গদ্য বোলো না -তে রত্নদীপা দে ঘোষ

একায়, একার কবিতায়

অজস্র সুপ্রভাত দিলুম তোমায়

সূর্যের এক্কারথ, মেঘবৃষ্টি ঝিলিককের গজমোতি

কলরোল বোঝাই ঈশ্বরের দুকূলপনা

একমুঠো সংসারী আলমারি আর সন্ন্যাসী আয়না

লেখাটা শুরু হল ঠিক এইভাবে। লেখা কেন? এ তো এক প্রকার আঁকাই। নির্বাচিত প্রবন্ধে আঁকিবুঁকি ছটাকের কারিগরি। আজকের সকাল ঠিক এই স্বরেই শুরু। কর্ণাটকের প্রত্যন্ত গ্রামে বসে আছি সিঁড়ি পেতে। দূরমেঘ। দূরনদী। দূরপাহাড়। এইসব মহাদুরত্বের কাঁথাকানি জড়িয়ে একার এক্কায় স্নান করে, মিলিত আছি কবিতার সঙ্গমে এবং জ্যোৎস্নায়। সুপ্রভাতের সদ্যস্নান পরানো সাদাকোয়ার দোপাটি। জবাফুলের শ্যামদেশে ভরে ওঠে আমার গৃহ। কড়িবর্গা আমার হেঁসেলপনায় শুরু হয় দারুচিনি নদীর রোশনাই।

আমি ছাড়া আর কেউ নেই যেন এখানে। কবিগ্রন্থের প্রহার নেই। কবিতার ওয়ার্কশপ নেই। নেই পুরস্কার। নেই মাইকপ্রভু, নেই মঞ্চের হাতিয়ার। এই এতো কিছু নেই বলে কি কবিতা হবে না? আমার বাসররঙ্গে রাঙানো জবাবিপুলের হাতছানি কি আমাকে দেবেনা একাশি রকমের চাঁদপূর্ণ আভরণ?

অই যে শুনতে পারছি অদৃশ্য ভায়োলিন, বেজে আছে তুংগভদ্রার টুং টাং। আমি সেই শ্রুতিমধুর পরগণাকে জড়িয়েছি চোখে। অজস্র নিমের বাতাস। সাপলুডোহীন কণিকামাত্র জীবন আমার। মৃদু অপেরায় ঘোষিত রয়েছে রজতকান্তি হাতছানি, গাঁ-ঘরে হাতে তৈরি মাটির এস্রাজ। খোয়াবের অঙ্কনামাটি, আমার উড়োসন্ধ্যায় বুঁদ হয়ে আছে কবিতার রান্নাবাটি। বয়াম ভরা দেওয়ালির রোদ, বর্ষা-প্রাকারের ধ্রুবজ্যোতি, কবিতা রান্নায় আর কতই বা ধ্রুবতারা আর গেরিমাটি লাগে বলো তো …

ওঠানামা নেই। চুপচাপ কতগুলি শান্তির ফোয়ারা আছে। আছে ঝর্নার বিনুনিবাধা প্রকল্প। আমাকে এরাই বাজেয়াপ্ত করে তারপর নিয়ে যায় আধিদৈবিক দৈবপ্রহরে। আমাকে ভুলিয়ে দ্যায় হলদে রঙের ফাঁদ, প্রলোভনের সম্রাট। সবকিছুই ভুলিয়ে দ্যায়। আমি ভুলে যাই জীবন এক স্থির রন্ধনশালা, আমি উল্কার মত অশান্ত গতিতে ছুটে যাই, কবিতা না পেলে, দুলি জ্বরে। বড় প্রাকৃত আর উদ্ভাসিত এই সুদক্ষিণা থার্মোমিটার। কখনো বাড়ায় ধ্যানের পারদ, কখনো বা নিভিয়ে গরদের কুসুমশশী। পাটভাঙা আমি দুইমাত্রার অস্তাচলে এসে বসি।

পড়ন্ত সূর্যের সাথে প্রেম হয় আমার। তটরেখার অধীর পুরাণ ছাপিয়ে আমি ছিন্নভিন্ন হই, মনে হয় অজস্র কাকাতুয়া এসে আমার চোখে আদর পরিয়ে দিতেছে, সুফিটিয়ার দোলনায় বসে আছি আমি, স্বয়ং কবিতাই লিখে দিচ্ছে আমার গড়নের অনন্য এক এপিটাফ। ভয় করছে না এতটুকু। লজ্জাও নয়। পরসূর্যের মোমবাতিতে উঠছি জ্বলে, সীমন্তিনী পেখমের বৃতিতে নেচে উঠছে নগ্নবসনা সুখিনী কামিনী। এই মুহূর্ত বল্গাহীন, বস্ত্রহীন।

