সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে কৌশিক চক্রবর্ত্তী (পর্ব – ৩০)

কলকাতার ছড়া 

বেলগাছিয়া ভিলা। সেকালের উত্তর কলকাতার এক সাবেকি বনেদিয়ানার কেন্দ্রস্থল। শহর জুড়ে তখন মস্ত প্রতিপত্তি টেগোর অ্যান্ড কোম্পানির সর্বময় কর্তা প্রিন্স দ্বারকানাথের। শুধু এদেশের লোক নয়, বিলেত থেকে আসা সাহেব সুবোরাও বিশেষ মান্যিগন্যি করে তাঁকে। এমনকি সেই তালিকায় মহারাণী ভিক্টোরিয়ার নামও যুক্ত। তো অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য এহেন গণ্যমান্য মানুষের একখানা বাগানবাড়ি থাকবে না তা কিকরে হয়। আর সেই বাড়িটাই হল বেলগাছিয়া ভিলা। মস্ত তার আড়ম্বর। দ্বারকানাথেরও যেন দুই ভিন্ন সত্ত্বা। একদিকে নিষ্ঠাবান ব্যবসায়ী এবং অন্যদিকে বিলাসব্যসনে ডুবে থাকা এক শৌখিন ধনী ব্যক্তি। আর সেই বিলাস-ব্যসনের মূল কেন্দ্রবিন্দু হল বেলগাছিয়ার বিশাল রাজবাড়ি। সন্ধে হলেই কে আসে না সেখানে। বিলেত থেকে ভারতে আসবার পর বড়লাট স্বয়ং অকল্যান্ড সাহেবও এসে ঘুরে গেছেন দ্বারকানাথের এই বাড়িতে। দেশীয় মানুষের জীবনযাপনের সাথে পরিচিত হতে ইচ্ছুক অকল্যান্ড সাহেব (ইডেন সাহেব) এসেছিলেন বেলগাছিয়া ভিলায়। মিশতেন দ্বারকানাথ ও এদেশের ধনী ব্যক্তিদের সাথে। দেশীয় ব্যবসায়ীদের সাথে দৈনন্দিন দিনযাপন করা ইংরেজ সাহেবরা তাই কোনোদিনই প্রবেশ করে উঠতে পারেন নি সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের রোজকার দুঃখ কষ্টে। সরকার বাহাদুরের সাথে সাধারণ মানুষের এই মস্ত শূন্যস্থানটাই ধীরে ধীরে সমাজে তৈরি করে দীর্ঘ ফাটল, যার চিহ্ন হয়ত আজও স্পষ্ট এই দেশের আর্ত সামাজিক পরিবেশে।
এসবের মধ্যেই জোড়াসাঁকোর দ্বারকানাথ ঠাকুরের জীবনযাপন যেন সেযুগের কলকাতার এক আস্ত অধ্যায়। আর সেই দিনলিপির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জুড়ে আছে বেলগাছিয়া ভিলার নাম। ১৮২৩ সালে এক ইতালীয় সাহেবের থেকে দ্বারকানাথ কিনে নেন এই বাড়িটি। এরপর শুরু হয় বিলাস-ব্যসনের এক অন্য ইতিহাস। বাড়ির বাগানে যেমন দেখবার মতো ফুল ফুটতো, তেমনই বাড়ির অন্দরমহলে ছিল চোখে পড়বার মত শিল্পকাজ। পিটুনিয়া, গোলাপ, জিনিয়া ফুলের চাদরে মোড়া থাকতো বাগান। প্রাসাদের মাঝখানে মতিঝিল আর তার ওপরে ছোট্ট কাঠের সেতু। এইসব খণ্ডচিত্র মাথায় আনলেই বোঝা যায় ঠিক কেমন বৈচিত্র্যময় ছিল বেলগাছিয়া ভিলা। আর সন্ধে নামলে পালকি চড়ে দেশীয় ধনী থেকে প্রতিপত্তিশালী সাহেবদের আগমন হত এখানে। অতিথিদের খাওয়া দাওয়া ও রসনা তৃপ্তিতেও ছিল অসাধারণ বৈচিত্র্য। ভারতীয় খাবারের সাথে রাখা হত ইতালীয়, ফরাসী এবং বিলিতি পদ। এর সাথে কাবাব, পোলাওয়ের মত নবাবী পদ তো ছিলই।
বাইরে থেকে দেখেই ভেতরের পরিবেশটা আঁচ করতে পারতো সাধারণ মানুষ। স্বভাবতই ভিলার ভেতরের দৈনন্দিন জাঁকজমক হয়ে উঠেছিল কলকাতার মানুষের কাছে এক চর্চার বিষয়। মুখে মুখে ছড়িয়েও পড়লো ছড়া –

“বেলগাছিয়ার বাগানে হয় ছুরি কাঁটার ঝনঝনি,
খানা খাওয়ার কত মজা, আমরা তার কি জানি
জানেন ঠাকুর কোম্পানি।”

ঠাকুর কোম্পানির তখন অনেকরকম ব্যবসা। কে বলে বাঙালীর ব্যবসা হয় না? দেখিয়ে দিয়েছিলেন দ্বারকানাথ। জাহাজের ব্যবসা থেকে ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা, সবেতেই তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য। ইংরেজদের সাথে ব্যবসা তো অনেকেই করেছেন। কিন্তু ব্যবসা করে সাহেবদের সমকক্ষ হয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছিল কেবল দ্বারকানাথের পক্ষেই। ইংল্যন্ডে দ্বারকানাথের সাথে নৈশভোজের পরে স্বয়ং মহারাণী ভিক্টোরিয়া লিখেছিলেন –

“ব্রাহ্মণ ভদ্রলোক বেশ ভাল ইংরেজি বলেন এবং তিনি একজন বুদ্ধিমান ও চমৎকার মানুষ।”

স্বাভাবিক ভাবেই তাঁকে নিয়ে কলকাতার মানুষের মধ্যে ছিল এক বিশেষ কৌতুহল। আর সকলের কাছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল বেলগাছিয়া ভিলার অন্দরমহলের গল্প। পুরনো কলকাতার প্রতিপত্তি আর দ্বারকানাথ যেন কোন একটা জায়গায় সমার্থক। কিন্তু ১৮৪৬ সালে তাঁর অকালমৃত্যু অভিশাপ হয়ে ওঠে ঠাকুরবাড়ির কাছে। বাজারে প্রচুর দেনা শোধ করতে গিয়ে হাঁপিয়ে ওঠেন পুত্র দেবেন্দ্রনাথ। তখনই বিক্রি করতে হয় তাঁর সাধের বেলগাছিয়া ভিলা। ১৮৫৬ সালে মাত্র ৫৪ হাজার টাকায় কাঁদির জমিদার সিংহ পরিবের কিনে নেন এই বাড়ি। সেই থেকে একে রাজবাড়ি বলেও পরিচয় দেয়া হয়৷ কিন্তু তা বললে কী হবে। এর দেয়াল থেকে আজও ঝরে পড়েনি দ্বারকানাথের অধরা স্বপ্নগুলো৷ কারণ বেলগাছিয়া ভিলা সাজিয়ে তোলবার পরেও তৃপ্ত ছিলেন না তিনি। তাই গায়ে মকমলের জামা, গলায় রাণীর দেয়া সোনার পদক ঝুলিয়ে আজও হয়ত সাহেব সুবোদের সাথে প্রতিদিন নৈশভোজের সভায় প্রতিনিধিত্ব করেন টেগোর অ্যান্ড কোং এর সর্বময় কর্তা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।