গল্পেরা জোনাকি -তে রীতা চক্রবর্তী

ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন

রাস্তায় মেয়েদের খুব ভিড়। শুধু মাথা অগুন্তি মাথা।কারো মুখ দেখাযাচ্ছেনা।কেবল পার্বত্যউপত্যকা দেখে চেনাযায় দলের সবাইমেয়ে। সবাই একসাথে বাতাসে ছুঁড়ে দিচ্ছে একটাই শ্লোগান, ” মেয়েরা যাবে বিয়ে করতে”, সবাই একসাথে বলে উঠছে “বিয়ে করতে, বিয়ে করতে”,
“বাড়ির কাজে বর আনতে”, আবার সবাই একসাথে বলছে,”বর আনতে, বর আনতে।”
দূর থেকে শুনে ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছিনা বলে আমিও ভিড়েরমধ্যে ঢুকেপড়লাম। খুব কাছেগিয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, “এটা কিসের মিছিল?”শান্ত অথচ দৃঢ় স্বরে বললেন,” মেয়েরা এখনথেকে ছেলের বাড়িতেযাবে বিয়েকরতে। আর বিয়েকরে একজন হোলটাইমার নিয়ে আসবে তার বাবারবাড়ির জন্য যাতে বাজার, দোকান, ডাক্তার, ওষুধ, বাচ্চাদের টিউশন নিয়ে যাওয়া – আসা, ঝি-চাকর-ড্রাইভার-মালির তত্ত্বাবধান করার একজন বিশ্বস্ত লোক তার বাবার বাড়িতে সবসময় থাকে। মেয়েরা চাকরী করলেওতো এইসব ঝক্কিগুলো মেয়েদেরই পোহাতেহয়। এবারতাই সরকারের কাছে আবেদন জানানো হচ্ছেযে ছেলেরা চাকরীকরুক বা নাকরুক এই কাজগুলো বিয়েরপর তাদেরই করতেহবে বৌয়ের বাড়িতে থেকে,এমন একটাআইন জরুরীভিত্তিতে আনাহোক। নাহলে মেয়েরা গর্ভধারণ করবেনা।এবং অবশ্যই এখনথেকে বিয়েকরে মেয়েরা আর শ্বশুরবাড়ি যাবেনা, যাবে ছেলেরা।”
মনেমনে ভেবেদেখলাম হ্যাঁ, ঠিক কথাই তো! বাড়ির সবকাজতো করে মেয়েরা।বাইরের কাজেও চাষের জমিতে মজুরের কাজকরে মেয়েরা। শহরের সাফাইকর্মী হিসেবে সকাল সকাল ঝাড়ুহাতে মেয়েদের দেখাযায়। রেলের”প্রসাধন”এর দরজার বাইরে মেয়েদের দেখাযায়।বাজারে মাছ ফল সবজি বিক্রিকরে মেয়েরা। আর আমি নেপাল বেড়াতেগিয়ে দেখেছি মধ্যরাতেপর্যন্ত দোকানদারী করছে মেয়েরা।
আজকালতো জল-স্থল-অন্তরীক্ষ সব জায়গায় মেয়েদের জয়জয়কার।
তবুও সংসারের সবদায়িত্ব কেনশুধু মেয়েদেরই বইতে হবে? কেন সববিষয়ের জবাবদিহি শুধু মেয়েদেরকেই করতে হবে? সত্যিইতো! এর একটা বিহিত হওয়া দরকার।
সকালে ঘুমভেঙ্গে উঠেথেকে রাতের শেষপাত পর্যন্ত সবার সবদায়িত্ব একটা মেয়েরউপর চাপিয়েদিয়ে একএকটা পরিবার কেমন পায়েরওপর পা’তুলে সময়কাটায়। আর কোনো বাবার আদরের ধন নয়নমনি একমাত্র মেয়ে অপরিচিত একটা লোককে বিয়েকরে তার বাড়িতে গিয়েথাকে। সেই পরিবারের সদস্যদের সবদায়িত্ব মাথায় তুলেনিয়ে নিজের নাওয়াখাওয়া ভুলে অন্যের সেবাকরে দিনকাটায় শুধু স্বামীকে ভালবেসে। সেইবাড়ির লোকজন তারপ্রতি কতটা সহানুভূতিশীল সেটা বোঝাযায় সময়মতো নির্দিষ্ট কাজটা নাহলে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখাযায় বাড়ির বৌয়েরসাথে ঝিয়ের থেকেও বাজেব্যবহার করাহয়। এর একটা প্রতিকার হওয়া অবশ্যই প্রয়োজন। যতদিন সবাই আরামকরে বসে ফরমাইশী খাবারখাবে ততদিন বুঝবেনা মেয়েদেরওযে কষ্ট হয়। ওই সব বাড়ির লোকজনদের প্রত্যেককে ওই জায়গায় বসালেই বুঝবে সংসারে মেয়েদের অবদান কতখানি। আজকের মিছিলের এই
বিষয়টা আমার খুব ভালো লেগেগেল। তাই আমিও জোরে সবারসাথে গলামেলাতে চেঁচিয়ে উঠলাম।কিন্তু আওয়াজ বেরহলোনা। এতজোরে ধাক্কা লাগছে কেন আমার? চোখটাও আটকে গেছে যেন! “এই ওঠ, ওঠ বলছি।”
মা জোরেধাক্কা মেরে বললেন, “সেইথেকে গোঁ গোঁ করেযাচ্ছিস, ওঠ, সন্ধ্যে হয়েগেল যে, উঠে পর।” আমি ঘেমেনেয়ে একসা’ হয়ে ভাঙাস্বপ্ন বুকে নিয়ে ফ্যালফ্যালকরে মাথারউপরে ঘুরতে থাকা ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।