গল্পেরা জোনাকি -তে রীতা চক্রবর্তী

হয়নি যেকথা বলা

মুখার্জিপাড়ার দুর্গামন্ডপ আজ আবার আলোয় আলোয় সেজেউঠতে শুরুকরেছে কোজাগরী লক্ষ্মীপূজোর সাজে। মেয়ে-বৌ-ছেলে-বুড়ো পাড়াশুদ্ধ সবাইমিলে তারই আয়োজনে লেগেপরেছে। পাড়ার কয়েকজন মহিলার সাথে দোলনও রয়েছে মন্ডপে আলপনা দেবার জন্য।দোলন এবছর মেডিক্যাল জয়েন্টে একশ’বারোতমস্থান অধিকারকরে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তিহয়েছে। পাড়ার ছেলেমেয়েদেরমধ্যে তাই এখন একটুবিশেষ হয়ে উঠেছে। যেখানে দোলন থাকে সেখানেই সবাই একটু বিশেষ আগ্রহ দেখায়। দুলাল সান্যালের ছোটমেয়ে দোলন ছোটবেলাথেকেই পূজামন্ডপের আলপনা দেবার দায়িত্ব পালন করে চলেছে। যখন ছোটছিল তখন থেকেই এই তল্লাটে যেখানেই ড্রয়িং কমপিটিশন হয়েছে সেখানেই দোলন ফার্স্ট হয়েছে।আঁকার হাত এতসুন্দর বলে মুখার্জি বাড়ির ঠাম্মা’র একান্ত আগ্রহে সেই ছোটবেলাথেকে এই এতবড় মন্ডপ দোলনের আলপনায় সেজে উঠছে। ধীরস্থির শান্ত শ্যামবর্ণা ব্রিলিয়ান্ট দোলনের ওপর তাই পাড়ার ছেলেদের একটু দুর্বলতা রয়েইগেছে।
মুখার্জিদের কর্তামা’ মানে পাড়ার ছোটদের সবার ঠাম্মা’ অরুন্ধতীদেবীর তদারকিতে চলছে আগামীকালের পূজোর আয়োজন আর মন্ডপসজ্জার কাজ।এই দুর্গামন্ডপ আসলে মুখার্জিদেরই বাড়ির। যখন প্রতাপ মুখার্জির জমিদারী ছিল তখন থেকেই এইমন্ডপ আর দুর্গাপূজা ছিল মুখার্জিবাড়ির। তারপর একটা সময়ে জমিদারী শেষ হয়েগেল কিন্তু মুখার্জিদের পূজোটা রয়েই গেল। প্রতাপ মুখার্জি বেঁচে থাকতেই তাঁর বাড়ির এইপূজো সার্বজনীন করেদিয়ে গেছেন। তারপরথেকে পাড়ার এই পূজোটা মেয়েবৌদের নিজস্বপূজো হয়েগেছে।
পাড়ার এই দুর্গাপূজার বিশাল আয়োজনও অরুন্ধতীদেবীর নির্দেশ মেনেই হয়। মেয়েরা মন্ডপের দায়িত্বে আর ছেলেরা চাঁদাতোলা, ঠাকুর আনা,পূজোর বাজার করা, ভোগের ব্যবস্থা করা, পূজোর চারটেদিন পাড়ার সবার দু’বেলা খাবারের ব্যবস্থাকরা সবকিছুই ছেলেদের দায়িত্ব। আসলে বছরে দুর্গাপূজোর এইকটাদিন মুখার্জিপাড়া একটা যৌথপরিবারের মত কাটায়।সকলে একসাথে থাকার আনন্দটা সবারসাথে ভাগকরে নেয়। আজ যারা লক্ষ্মীপূজোর কাজেরজন্য মন্ডপে এসেছেন তাদেরও রাতের খাবারের ব্যবস্থা করাহচ্ছে।
অরুন্ধতীদেবীর ছোটমেয়ের ছেলে জীম্বু মানে জীমূতবাহন ছোটবেলা থেকেই মহালয়া থেকে লক্ষ্মীপূজো পর্যন্ত দিদার কাছেই থাকে। এই কটাদিন মামাবাড়ির আদর আর পাড়ার সবারসাথে আনন্দকরে কাটাতে ওর খুব ভালোলাগে। এবাড়ির আদরের ছোটনাতি বলে পাড়ার সবাই একটু বিশেষ খাতিরও করে জীম্বুকে। জীম্বুও এইপাড়ার সবাইকে মামাবাড়ির আপনজনের মতই সম্মান করে।
দোলনের সাথে ওর খুবভাব। ছোটবেলা থেকেই একসাথে পূজোর এইকটাদিন কাছাকাছি পাশাপাশি কাটে ওদের।দুজনারই দুজনেরওপর একটা অদ্ভুত ভাললাগা আছে। যত ব্যস্ততাই থাকনা কেন দুজনের চোখ থাকে দুজনার ওপর। এবছর দুর্গাপূজার দশমীতে বিসর্জনের সময়ে দুজনে একসাথে মাদুর্গাকে প্রণাম করেছে। তারপরদিন সকালবেলাতেই মুখার্জিবাড়িতে গিয়ে ঠাম্মাকে প্রণাম করে এসেছে দোলন।