পৃথিবীর তাবৎ হরিণ দিয়েও এই অরণ্যকে শেকলে গাঁথা যায় না। এ যেন তরুণী প্রস্রবণ। পুরু হয়ে আছে অপেক্ষার লণ্ঠন। এই যে অজস্র দ্যুতির ফকিরি ব্যস্ত রেখেছে একতারার বীণাগুলি, এ কি কবিতা নয়? এ কি অলৌকিক আকাশ হতে ঝরে পরা সানাইবৃষ্টি নয়? আমি যে কবিতার সাথে বিবাহ সাধতে লেগেছি। বিয়েশিউলির উপাসনায় মেতে উঠেছে শব্দের কবুতরি। পুঁথিবেনাসরির পাড় দিয়েছি মুছে। শাঁখাপলার শিউরে ওঠা আহ্লাদিত শঙ্খবন। ধিরেধীরে কতকালের গিঁট খুলে বেরিয়ে এসেছে প্রবাসের তিলকআঁকা কলমের শিখিপাখা। বিস্তৃত গেরস্থের কনকাঞ্জলী। সেই মুহূর্তটি লাভ করেছে পুস্পনির্জন দেউলের অমরতা।

উজান হে, আলোকিত করো গায়েগতরে চিত্রিত চরম রাসউৎসব। প্রলয় করো প্রবল ফুল্কি। প্রণয় করো ডাকাতিয়া বাঁশিবেদন। আমি যে তার রসিতে বেঁধেছি, নিজেকে। পয়ারে গিয়েছি মূর্ছা। বর্ণমালা বোঝাই আমার কবিতার বরণডালাটি, তপস্যার তিথিকবচে রেখেছি লুকিয়ে।

কবিতা আমার কাছে কবিতা নয় শুধু। আলাপনের তাপস, আদিবাসী পলাশের তীব্র মূর্ছনা। কাঁধে পিঠে ঢেউ, গাঙরমণীর চেনা কেউ। আড়ালগাছের খিদে। বিন্দুবিন্দু অন্নপেয়ালা। অতীতের চেনা মর্মর, নিখিল শবাধারে জাগ্রত সুরাশ্লোক। আমার প্রতিবেশীদের মধ্যে এরা ছাড়া কবি নেই কোনো। আসলে কী জানো, আফিমনেশার বাইরেও এমন কোন চরম নেশারু আছে যে আমার হাতে কলম তুলে দিয়েছে, আমার কপালে এঁকে দিয়েছে কবিতার ঘোড়সওয়ার।

এমন দূর্বাদল এমন রাই শ্যাম রেখে আমি কোন কানুতরীতে নিজেকে ভাসাই, বলো!

কবিতা ছাড়া কোথায় যাবো? কবিতাকে ছাড়া কতদূরই বা যাওয়া যায়। দেউলিয়া হয়ে থাকি খুব ,কবিতাকে ছাড়া। কবিসংগ নেই, সংলাপ নেই। একমাত্র কবিতাই আছে আমার আঁখির আহ্লাদে, চোখের তরুমুলে। কান্নানৌকোটির সাথে, সামুদ্রিক সোহাগে। আমার জন্ম-জন্মান্তরের বাল্যবন্ধুটি, হাজার এক্কার পরেও, এখনো দোক্কার দুয়ারে। অক্ষর আর শব্দ আর বাক্যবন্ধের বন্ধনী জ্বেলে।

অনন্ত নর্তকীর নূপুর-সায়রে। উড়ালের সম্ভাবনা নিয়ে সে বসে আছে রাখালের চূড়ায়।

কবিতা হে, জেনে রাখো, যে সন্ধ্যায় নেই তুমি, সেই সন্ধ্যায় আমিও নেইমাত্র। গোপনগানের ফাঁক দিয়ে যে স্বপ্নমৌচাক সৃষ্টি হচ্ছে, যে সরবতের পিয়াসা ভেদ করে জেগে উঠছে দো-ফসলী মানুষের অশ্রু, যে ধান্যপথে রিনিঝিনি উড়ছে আকাঙ্ক্ষার চিরগোলোক, হামেশার লালকমলে দুলে উঠছে তোমার রঞ্জাবতীলোক।

কবিতা হে, তুমি আসমানের পুনরায়। বেলুনবিদ্যুতের আকাশে সুতীব্র মৌমাছি। স্ফটিক বৃত্তে অমৃত আমার একলা রাজত্ব, গড়ে দিতেছ মাইকমঞ্চপুরষ্কারহীন অমেয় পর্যটক।

দিগ্বিদিকের মুখ। তুরীয় ফকিরের রাজধানী।

 

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।