সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে রঞ্জন চক্রবর্তী (পর্ব – ৫)

উপন্যাসের বহুমাত্রিক রূপ

রোমান্স অল্পবিস্তর কাব্যধর্মী বলা যেতে পারে। ঊনবিংশ শতাব্দীর আমেরিকান ঔপন্যাসিক Nathaniel Hawthrone-এর অমর সৃষ্টি ‘The Scarlet Letter’(১৮৫০) শ্রেষ্ঠ রোমান্সের নিদর্শন। এই কালজয়ী রচনাটির কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল – প্রথমত সমগ্র রচনাটির পরিবেশে অতিপ্রাকৃতের শিহরণ জাগানো অনুভূতি ও রহস্যময়তা মিশে আছে, দ্বিতীয়ত কাব্যধর্মী চিত্রকল্পের ব্যবহার রচনার সাহিত্যমূল্য বাড়িয়েছে, তৃতীয়ত রচনার মধ্যে রহস্যগূঢ় ব্যঞ্জনা আছে, চতুর্থত চরিত্রগুলির প্রবৃত্তির সংঘাত পাঠকমনকে নাড়া দেয়, এবং পঞ্চমত প্রায়শ্চিত্তের যন্ত্রণা প্রতিফলিত হয়েছে।
বাংলা ভাষায় সর্বশ্রেষ্ঠ রোমান্স লেখার কৃতিত্বের দাবীদার বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর ‘কপালকুণ্ডলা’ ও ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ উপন্যসদুটির তুলনা করলে রোমান্স ও উপন্যাসের মূলগত পার্থক্য অনুধাবন করা যাবে। প্রথমটি রোমান্স ও উপন্যাসের মিশ্রণের ফলে সৃষ্ট সার্থক সাহিত্যরূপের একটি উজ্জ্বল নিদর্শন, কপালকুণ্ডলার চরিত্রের সঙ্গে তুলনা করা যায় এমন আর কোন চরিত্র বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আর দ্বিতীয়টি বাস্তবতার উপর ভিত্তি করে লেখা সার্থক সামাজিক উপন্যাস।
Edwin Muir আপেক্ষিক গুরুত্বকে মাপকাঠি ধরে উপন্যাসের যে পাঁচটি গঠনগত শ্রেণী নির্ধারণ করেছেন সেগুলি হল – কাজ বা ঘটনাপ্রধান, চরিত্রপ্রধান, নাট্যধর্মী, ইতিবৃত্তমূলক এবং কাল বা যুগপ্রধান (Edwin Muir : The Structure of the Novel)।আধুনিক কালে উপন্যাসের শ্রেণীবিভাজন বহুমাত্রিক হওয়ায় তার মধ্যে বৈচিত্র্যও বেশী। রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক, সামাজিক উপন্যাস যেমন আছে, পাশাপাশি সমাজতাত্বিকের দৃষ্চিভঙ্গীতে উপন্যাসের শ্রেণীবিভাজনও কম বৈচিত্র্যপূর্ণ নয়। এভাবে বিচার করলে আন্দোলন অবলম্বনে রচিত উপন্যাস, নাবিকের জীবন নিয়ে রচিত উপন্যাস, শিক্ষক বা চিকিৎসকের মত নানাবিধ চরিত্রকে নিয়ে লেখা উপন্যাস প্রভৃতি নানারকম শ্রেণীর উপন্যাসের কথা বলা যায়।
উপন্যাসের শ্রেণীবিভাজন অনেক ভাবেই করা যেতে পারে, তবে মনে রাখতে হবে এরকম শ্রেণী পরিচয় কখনই চূড়ান্ত নয়। একটি উপন্যাস লক্ষণবিচারে একাধিক শ্রেণীর অন্তভুক্ত হতে পারে। আসলে ঔপন্যাসিক নিজের অভিজ্ঞতাকেই রচনার মধ্যে রূপায়িত করেন। এই কারণে কয়েকটি উপাদান বা বৈশিষ্ট্যের উপর দাঁড়িয়ে উপন্যাসের স্বরূপ বিশ্লেষণ করা হলেও বিভিন্ন উপাদানগুলির পারস্পরিক সামঞ্জস্য ও সমন্বয়ের উপরই উপন্যাসের সার্থকতা নির্ভর করে। যাই হোক সামগ্রিকভাবে উপাদান ও লক্ষণ বিচারে উপন্যাসের প্রধান শ্রেণীগুলি হল – সামাজিক উপন্যাস (Social Novel), ঐতিহাসিক উপন্যাস (Historical Novel), মনস্তাত্বিক উপন্যাস (Psychological Novel), কাব্যধর্মী উপন্যাস (Poetic Novel), আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস (Autobiographicalal Novel), হাস্যরসাত্মক উপন্যাস (Humorous Novel), পত্র উপন্যাস (Epistolery Novel) ও আঞ্চলিক উপন্যাস (Regional Novel)। এছাড়া গোয়েন্দা ও অভিযান-রহস্য কাহিনীমূলক উপন্যাস (Detective Adventure Novel) অত্যন্ত জনপ্রিয়। বহুমাত্রিক বিভাজনের ভিত্তিতে এই শ্রেণীবিভাগের মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন শ্রেণীর উপন্যাসের লক্ষণ সম্বন্ধে কিছুটা ধারণা পাওয়া যাবে।
ভিক্টোরিয়ান যুগের ইংলণ্ডের মহিলা ঔপন্যাসিক Mrs Gaskell রচিত ‘Mary Burton’(১৮৪৮),‘North and South’ (১৮৫৫) এবং কিছুটা পূর্ববর্তীকালের রচনা Charles Kingsley-এর ‘Alton Locke’(১৮০০) সার্থক সামাজিক উপন্যাসের নিদর্শন। তবে সাহিত্যগুণের বিচারে Charles Dickens-এর‘Oliver Twist’(১৮৩৩), ‘Nicholas Nicolby’(১৮৩৩-৩৯), ‘Bleak House’(১৮৫২-৫৩), Hard Times (১৮৫৪)এবং ‘Little Dorrit’(১৮৫৫-৫৬) অনেক এগিয়ে থাকবে। Harriet Beecher Stowe রচিত‘Uncle Tom’s Cabin’(১৮৫২)একটি বিশ্ববিখ্যাত সামাজিক উপন্যাস।বাংলা ভাষায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ একটি সার্থক সামাজিক উপন্যাস।শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের‘অরক্ষণীয়া’ (১৯১৬), ‘পল্লীসমাজ’ (১৯১৬) ও ‘বামুনের মেয়ে’ (১৯২০) প্রভৃতিও জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এগুলির মধ্যে ‘পল্লীসমাজ’তাঁর শ্রেষ্ঠ সামাজিক উপন্যাস।
Sir Walter Scott রচিত ‘Waverly’ (১৮১৪), ‘Guy Mannering’ (১৮১৫), ‘Old Mortality’ (১৮১৭), ‘The Heart of Midlothian’ (১৮১৮), ‘Ivanhoe’ (১৮২০) প্রভৃতি রচনা যথার্থ ঐতিহাসিক উপন্যাস।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।