সেদিন ওবাড়িতে পাড়ার লোকজনের ভিড়ছিল দেখবার মত। যদিও দোলনের চোখ বিশেষ কাউকে খুঁজছিল কিন্তু সেটা ক্ষণিকের জন্য। ঠাম্মাকে প্রণাম করেই তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফিরে এসেছিল। জীম্বু সেদিন দোলনকে দেখেছিল দুরথেকে। ভেবেছিল ওকে দেখতে না পেয়ে দোলন হয়ত একটু অপেক্ষা করবে। কিন্তু তেমন কিছুই ঘটেনি। আর এই কদিন দোলনকে একটিবারের জন্যও দেখাযায়নি। আজও সবাই একসাথে আছে তবুও দুজনার একটা কথাও হয়নি এখনও পর্যন্ত।
মন্ডপের কাজ সেরে খাওয়া দাওয়া হতে অনেক রাত হয়ে গেছে। দোলন ঠাম্মাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, কাল কখন আসতে হবে? অরুন্ধতীদেবী আড়চোখে পাশে দাঁড়ানো জীম্বুকে একবার দেখে নিয়ে বললেন, “সে তুই বিকেলকরে এলেই হবে। আলপনা দেওয়াতো হয়েই গেছে। তোর দায়িত্ব শেষ।” সাথে সাথে জীম্বু বলে ওঠে, “শুধুতো বেদীতে আলপনা দেওয়া হয়েছে। এতবড় মন্ডপেতো আর কোথাও আলপনা দেওয়া হয়নি। অবশ্য সবারপক্ষে সেটা সম্ভবও নয়।” দোলন একটু রাগ দেখিয়ে বলে, “ঠাম্মাতো কখনও বলেনি যে বেদীছাড়া অন্যকোথাও আলপনা দিতেহবে। বললে নিশ্চয়ই দিয়ে দিতাম।” জীম্বু তখন দিদাকে বলে, “দেখোতো, এতবড় মন্ডপ কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। মাঝে যদি একটা বড়ো আলপনা থাকে তাহলে দেখতেতো ভালোলাগবে, তাই না।” অরুন্ধতীদেবী কিছু বলার আগেই দোলন বলেওঠে,” ঠিক আছে, কাল সকালে এসে আমি এই মাঝখানটাতে একটা আলপনা দিয়ে দেব। এখন আসছি।”
” ওকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আয় ” বলে অরুন্ধতীদেবী জীম্বুর দিকে ফিরে তাকান।” যাচ্ছি” বলে জীমূতবাহন দোলনের পেছন পেছন এগিয়ে যায়। মন্ডপ থেকে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে জীম্বু বলেওঠে, এই কদিন তুই আসিসনি কেন? দোলন একটু রাগ দেখিয়ে বলে ওঠে, তাতে তোর কি? সবার সাথে হৈ হৈ করা, আড্ডা মারার সময় থাকলেও কালো মেয়ের জন্যতো সবার সময় থাকেনা।”
—–বাজে বকিস না। কাল পূজো হয়ে গেলে পরশু তো আমি চলেই যাব। ভাবতেই পারছি না আবার কতদিন পরে তোকে দেখতে পাবো। তোর তো কোন ফিলিংস নেই সেটা আমি ভালো করেই জানি। নয়তো আমার মন রাখতেই একটু সময় দিতে পারতি।
—–তুই একদম ফালতু বকবি না। সেদিন যখন আমি গেলাম কোথায় ছিলি তুই? সব সুন্দরী আধুনিকাদের সাথে ভালোইতো ফূর্তি করছিলি। আমার কথা মনে ছিল কি তোর? আমি সকালে উঠেই ছুটে গিয়েছিলাম বিজয়া করতে সেটা কার জন্য–বলতে বলতে গলা ধরে আসে দোলনের।
জীমূতবাহন চলতে চলতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পরে দোলনকে হ্যাঁচকা টানে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে নিজের ঠোঁট চেপে ধরে দোলনের ঠোঁটের ওপর। দোলনও জীম্বুকে দুহাতে শক্তকরে জড়িয়ে ধরে চোখবন্ধ করেনেয়।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।