস্তুগুলির অন্যতমো ঔপনিবেশিক হাতিয়ার হলো ভাষা।আর এখানেই, এই ঔপনিবেশিক প্রভাব বিরোধীতায় বিশ্বসাহিত্যে একাধিক আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে এবং হচ্ছেও।বাংলাভাষা ও বাংলাভাষা মাধ্যমটি ব্যবহার করে লেখা কবিতা ও গদ্য অনুসন্ধান নিয়ে ঘটা আন্দোলনগুলিও এর বাইরে নয়।কারন, প্রাতিষ্ঠানিক মানসিকতার বিপরীতে রাখা সমান্তরাল চ্যালেঞ্জ।আজও যখোন ~ পাশ্চাত্যরীতিনুযায়ী ছবিধর্মীতার অর্থ-রোমান্টিকতা’র পেছনে অধিকাংশ স্তাবক-কবিই ছুটে বেড়ান; পোস্ট-কলোনিয়াল বা ঔপনিবেশিকতা পরবর্তী হ্যাংওভার কাটাতে এই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা বারংবার ঘটে বই কী।
এসব নিয়েই ~ বই “প্রোজেক্ট থার্ড জেন্ডার” যা, হান্টকে লিরিক অবলম্বনে অমন দাস প্রচেষ্টা করেছে সমান্তরাল বাংলাভাষা স্থাপনের।অহেতুক বা অবশ্যম্ভাবী শব্দার্থের পেছনে ছোটা নয় বরং নিরাকার শব্দটির উৎসে গিয়ে তার ধ্বনিময়তায় পৌঁছানো এবং সেই বাঙময়ী ধ্বনিকে তাড়া করে // নতুন ভাষা-দ্যোতনার প্রতিস্থাপন।আসুন একবার দেখে নিই ~ শুরুতে অমন কি বলছেন : “একটা কাঠামো চিরদিন কখনোই চলতে পারেনা তাকে দুমড়ে মুচড়ে দিতে হয়।এই কাজ না হলে পাঠকের কনভেনশনাল স্বাদ ঘুচবে না।কেননা এটাও সমানভাবে সত্যি যে পাঠক আলাদা কিছু পড়বে বলে আলাদা পড়েনা।বিরক্তিতে পড়ে একঘেয়েমিতে পড়ে।আমাদের দেশের স্কুল কলেজগুলোতে এখনো কবিতার নামকরণের সার্থকতা পড়ানো হয়।প্রতিষ্ঠান আমাদের প্রতিষ্ঠানের ধাঁচে গড়ে তুলেছে, তাদের ভাষায় ভাবতে শিখিয়েছে, লিখতে শিখিয়েছো।আমাদের কোনোদিনও ভাবতে শেখায়নি কবিতার প্রতিটা লাইন একটা করে লিরিক // ভারতীয় শিল্প সবসময় ন্যারেটিভ আর্টকে প্রোমোট করেছে, হাজার হাজার বছরের ভারতীয় ঐতিহ্য // আইসবর্গীয় শিল্পকর্ম কিংবা গল্প না বলে গল্প বলার কাজ, অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট ভারতীয় শিল্পচর্চার সাতপুরুষের আওতায় পড়ে নি”।বইটির বিষয়বস্তুতা নিয়ে সে আরো বলেছে “প্রোজেক্ট থার্ড জেন্ডার একটা প্রবণতা।শব্দকে জেন্ডারত্ব প্রদান করার প্রবণতা।বাংলায় এখনো শব্দের উভলিঙ্গত্তের ধারনা বা প্রয়োগ করা নি // প্রোজেক্ট থার্ড জেন্ডারে সেই কাজ করা হয়েছে।একটা অন্য বাংলা ভাষা তৈরি করা হয়েছে কিংবা বলা ভালো ভাষাকে পেরিয়ে যাওয়া হয়েছে।কলোনিয়াল হ্যাংওভার মুছে ফেলা হয়েছে // সবমিলিয়ে প্রোজেক্ট থার্ড জেন্ডারে দেখানো হয়েছে শব্দের আধিপত্য।শব্দের উৎসে গিয়ে বুৎপত্তির বিনির্মাণ।শব্দের উৎসতার কাঁচামালকে দুমড়িয়ে মুচড়িয়ে ভিন্ন প্রয়োগ।বাংলা ভাষায় সবচেয়ে কম চর্চিত ধ্বনিকল্পের কাজ।”

মোট কুড়িটি কবিতা এবং প্রতিটি চার লাইনের ~ শিরোনাম বাংলা বর্ণমালা’র একেকটি স্বরবর্ণ ও ব্যাঞ্জনবর্ণ দিয়ে (‘সাউন্ড ক’ থেকে ‘সাউন্ড ন’)।আসুন পাঠক, এবার কিছু কবিতাপাঠ করা যাক ~
