আচ্ছা প্রচলিত কথাকে একটু বদলে নিয়ে যদি এভাবে বলি “দেহপট সনে ‘ঘট’ সকলি হারায়”! খুব কি অন্যায় হবে তাতে? বিশেষ করে এ যদি সেই সময়ের কথা হয় যখন বাড়ির বউএর সাথে ঘটবাবাজির বেশ লটঘট চলত। হ্যাঁ, আমি লক্ষ্মীর ঘটের কথাই বলছি।
পুরুষ মানুষ খেটেখুটে এসে জামা-ফতুয়া ছেড়ে দু’দন্ড বসতে না বসতেই ম্যাজিক! পকেট থেকে সব খুচরো পয়সা হাপিস। তেমন সুযোগ পেলে নোট ও উবে যেত চোখের নিমেষে। তারপর মানুষটা যখন পকেট হাতড়ে বেড়াচ্ছে তখন বউএর মুখে ফিচেল হাসি। আর ওই খুচরো হাসির চক্কোরে পড়ে চিরকাল খুচরো পয়সা খুইয়েছে পুরুষ। অবশ্য এ হারানোর আনন্দ বুকপকেটে গুঁজে রাখা নামের আদ্যক্ষর লেখা সাদা রুমালের ভাঁজে ভালবাসার আতরের চেয়েও সুগন্ধি। এ যেন “হারিয়ে পাওয়া আলোটিরে নাচায় ডালে ফিরে ফিরে ঝুমকোফুলের লতা”।
তা সে ঘটের বহুবিধ উদ্দেশ্য। তাই সে কখনো লক্ষ্মীর ঘট, কখনো বইমেলার ঘট। পুজোর কেনাকাটার ঘট। আকালের ঘট। আচমকা দুর্বিপাকের ঘট। সে এক সময় ছিল। যখন মেয়েরা পয়সা-আনি গুঁজে রাখতো ঘরের চালে বাঁশের ভিতর। পরে তাইই কখন যেন হয়ে ওঠে মাটির ঘট। সেই ভেঙে ছড়িয়ে যাওয়া খুচরো বা ভাঁজ করা নোট গুণে ওঠার যে আনন্দ তার কোনো তুলনা আজ কোনোভাবেই করা যাবে না। আমরা হুমকি খেয়ে পড়ে ঘটের সঞ্চয় গুনছি। থাক থাক করে সাজিয়ে রাখছি দশ, বিশ পয়সা আর আধুলি কিংবা এক টাকার কয়েনের সারি। ঠিক তখন বাবার চোখে সরল বিস্ময় এবং মায়ের মুখের প্রসন্নতার ছবি আজও নিশ্চয়ই আঁকা আছে বড় হয়ে যাওয়া সন্তানদের বুকের ভিতর।
তবে সবকিছু এত সহজ ছিল না। আসলে সূর্যের চারদিকে ঘুরতে ঘুরতে পৃথিবী যেমন নিজেও পাক খায় তেমনি ঘটের ওয়ান ওয়ে পথ কে দুরাচারী ছেলে মেয়ে ট্রাফিক পুলিশের অনবধানে উভমুখী করে তুলত সময় সময়। কাঠি, চিমটে, সন্না দিয়ে আদরে আবদারে বেরিয়ে আসত কয়েন, নোট। ‘মস্তি’ শব্দটি তখনও বাংলা ভাষায় অনুপ্রবেশ ঘটায়নি, ফলত কিঞ্চিৎ লজেন্স, চানাচুর সেবন অথবা ঘুড়ি, রবারের বল প্রভৃতি জরুরি কেনাকাটার মতো মহৎ উদ্দেশ্যে ব্যয় হত সেই ব্যাঙের আধুলি।
কত সামান্য, কত সরল চাওয়া পাওয়ায় কেটে যেত এক একটা জীবন। এই এ টি এম, সফট মানির যুগে কী অকিঞ্চিৎকর মনে হয় সেই ফেলে আসা সময়। ক্রেডিট কার্ড আর পারসোনাল লোনের মান্থলি ইনস্টলমেন্টের আড়ালে ছায়াবাজির মতো হারিয়ে গেছে আমাদের মাটির ঘট। মায়ের মুখের সেই হাসি, খুচরো হারানো বাবার অপ্রস্তুত চেহারা আজও যত্নে রাখা আছে অন্য এক পৃথিবীর বড় হয়ে যাওয়া বালকের চোখে। নিম্ন মধ্যবিত্ত বাঙালির সেই ছোটো ছোটো সুখ-দুঃখ যেন মাটির ঘটে বন্দী করে সাত সমুদ্র তের নদীর পাড়ে লুকিয়ে রেখেছে নাম না জানা এক রাক্ষস।