আমরা প্রথমেই পাবো ‘সাউন্ড ক’ নামাঙ্কিতো কবিতা : “অচিন্ত্য জীজীবিষা আর ময়ুর তুমি কতকাল ফড়িং হয়ে ওড়নি। / আমরা ভিমুর ভিমুর, ও গন্ধর্ব তুমিও ফুল / ফুল। কত আমিও চ্যাঙ্গেল যে ব্র। / ফড়িং। তুমা কাতুকেত ২হাজার বিশা।”
দেখুন, এখানে বেশিরভাগ শব্দেরই শব্দার্থে রূপান্তরকরণের দায় নেই।অর্থাৎ, আমরা কোনো নিটোল অর্থপূর্ণ দৃশ্য তৈরি করতে পারবো না; যদিও এই ধ্বনি প্রকল্পনাকে ডিকোড করে একটা অনুনাদ-মাত্রা পেতে পারি।পেতে পারি আরেকটি ভাষা-প্রযুক্তির প্রয়োগগতো উৎসভিমুখ।কিভাবে? য্যামোন ফড়িং থেকে ‘ভিমুর ভিমুর’ একটা ডানা ঝাপটানো’র রিসোর্স। বা ‘চ্যাঙ্গেল যে ব্র’ ~ এখানে ট্রিগার পরবর্তী ধ্বনির প্রক্ষেপন, যা ফুলের গোপন চামড়া পেরিয়ে নিয়ে যায় সসীম থেকে অসীম। আবার, শেষ লাইনটিতে একটা অদৃশ্য অথচো খিলখিলিয়ে ওঠা গতি।
এরকমই ‘সাউন্ড ট’ কবিতাটি : “কিতাবো একটি অন্য বাংলা ভাষা। / ভাষা একটি কিত ও আব্, এই গুঢ় হসন্ত / বাঁধিনু বেড়ালে। ও ও বেড়ালে একটি ভাষা / কিতনা ভাষা তুসুন্ত আছে বেড়ালে।” ~ এখানে দেখুন ‘বেড়ালে’ শব্দার্থটি কিভাবে ‘গুঢ় হসন্ত’র প্রভাব অগ্রাহ্য করে অর্থ বিয়োগ করে বিমূর্ততা লাভ করেছে; আর এর গতিবৃদ্ধি করেছে ‘তুসুন্ত’।মেটাফরধর্মী নয়, কিন্তু একটা ভাষা-কাঠামো’র মিশে যাওয়া বিপ্রতীপ মাধ্যমে।
কবিতা ‘সাউন্ড ঢ’ : ” ২০০০বিশা নোটাপম তারিখ ধুয়ে এলো গা। / জল্লাদিত কোপ ও কুপা / কোপাল বিশাখারে।ছিন্নাল ধরা মুন্ডনে… / বিশাখার পৌত্রাদি আর পুত্রাদি / আজও ছিন্নাল হয়ে আছে কোপানে।” এরকমই সব অদ্ভুত অনুরণনে ধ্বনিকল্প তৈরি করে ছায়াচিত্র; সমান্তরাল মৌলিক প্রযুক্তিধারনা ও তার অনুশীলন ~ অনভ্যস্ত হলেও যেখানে খুঁজে পাওয়া যায় স্বতন্ত্রতা।
যদিও সমান্তরাল ভাষা-প্রযুক্তি, হাতেকলমে চর্চা করা হয়েছে প্রতিটি কবিতায়; তবু দুটি বিষয়ে দুর্বলতা রয়ে গ্যাছে বলে মনে হয়েছে ~ (১) ব্যাকরণ সূত্র নির্দেশিত বানান এবং (২) ব্যাকরণ সূত্র মেনে যতিচিহ্ন প্রয়োগ।যে বিষয়দ্বয় নিয়ে প্রতিটি সমান্তরাল কবিতাচর্চায় বিশ্বাসী যাঁরা, প্রত্যেককে সর্বদা ভাবতে অনুরোধ করে থাকি।এর কারন হিসেবে যেটা বলার তা হলো : শুরুটাই যদি নতুন হওয়ার থাকে, সেখানে পুরনো’র রেশ ক্যানো।ধ্বনি যদি উচ্চারণ থেকে হয়ে থাকে; সে তো তবে স্বতঃস্ফূর্ত / ব্যাকরণ নিয়ন্ত্রিত হবে ক্যানো?
৮০র দশক থেকে আমরা দেখেছি, কৌরব / কবিতা ক্যাম্পাস / নতুন কবিতা ~ বিভিন্ন লিরিকধর্মী কাজ; যেখানে ভাষা-প্রযুক্তির নানান্ ভিন্ন মাত্রায় প্রয়োগ ঘটেছে।সেখান থেকে, অমন দাসের এই কাজ পরবর্তী প্রজন্ম হিসেবে উপযুক্ত।বরং ভবিষ্যৎের প্রজন্ম হিসেবে এগিয়ে যাওয়ার স্বপক্ষেই।অতএব, পরিশেষে একথাই বলতে পারি ~ সমান্তরাল বাংলা ভাষায় আন্তর্জাতিক কাজ হিসেবে এই এক ফর্মার বইটি পাঠকের অবশ্য পাঠ্য।তবে বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ থাকবে এটাই : যে, কবিতাগুলি পাঠের পর, বেশ খানিকক্ষণ পাঠক নিজস্ব অস্তিত্ব ছেড়ে শব্দ-অনুরননে প্রভাবিতো থাকবেনই
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।